“‘কেউ কথা রাখেনি’ একটি কাব্যিক অভিব্যক্তি। ঢালাও অভিযোগও বলা চলে। কিন্তু সত্যিটা হলো, ‘কেউ কেউ কথা রাখে’। “
নাম দেখে মনে হবে এটি শুধুই একটি রোমান্টিক বই। আসলে কিন্তু তা নয়; এটি একইসাথে ডিটেক্টিভ থ্রিলার, রোমান্টিক ও ট্র্যাজিক ঘরানার। এরই সাথে যুক্ত আছে আমাদের সমাজের কিছু সমস্যার বিরুদ্ধে লেখকের নিজস্ব মতামত। সবমিলিয়ে একটা ভালোলাগার মতো বইয়ে যা যা উপাদান থাকা দরকার, তার সবই এতে উপস্থিত; হাসি-কান্না, ভালোলাগা অথবা কোনোকিছু না পাওয়ার অব্যক্ত বেদনা।
বইটি লেখকের পুরোপুরি মৌলিক সৃষ্টি নয়, তা তিনি নিজেই জানিয়েছেন। আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক এদুয়ার্দো সাচেরির ‘লা প্রেহুন্তা দে সুস ওহোস’ (La pregunta de sus ojos) বইটি পড়ে তিনি মুগ্ধ হলে অনুবাদ করতে যান। কিন্তু অনুবাদ করা আর হয়ে উঠলো না; উক্ত বইটির দ্বারা প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত হয়ে সম্পূর্ণ নিজের সৃষ্ট চরিত্র ব্যবহার করে আমাদের দেশের সামাজিক সমস্যাকে পুঁজি করে নিজের কাহিনী অনুসরণ করে লিখে ফেললেন ‘কেউ কেউ কথা রাখে’। এ সম্পর্কে বইয়ের প্রথমে ‘লেখকের কথা’ অংশে তিনি বলেন-
“এ বইটি আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। সিদ্ধান্ত নিই অনুবাদ করার জন্য, কিন্তু কাজ শুরু করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে! মৌলিক লিখতে লিখতে অনুবাদ করা ভুলে গেছি। মূল কাহিনী আর চরিত্রগুলো পাশ কাটিয়ে নিজের মতো করে চরিত্র আর কাহিনী লিখতে শুরু করে দিয়েছি! সম্ভবত এর কারণ, ঐ সময় আমার মাথায় সাচেরির গল্পটির মতোই একটি পিরিওডিক্যাল মার্ডার মিস্ট্রি ঘুরপাক খাচ্ছিলো। অন্যদিকে, মূল উপন্যাসের সময়কাল আর রাজনৈতিক আবহের সাথে আমাদের দেশের একটি সময়ের আশ্চর্য রকমের সাযুজ্যও খুঁজে পেয়েছিলাম।”
দীর্ঘ দুই যুগ পূর্বে দেশের স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ঢাকায় নিজ বাসায় ধর্ষণের পর খুন করা হয় মিলি নামের এক মেয়েকে। খুনীকে খুঁজতে তদন্তে জড়িয়ে পড়েন ভিন্ন দুই স্বভাবের দুজন পুলিশ- একজন দুই বছর হওয়া পুলিশে যোগ দেওয়া অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর ও অন্যজন সিনিয়র সাব-ইন্সপেক্টর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার ভাই।
তদন্ত করতে গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর বা কাহিনীর কথকের সাথে পরিচয় ঘটে মিলির বন্ধু রামজিয়া শেহরিনের। প্রথমে মিলির স্বামীকে সন্দেহ করা হলেও একসময় আসল খুনীকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সে মুক্তি পেয়ে যায়। মুক্তির পরে খুনী কথক ও রামজিয়া শেহরিনের সাথে খারাপ আচরণ করলে অন্যায়ের প্রতিবাদী নাছোড়বান্দা হায়দার ভাই পুনরায় তাকে গ্রেফতার করে মনের আশ মিটিয়ে ধোলাই দেন। এতে হায়দার ভাইয়ের জীবনাবসানের সূচনা হয় এবং ছাড়া পেয়ে খুনী আবার একটি খুন করে।
উক্ত মিলি হত্যাকাণ্ড কিছু মানুষের জীবন পুরোপুরি বদলে দেয়; তেমনিভাবে হায়দার ভাইয়ের মৃত্যুর পরে কাহিনীর কথক পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে গ্রামে চলে যান এবং পরে লেখালেখি শুরু করেন। দীর্ঘ দুই যুগ পরে যখন তিনি তার জীবন বদলে দেওয়া ঘটনা নিয়ে বই প্রকাশ করতে চাইলেন, তখন অনেক খুঁজে অনুমতির জন্য মিলির স্বামীর সাথে দেখা করেন। কিন্তু সেদিন সেখানে তিনি নতুন একটি চমকপ্রদ বিষয় আবিষ্কার করেন।
বইটি যখন পড়বেন, তখন মনে হবে আপনার মনের ভাবনাগুলোই এখানে প্রকাশিত হয়েছে, যা পাঠকমনকে এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করবে। এতে কিছু রাজনৈতিক বিষয় ও সে সম্পর্কে ধারণাও প্রকাশিত হয়েছে, যা আপনাকে কিছু বিষয় সম্বন্ধে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করবে এবং কিছু বিষয় নতুন করে জানতে পারবেন। এসব কিছু হায়দার ভাই নামক চরিত্রটির চিন্তাধারার মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। এরপরে যখন সেই হায়দার ভাইয়ের ঘটনায় কথকের মতো নিজেকেও অসহায় মনে হবে এবং মনের ভেতরে একটা শূন্যতার অনুভূতি সৃষ্টি হবে।
এক বন্ধুর পরামর্শে বইটি পড়েছিলাম। পড়ার পরে যেন ‘এতদিন কোথায় ছিলে’ ধরনের দুঃখ হয়েছে। এর আগে এবং পরে এই লেখকের আরো কিছু বই পড়েছি। তার লেখা বইগুলোর মাঝে ‘কেউ কেউ কথা রাখে’ অবশ্যই অনন্য। বইটির মধ্যে পাঠককে গল্পে আকৃষ্ট করে রাখার ক্ষমতা প্রচণ্ড। আপনি শুধুই একজন ডিটেক্টিভ থ্রিলার প্রেমী হলেও এই বইটির স্বাদ আস্বাদন করে দেখতে পারেন, আশা করি নিরাশ হবেন না।
বইয়ের নাম: কেউ কেউ কথা রাখে || লেখক: মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন
প্রকাশক: বাতিঘর প্রকাশনী || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম