ঢাকা মেট্রো: অমিতাভের নির্মাণে জাদুবাস্তবতার গল্প

ধরে নিন, শহরের সবচেয়ে উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলোর একটিতে আপনার বসবাস। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে গ্র্যাজুয়েশন শেষে বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে জীবনটাকে যতটা গোছানো দরকার, তারচেয়েও ঢের বেশি গোছানো হয়ে গেছে আপনার। কর্পোরেট ক্যারিয়ার আপনাকে দিয়েছে সুন্দরী উচ্চশিক্ষিত স্ত্রী, একাধিক গাড়ি ও বাড়ি, এমনকী পরস্ত্রীর সোহাগও। ঢাকাবাসী অসংখ্য যুবকের যা স্বপ্ন- তার পুরোটাই আপনার কব্জায়। এতকিছুর পরও, কোনো একদিন কোনো কারণে যদি অগস্ত্য যাত্রায় বেরিয়ে পড়তেই হয়, জীবনটাকে কি তখন পরাবাস্তব এক উপন্যাসের পাতা বলেই মনে হবে না আপনার কাছে?

কর্মব্যস্ত একদিনের শুরুটা ঠিক এমনিভাবেই এলো আব্দুল কুদ্দুসের জীবনে। শাওয়ারের ঠাণ্ডা জলধারার নিচে সে যখন প্রাত্যহিক স্বমেহনে ব্যস্ত, তখনই তার স্ত্রী আবিষ্কার করে স্বামীর এতদিনের শঠতা। কুৎসিত এক ঝগড়ার পর দুজনের পথ বেঁকে যায় দু’দিকে।

কর্মব্যস্ত একদিনের শুরুটা ঠিক এমনিভাবেই এলো আব্দুল কুদ্দুসের জীবনে; Image Source: Hoichoi

তবে কুদ্দুসের পথের প্রতিটি বাঁক যেন সাজানো ছিলো এক-একটি অলীক মায়ায়! সে পথে না চাইতেই কুদ্দুস সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যায় ঘরপালানো এক দার্শনিক কিশোরকে। কিছুদূর যেতেই তাদের সঙ্গী হয় রহস্যময় আরেক গ্রাম্য নারী, যার অতীত তাকে তাড়া করে ফেরে মরা লাশের গন্ধে মাতাল শকুনের মতোই। উদ্দেশ্যহীন সে পথে কখনও কুদ্দুসের দেখা হয় অনেক আগে মরে যাওয়া কবি বন্ধুর সঙ্গে। কখনও গহীন গ্রামের মাটির ঘরে সে খুঁজে পায় সত্যিকারের ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’।

নাগরিক বাস্তবতাকে পেছনে ছুঁড়ে ফেলে এমনই এক অদ্ভুত জগতে অনেকটা অনাহূতের মতোই ঢুকে পড়া কুদ্দুসের এই যাত্রা ‘ঢাকা মেট্রো’ ওয়েব সিরিজে তুলে এনেছেন স্বনামধন্য নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী। গত এক দশকে ঢাকাই সেলুলয়েডের খোলনলচে পাল্টে ফেলাদের একজন এই নির্মাতার নামই যথেষ্ট সিরিজটিতে দর্শক টানতে। ৯ পর্বের এই ধারাবাহিকের পরতে পরতে নিপুণ হাতে এমন জাদুর সন্নিবেশ তিনি করেছেন, যে তাতে মোহাবিষ্ট না হয়ে পারা যায় না।

ঘরপালানো এক দার্শনিক কিশোর; Image Source: Hoichoi

২০১৭-তেই ‘আয়নাবাজি’ দিয়ে গোটা দেশ কাঁপিয়ে দেওয়া অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ট্রেডমার্ক মুন্সিয়ানার সবকটিরই দেখা মিলবে ‘ঢাকা মেট্রো’তে। লম্বা হাইওয়ের টানা প্যানারমিক শট নিতে নিতেই তিনি ব্রেক কষেন নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় এক চরিত্রের ফোর্থ ওয়াল ব্রেকের মাধ্যমে। অলীক এক স্বপ্নদৃশ্যও মনের গভীরে দাগ কাটে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যায়নের জন্যই। সিরিজের থিম সং ‘সত্তা’ও নতুনভাবে যেন চেনালো বাংলা র‌্যাপের জাতকে।

অপি করিমের মতো শক্তিশালী অভিনেত্রীর পাশে সিরিজটিতে নিজেকে সদর্পেই উপস্থাপন করেছেন বাস্তব জীবনের বড় কর্পোরেট কর্মকর্তা নেভিল ফেরদৌস হাসান। এই দুই প্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের সেরাটা দিয়েছে ক্ষুদে শিল্পী শরীফুল ইসলামও। নির্মাতা এবং কুশীলবদের এই দারুণ পারফর্মেন্সের বাইরেও ‘ঢাকা মেট্রো’তে রয়েছে এমন কিছু- যার স্বাদ অনেকদিন ধরেই অনুপস্থিত ছিল বাংলা ফিকশনে।

