ভিন্ন ধারার এগারোটি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। কমবেশি সবগুলো গল্পই সুন্দর। কোনোটা চমকে দিতে পারে, আবার কোনোটা স্থির হয়ে ভাবতে বাধ্য করে। গভীর জীবনবোধ থেকে প্রতিটা গল্প লেখা হয়েছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। দার্শনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে যেন প্রতিটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করা হয়েছে। এরকম মানসম্পন্ন মনস্তাত্ত্বিক গল্প খুব বেশি নেই বাংলায়।
জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন: শিল্প সম্পর্কিত জিনিসগুলোর কখনো বাহ্যিক প্রয়োজনীয়তা চট করে চোখে পড়ে না। আপাত প্রয়োজনহীন এই জিনিস আমরা তাই কখনো কোনো ছকে বেঁধে ফেলতে পারি না। শিল্পের সৌন্দর্য এই জায়গাতেই। এই গল্পের একমাত্র চরিত্র মতিন কায়সার। একজন গল্প লেখক। পুরোটা গল্প জুড়ে শুধুই তার চিন্তাধারা বর্ণিত হয়েছে।
খুব সুন্দর করে পাঠক-লেখক সম্পর্ক এবং একজন প্রকৃত লেখকের কল্পনা সাজানো আছে। তার সংগ্রাম একটা হয়ে উঠা গল্পের স্রষ্টা হবার। যেখানে গল্পটাকে সাহিত্যের কোনো ব্যাকরণ মানতে হচ্ছে না, তার গোছানো হবারও দরকার নেই, নিখুঁতের আকাঙ্ক্ষা থেকে যে গল্পটা সম্পূর্ণ মুক্ত। সে শুধুই এক জীবন্ত গল্প লিখতে চায়। এ ধরনের শিল্পীর সাথে দুনিয়ার সম্পর্ক শুধুই রূপ-সৃষ্টির, অনুকরণের। একজন দার্শনিকের মনের ভেতরকার বিশাল জগতের কিয়দংশ নিয়ে এই গল্প।
মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার: পিতা মৃত্যুশয্যায়। হাসপাতালের বেডে অসংখ্য তার প্যাঁচানো যন্ত্রপাতির আড়ালে নাক-মুখ ঢাকা দিয়ে প্রশান্ত স্থবিরতায় শুয়ে আছে। যুদ্ধ চলছে জীবনের পক্ষে সময়ের মাপটাকে আরেকটু বাড়ানোর। এ গল্পের প্রত্যক্ষদর্শী হলেন এই পিতার পুত্র। মৃত্যু পথযাত্রী বাবাকে দেখে তার স্মৃতিচারণ হয় অতীতের নানান ঘটনার। কীভাবে বাবা সোনালী আঁশের বর্ণনা দিতো, কামলাদের পাট ধোয়ার কসরত অনুকরণ করে দেখাতো, ইয়োস-টিথোনাসের গল্প শোনাতো, গ্রামবাংলা কীভাবে একটা সুরে প্রতিনিয়ত বেজে চলতো, দাদা-নাতি কেমন করে টেলিভিশনের সামনে বসে ওয়াল্ট ডিজনির কার্টুন ফিল্ম দেখতো ইত্যাদি।
এই জীবনের দ্বারপ্রান্ত এবং মৃত্যুর মুখে ঝুলে থাকার জন্য অভিনব সব প্রযুক্তি মেডিকেল সায়েন্সের নাম নিয়ে সম্ভাব্যতার আশা দেখিয়ে পুত্রকে নৈতিকতার দ্বিধায় ফেলছে। গল্পটা মৃত্যু নিয়ে আরেকবার ভাবাবে। অনেকভাবে হয়তো দেখেছেন। এই গল্প আরো একটা দৃষ্টিকোণ দেখাবে।
