সেই ১৯২৩ সাল থেকে ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিও আমাদেরকে উপহার দিয়ে চলেছে একের পর এক না ভোলার মতো গল্প। আমাদের সবার ছোটবেলার একটি বড় অংশ দখল করে আছে তাদের কার্টুন, অ্যানিমেশন মুভিগুলো দিয়ে। কিন্তু প্রদীপের নিচেই থাকে অন্ধকার। ওয়াল্ট ডিজনির জন্য আমাদের মনে একটি বিশেষ জায়গা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই কার্টুনগুলোর মাধ্যমে ফুটে ওঠা বর্ণবৈষম্য আমরা লক্ষ্য করতে পেরেছি কি?
মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে চলুন আপনাদের সাথে পরিচয় করাই তথাকথিত ডিজনির একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ রাজকুমারী টিয়ানার সাথে।
দ্য প্রিন্সেস অ্যান্ড দ্য ফ্রগ (২০০৯)
আমরা যারা এই মুভিটি দেখেছি,তারা নিশ্চয়ই আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছি। দ্য প্রিন্সেস অ্যান্ড দ্য ফ্রগ ওয়াল্ট ডিজনির একটি মিউজিকাল-ফিচার অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি নেয়া হয়েছে আমেরিকান শিশু সাহিত্যিক এলিজাবেথ ডসন বেকারের উপন্যাস দ্য ফ্রগ প্রিন্সেস থেকে।
আমরা সবাই যে গল্পটি জানি, তা হলো এক রাজকুমারী একদিন একটি ব্যাঙ খুঁজে পায়। জানতে পারে যে ব্যাঙটি আসলে রাজকুমার এবং শুধুমাত্র একজন রাজকুমারীর চুম্বনে সে মানুষ হতে পারবে। এটিই এই গল্পের আসল রূপ ছিল, যা গ্রিম ব্রাদার্স ‘দ্য ফ্রগ প্রিন্স’ নামক গল্পে উল্লেখ করে। বেকারের গল্পে মূল কাহিনীর কিছু পরিবর্তন ছিল।
গ্রিম ব্রাদার্সে যেটি ছিল ফ্রগ ‘প্রিন্স’, বেকারের উপন্যাসে তা হয় ফ্রগ ‘প্রিন্সেস’। যা-ই হোক, ডিজনিও এই কাহিনীর মধ্যে তার নিজস্বতা দেখিয়েছে। আমরা এখানে ডিজনির মুভি ভার্সনটি সম্পর্কে জানব।
মুভির পটভূমি আমেরিকার নিউ অরলিন্স শহর। এখানেই থাকে টিয়ানা তার বাবা-মায়ের সাথে। তার মা ছিলেন একজন কাপড় সীবনকারী। বলে রাখা ভালো, টিয়ানা ও তার পরিবার ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু টিয়ানার বান্ধবী সারলেট ছিল শহরেরে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির কন্যা। গল্পের মূল আকর্ষণ ছিল কী করে টিয়ানা সব প্রতিকূলতা পার করে তার বাবার স্বপ্ন পূরণ করে। ছোটবেলা থেকেই টিয়ানা রন্ধনে পারদর্শী ছিল। তার বাবার স্বপ্ন ছিল যে তার মেয়ে নিউ অরলিন্সের একটি রেস্তোরাঁর মালিক হবে। টিয়ানাকে পুরো গল্পে যেমন আত্মবিশ্বাসী, কঠোর পরিশ্রমী দেখানো হয়েছে, তার বান্ধবী সারলেটকে ততটাই আত্মকেন্দ্রিক, বোকা ও ধনীর বিগড়ে যাওয়া সন্তান হিসেবে দেখানো হয়েছে। দর্শক টিয়ানার ব্যাক্তিত্ব দেখে সম্মান না করে পারবেন না।