সিরিজটির প্রতিটি পর্বেরই রয়েছে আলাদা আলাদা নাম। ‘সম্পর্ক’, ‘বিচ্ছিন্নতা’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘ঘেরাটোপ’, ‘মুক্তাঞ্চল’, ‘নির্বেদ’ ও ‘অগস্ত্য যাত্রা’- এই ধারা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, কর্পোরেট কারাগারে আটকে থাকা এই সময়ের মানুষদের আত্মাকে খুঁজে ফেরার গল্পই বলতে চেয়েছেন নির্মাতা। আর সেখানেই সূক্ষ্ম তুলির স্পর্শে তিনি ব্যবহার করেছেন পরাবাস্তবতাকে। সাহিত্যের পাতায় বহুল ব্যবহৃত এই কৌশল অমিতাভ রেজা দারুণভাবে প্রয়োগ করেছেন নিজের গল্পকথনে।  তাই তো নাটকের দৃশ্যে আতাফল হঠাৎ করেই হয়ে ওঠে তাজা গ্রেনেড। মফস্বলের দেহপসারিণীর ভরাটকণ্ঠে শোনা যায় জীবনানন্দের কবিতা। গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধা গিটার বাজাতে বাজাতে গল্প করেন শৈশবের বন্ধু বব ডিলানের।

অপি করিমের মতো শক্তিশালী অভিনেত্রীর পাশে সিরিজটিতে নিজেকে সদর্পেই উপস্থাপন করেছেন নেভিল ফেরদৌস হাসান; Image Source: Hoichoi

পরাবাস্তবতার জাদুময় সুতোতেই ধীরে ধীরে অমিতাভ বুনেছেন গোটা সিরিজির গল্পটিকে। তাই প্রথম পর্বের যে ক্লান্তিকর শহুরে গল্পের আভাস দর্শককে দেয় গ্লানির স্বাদ, সেটি খুব দ্রুতই ধুয়ে যায় একের পর এক উদ্ভট কিংবা অবাক করা চমকে। অথচ তার কথনশৈলী এতটাই নির্মোহ যে, ‘এটাই স্বাভাবিক’ ধরে নিয়ে পরাবাস্তবতার জগতে খুব সহজেই প্রবেশ ঘটবে দর্শকের। আর এভাবেই দর্শকের মগজ থেকে নাগরিক বাস্তবতার মেকি পর্দাগুলো যেন একে একে টান মেরে খুলতে থাকেন নির্মাতা।

আর এটি করতে গিয়ে নির্মাতা পেয়েছেন তার পূর্ণ স্বাধীনতা। নিয়ম আর ব্যাকরণের তোয়াক্কা না করে সাধারণের ভালোবাসা আর ঘৃণার সব বুলিই তুলে এনেছেন অবলীলায়। কুদ্দুসের উঁচুতলার জীবনকে তুলে ধরতে বাংলা নাটকের এতদিনকার ট্যাবুকেও তুলে আনতে পিছপা হননি তিনি।

বেশ কিছুদিন ধরেই পশ্চিমের নেটফ্লিক্সের মতোই দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিনোদনের অনলাইন প্লাটফর্মগুলো। দারুণ সব কাজ নিয়ে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হইচই। হইচইয়ের সাবস্ক্রাইবার হলেই স্মার্ট ফোন, স্মার্ট টিভি, ট্যাব, ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপে দেখে ফেলা যাবে সিরিজটি। ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ড ছাড়াও অন্যান্য লোকাল ওয়ালেটের মাধ্যমে বাংলাদেশি টাকায় হইচইয়ে সাবস্ক্রাইব করা যাবে। 

পরাবাস্তবতার জাদুময় সুতোতেই ধীরে ধীরে অমিতাভ বুনেছেন গোটা সিরিজির গল্পটিকে; Image Source: Hoichoi

অমিতাভ রেজার অদ্ভুত সুন্দর এই সিরিজটি নতুন এক পথেরই যেন নির্দেশ করছে বাংলা নাটকের দর্শকদের। প্রথম সিজনেই এমন মায়াজাল; এর পরের মৌসুমগুলোতে না জানি আরও ত চমকের বহর নিজের ঝুলিতে রেখে দিয়েছেন এই নির্মাতা!

This article is on the web series Dhaka Metro.

Featured Image Source: Hoichoi

Related Articles

Exit mobile version