টুকরো রোদের মতো খাম: খাম-চিঠি নিয়ে অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় ভোগা লোকটি আন্দালিব। যান্ত্রিকতার বার্তা নয়, দাপ্তরিকও নয়, খাপছাড়া হাতের লেখায় খামে মোড়ানো চিঠিতে তার আগ্রহ। শেষ পর্যন্ত পোস্ট অফিসে কাজ করা এক আত্মীয়ের জেরে বেওয়ারিশ কিছু চিঠি নিয়ে আসে নিজের কাছে। সেই চিঠিগুলো প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে সে খোলে, সেখানকারই একটা চিঠি, এক টুকরো চৌকো রোদ। একজন ফাঁসির আসামী সেই চিঠির প্রেরক। সেটা নিয়েই গল্প।
ছোট্ট একটা গল্পকে যখন বিশাল ব্যাপকতা ধারণ করতে দেখি, তখন সেই রচনা আর রচয়িতার প্রতি ভেতর থেকে শ্রদ্ধা আসে। এটা তেমনই একটা গল্প।
চিন্তাশীল প্রবীণ বানর: স্থান– পুরান ঢাকার নারিন্দা। যে চরিত্রগুলোকে ঘিরে এই গল্পের আবর্তন, তারা কলকাতা থেকে সম্প্রতি আগত। মোমেন, নীলুফার, তাদের মেয়ে টুম্পা এবং তাদের দূরসম্পর্কের এক ল্যাংড়া আত্মীয় ফরিদ। তাদের দৈনন্দিন জীবন-সংসার প্রত্যক্ষ করার জন্য দূর কার্নিশ থেকে এক প্রবীণ বানর বসে থাকে। দেখতে দেখতে দিন-মাস কেটে যায়। টুম্পাও বড় হয়, মোমেনের প্রমোশন হয়- আমেরিকা যাবার অফার আসে। সে চলে যায়। দিন-মাস-বছর যায়। ফেরে না। নিয়মিত সংসারে টাকা পাঠায়, চিঠিতে প্রতিশ্রুতি ভেসে আসে পরিবারকে নিয়ে যাবে শীঘ্রই। বানরটা প্রত্যক্ষ করতে থাকে। একঘেয়েমি জীবনে একটা সময় অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যায়।
গল্পটা সুন্দর। পড়া শেষে হয়তো কিছুক্ষণ প্রবীণ বানরের মতো ভাববেন আপনিও।
পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার: ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট জগতের অন্ধকার দিকগুলোর যেসব ঘটনা চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, সেখানকার এক ছিটেফোঁটা নিয়েই বোধ করি এই গল্প। পলিটিক্স সব জায়গাতেই আজ খেলছে সমান তালে। কেউ শিকার, কেউ বা শিকারী। সেখানকারই ছোট্ট এক টুকরো নিয়ে এই গল্প।
উবার: এক নির্লিপ্ত উবার চালক। এক রহস্যময়ী নারী, যে একটু পরপর ফোনে কার সাথে কথা বলে বোঝা যায় না। হোটেলের লাউঞ্জের কোনায় আপাদমস্তক বোরকায় ঢেকে দীর্ঘসময় যাবত কী জন্য বসে থাকে তাও জানা যায় না। হোটেলের কর্মচারীদের সন্দেহ বাড়তে থাকে, একসময় পুলিশও আসে। কিছুই সেরকম পরিষ্কার করে বোঝা যায় না। অপেক্ষার একটা চক্র চলতে থাকে পুরো ঘটনা জুড়ে।
অপস্রিয়মাণ তির: তুমুল বৃষ্টি। গাড়ির ভেতর তীব্র অনিশ্চয়তায় ভোগা বাবা-মা। সেই অনিশ্চয়তা দিয়েই গল্প শুরু এবং সেখানেই গল্পের শেষ। মাঝে রয়ে গেছে বয়ঃসন্ধির কঠিন পরিস্থিতিতে ভোগা তাদের সন্তান শাহাব এবং জেনারেশন গ্যাপের খুব পরিচিত কিছু গল্প। জন্মের আগে থেকে জীবনের প্রতিটা সময়ে যদি নিঃস্বার্থভাবে কেউ পাশে থাকে, তবে সেটা বাবা-মা। সেই নিঃস্বার্থে কি নিজের ভাল থাকার স্বার্থটা একেবারেই থাকে না?