কিন্তু এত কঠোর পরিশ্রমী একজন নারীকেও ডিজনি অ্যানিমেশন তাদের আগের ছাঁচে গড়া কাঠামোতে ফেলে দেয়! বেকারের গল্পের মতো এখানেও টিয়ানার দেখা হয় একটি ব্যাঙ রাজকুমারের সাথে। সে ছিল মেলডোনিয়ার রাজকুমার প্রিন্স নবীন, কিন্তু একটি দুষ্ট জাদুকরের কারণে সে ব্যাঙে পরিণত হয়। টিয়ানা বিশ্বাস করতো না রূপকথায়। সে জানত পৃথিবীতে সবই শুধু কঠিন সাধনায় পাওয়া সম্ভব।
টিয়ানা তার স্বপ্নের রেস্তোরাঁর জন্য বহু বছর ধরে টাকা বাঁচাচ্ছিল। কিন্তু সে কোনো আশা দেখতে পাচ্ছিল না। উপায়ান্তর না দেখে টিয়ানা প্রিন্স নবীনকে মানুষে পরিণত করার বদলে তার কাছে সাহায্য চায়।
চুম্বনের পর প্রিন্স নবীন মানুষ হলো না, বরং দুজনেই ব্যাঙে পরিণত হল। এরপর এক রোমাঞ্চকর অভিযানের মাধ্যমে তারা দুজন ব্যাঙের বেশে ঘুরে বেড়ালো। পথে এলো অনেক বিপত্তি, জুটলো অনেক বন্ধু। এবং টিয়ানা ও নবীন একে অপরের প্রেমে পড়ে গেল।
আপাতদৃষ্টিতে এই মুভিতে টিয়ানাকে যথেষ্ট শক্তিশালী, আত্মনির্ভরশীল মনে হবে। আর প্রিন্স নবীনকে মনে হবে একজন অসহায়, সারলেটের মতোই ধনীর বিগড়ে যাওয়া ছেলে, যে নিজে কিছুই করতে পারে না। কিন্তু কঠিন ব্যক্তিত্বের টিয়ানাকেও কয়েকবার নবীনের চেয়ে ছোট করে দেখানো হয়েছে।
ডিজনির একমাত্র ‘কালো’ রাজকুমারী হিসেবে টিয়ানাকে বলা হলেও এর সমালোচনা রয়েছে অনেক। টিয়ানা আদতে কোনো রাজকুমারী ছিল না। সে নিউ অরলিন্সের মতো বড় শহরে একটি অসচ্ছল পরিবারের কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে ছিল মাত্র।
অদম্য আত্মবিশ্বাস থাকলেও স্বপ্ন পূরণের জন্য তাকে শেষে কোনো এক রাজকুমারেরই শরণাপন্ন হতে হলো। বিশেষ করে সর্বশেষ দৃশ্যটি এই মুভির বর্ণবৈষম্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। টিয়ানার প্রথম চুম্বনে দুজন ব্যাঙে পরিণত হওয়ার কারণ- টিয়ানা রাজকুমারী ছিল না। কিন্তু মুভির শেষ দৃশ্যে দেখা যায় ব্যাঙ হয়েই তারা আজীবন থাকতে চায় এবং ব্যাঙের বেশেই বিয়ে করে। যখনই তাদের বিয়ে হয়, তখনই তারা দুজন আবার মানুষে পরিণত হয়। কেন? কারণ যেহেতু নবীন একজন রাজকুমার, তার স্ত্রী হিসেবে টিয়ানাও তখন রাজকুমারী!
অতএব, প্রথম দেখায় এই মুভিকে নারীবাদী বলে মনে হলেও এর পদে পদে দেখানো হয়েছে বর্ণ ও লিঙ্গবৈষম্য। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর পক্ষে শ্বেতাঙ্গদের দেশে একা পথ চলা কঠিন- এই মন্ত্রই ডিজনি প্রচার করেছে।
টিয়ানা কি তাহলে ডিজনির একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ রাজকুমারী?
দ্য প্রিন্সেস অ্যান্ড দ্য ফ্রগ মুভিটির অনুপ্রেরণা নেওয়া হয় একটি সত্য ঘটনা থেকে। নিউ অরলিন্সে আসলেই টিয়ানার মতো একজন কৃষ্ণাঙ্গ বাবুর্চি ছিলেন। তার নাম লিয়া চেইস। তাকে বলা হয় The Queen of Creole Cuisine.
ক্রিউল একটি আফ্রিকান-ইউরোপীয় খাবার পদ্ধতি। লিয়া চেইসের জীবনের উপর ভিত্তি করেই টিয়ানাকে বাবুর্চির ভূমিকা দেয়া হয়। টিয়ানার মতো লিয়া চেইসের স্বপ্ন ছিল তার রেস্তোরাঁ ‘ডুকি চেইস’স রেস্টুরেন্ট’। কৃষ্ণাঙ্গ হলেও লিয়া চেইস সম্পূর্ণ আফ্রিকান ছিলেন না। তিনি আফ্রিকা বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক ছিলেন! তাহলে দ্য প্রিন্সেস অ্যান্ড দ্য ফ্রগকে কোনোভাবেই আফ্রিকান রাজকুমারীর গল্প বলা যাবে না।
দ্য প্রিন্সেস অব নর্থ সুদান: আফ্রিকান রাজকুমারী নিয়ে আরেকটি বিতর্ক
২০১৪ সালে ওয়াল্ট ডিজনি ঘোষণা করে তারা নর্থ বা উত্তর সুদানের রাজকুমারীর উপর একটি অ্যানিমেটেড মুভি তৈরি করবে। আপনি যা ভাবছেন, তা নয়। নাম দেখে মনে হতে পারে, বাহ! বেশ তো! আফ্রিকার সুদানের একজন কৃষ্ণাঙ্গ রাজকুমারীর গল্প। কিন্তু পেছনের গল্পটি বেশ অন্ধকার। এই উত্তর সুদানের রাজকুমারী কৃষ্ণাঙ্গ নয়; শ্বেতাঙ্গ এবং আমেরিকার নাগরিক।
ভার্জিনিয়ার একজন কৃষক জেরেমি হিটন। তার মেয়ের ইচ্ছা সে রাজকুমারী হবে। তাই পিতা মানচিত্র ঘেঁটে বের করলেন এমন জায়গা, যা এখন পর্যন্ত কোনো দেশের অন্তর্গত নয়। পেয়েও গেলেন। মিশর ও সুদানের মাঝামাঝি ৮০০ বর্গকিলোমিটারের একটা জায়গার নাম বীর ত্বইলি। সে স্থানকে তিনি তার ‘রাজ্য’ ঘোষণা করলেন এবং নাম দিলেন নর্থ সুদান– যা আদতে কোনো স্বীকৃত দেশ নয়।
কন্যার জন্য পিতার ভালোবাসার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ওয়াল্ট ডিজনি দ্য প্রিন্সেস অব নর্থ সুদান নামক একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র বানাতে মনস্থির করে। কিন্তু ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন অংশের মানুষের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাদের। সুদান ও মিশরের একটি স্থানকে নিজের বলে দাবি করায় এতে উপনিবেশবাদই প্রচার হচ্ছে বলে দর্শকরা মনে করেন।
কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ হওয়াতেই পৃথিবীর যেকোনো স্থানকে নিজের ইচ্ছায় দাবি করা কতটা স্পর্ধার বিষয় তা নিয়েই বিতর্ক। এর মধ্যে ওয়াল্ট ডিজনি চলচ্চিত্র তৈরির মাধ্যমে একে নীরব সমর্থন দিচ্ছে, তাও দর্শকদের হতাশ করেছে।
দ্য প্রিন্সেস অব নর্থ সুদান হতে পারতো ডিজনির প্রথম এবং একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ, আফ্রিকান রাজকুমারীর গল্প। কিন্তু একজন শ্বেতাঙ্গ মেয়েকে সুদান ও মিশরের মতো কৃষ্ণাঙ্গদের রাজকুমারী ঘোষণা করা তাদের এত বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষতগুলোকে যেন তাজা করে দেয়।
নিজের রাজ্যকে জেরেমি পৃথিবীর একমাত্র দাতব্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। তিনি চান তার ‘রাজ্যে’ থাকবেন কিছু বিজ্ঞানী, যারা আবিষ্কার করবেন কীভাবে অল্প পানিতে শস্য ফলানো যায়। যদিও তার এই ধারণা প্রশংসার দাবি রাখে, তাও বিশ্ববাসীর কাছে তিনি এখনো গ্রহণযোগ্যতা পাননি। তার রাজ্যের জন্য তার দরকার ২৫০,০০০ মার্কিন ডলার এবং অনেকে তাকে সে টাকা তুলতে সাহায্যও করছেন!
*দ্য প্রিন্সেস অব নর্থ সুদান ২০১৫ থেকে নির্মাণাধীন রয়েছে।
ফিচার ইমেজ: Edited by writer