গল্পটা দারুণ। বর্তমান সময়ে দুটো প্রজন্মের মধ্যে যে বিশাল ফারাক থাকে চিন্তাভাবনার, মনোজগতের, সেটা নিয়েই এই কাহিনী। গল্পের পরিণতি নেই। বিশাল এক গভীরতা আছে।
ওয়ানওয়ে টিকিট: দেশ বনাম প্রবাস এবং রফিকুল আলম বনাম রফিকুল ইসলাম- এই হচ্ছে এক লাইনে গল্পের সারমর্ম। একটা সময় ছিল যখন প্রতিবার আমেরিকায় যাবার সময় রফিকুল আলমের কাছে রিটার্ন টিকিট থাকতো। আজ ওয়ানওয়ে টিকিট। সে সময় রফিকুল ইসলাম তার বন্ধু ছিল, আত্মীয় না। সে সময় তার আগ্রহ বলতে ছিল অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ল অব থার্মোডিনামিক্স আর হাত সাফাইয়ের ম্যাজিক ট্রিক্স। জগত সংসার তাকে অন্য কিছু শেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু, তাতে তার আগ্রহ ছিল না। আজকের দিন অন্যরকম। সে জানে, বিশ্বাস, অবিশ্বাস কিংবা সন্দেহ কোনটাই সমাধান না। সে আর তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর তাগিদ অনুভব করে না। সে হয়তো পরাজিত।
এই সংকলনের অন্যতম সেরা গল্প এটি। আবেগ আর যুক্তির যুদ্ধ অথবা বলা যায় কল্পনা আর বাস্তবতার সংঘর্ষ।
লবঙের বঙ্গ ফেলে: সংকলনের অন্য গল্পগুলোর মতো নয় এটি। এখানে একটা গল্প বলা আছে। হরিণের মতো চঞ্চল নার্গিস পারভীন। কাঁঠাল ব্যবসায়ী মোজাম্মেল আলী, যার স্ত্রী সম্প্রতি গত হয়েছেন। মহিমাগঞ্জে তার মেয়ে রেহানার সংসার। রেহানার স্বামী রুহুল আমিন আর মেয়ে জুঁই। হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বরকতের প্ররোচনায় বিয়ে হয়ে যায় মোজাম্মেল আর নার্গিসের। রেহানা আর বাপের মুখ দেখতে চায় না। কিন্তু প্রায়ই মাষকলাইয়ের ডাল তার স্বামীর হাতে পাঠিয়ে দেন বাপের বাড়িতে। ঘটনা চলতে থাকে। কাহিনীর মোড় পাল্টে যায় একটা সময়ে।
মামলার সাক্ষী ময়না পাখি: এই গল্পে ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ মূলত একটা পুঁথি। এই গল্পেরই চরিত্র আবদুল করিম এর লেখক। কিন্তু কাহিনী আবর্তিত হয়েছে এক গাছির জীবনকে ঘিরে। গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়ানোই যার নেশা, পেশা। এক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যখন ঢাকার হাসপাতালে সে আসে, তখন সেখানকার তীব্র চাঞ্চল্যকর এক পরিস্থিতিতে তার তন্দ্রাচ্ছন্ন মন সুযোগ খোঁজে। সুযোগ পায় এবং সেটা কাজেও লাগায়। পুঁথির সাথে তার কোথায় যেন মিল। সহজে ধরা পড়ে না। কিন্তু সেই সাদৃশ্য মিথ্যা না।
চিন্তার খোরাক দেবে। থেমে ভাবতে বাধ্য করবে এই গল্প।
নাজুক মানুষের সংলাপ: পূর্বসূরি আর উত্তরসূরি। এদেরই কথোপকথন। উত্তরসূরি নবীন, আনাড়ি। পূর্বসূরি বিজ্ঞ, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। জীবনের উঠাপড়া, পরিব্রাজকের দায়িত্ব একটা সময় পর্যন্ত পালন করা, প্রকৃতির নিয়ম অনুসরণ করে একটা সময়ে থেমে যাওয়া, প্রশ্নগুলোকে ভালোবাসতে শেখা, মায়া আর সত্যের ফারাক খোঁজা, নৈতিকতা, যৌনতা, সৃজনশীলতাকে ধারণ করা আর পূর্ণতাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত হওয়া– এসব নিয়েই কথা হয়েছে কথোপকথনে।
খুব সম্ভবত সংকলনের সেরা রচনা এটাই।
বিন্দুতে সিন্ধু ধারণের ক্ষমতা নিয়ে লেখক শাহাদুজ্জামান সাজিয়েছেন প্রতিটা গল্প। বস্তুতঃ এখানকার কিছু কিছু রচনাকে গল্প বলতে দ্বিধা হয়। প্রবন্ধ বলে মনে হয়। বেশিরভাগ গল্পেই সংলাপ একেবারে কম। অবশ্য লেখকের লেখার ধরনই এমন, সংলাপ বেশি হলে খাপে মিলতো না।
লেখকের আগের বইগুলোর সাথে এই বইয়ের তুলনা দিতে পারছি না, কারণ এটাই আমার পড়া লেখকের প্রথম বই। বলতেই হয়- শক্তিশালী মানের একজন লেখকের সাথে পরিচিত হলাম। দুয়েকটা গল্পের প্রতি আমার ব্যক্তিগত রুচির কথা বাদ দিলে বলবো- বইটা সত্যিই দারুণ। পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।