প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আহমেদ তার নিজ জীবনের গল্পগুলো লিখে গেছেন বেশ কিছু স্মৃতিকথামূলক বইয়ে। তার মাঝে একটি হলো ‘অন্তরে অম্বরে’। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি, পারিবারিক জীবন, কর্মক্ষেত্র আর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এতে। স্মৃতিচারণ করতে করতে কখনো গিয়েছেন দুরন্ত শৈশবে, আবার কখনো লিখেছেন কৈশোরের ঝোঁকের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্তের কথা। ব্যক্তিজীবন আর পারিবারিক জীবনের গল্প, আর তার সাথে কাছের সম্পর্কগুলোকে খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন পাঠকদের কাছে।
“এই জীবনে বেশির ভাগ কাজই করেছি আমি ঝোঁকের মাথায়। হঠাৎ একটা ইচ্ছে হল, কোনদিকে না তাকিয়ে ইচ্ছেটাকে সম্মান দিলাম। পরে যা হবার হবে।” – হুমায়ুন আহমেদ
এরকম ঝোঁকের ইচ্ছেকে সম্মান দেয়ার ছোট্ট কয়েকটা উদাহরণ দিই। সেসময় সায়েন্সের ছেলেদের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ইংরেজি বা ইকনমিক্স পড়া ছিল ফ্যাশন। হুমায়ূন আহমেদও ফ্যাশনমত ইকনমিক্সে ভর্তি হয়ে গেলেন। তাঁর এক বন্ধু পড়বে কেমিস্ট্রি। তাকে নিয়ে গেলেন কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে। হঠাৎ একজন স্যারকে চোখে পড়লো, ভীষণ স্মার্ট, সুদর্শন! সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললেন, ইকনমিক্স জলে ভেসে যাক, উনি পড়বেন কেমিস্ট্রি! ভর্তি হয়ে গেলেন কেমিস্ট্রিতে।
পরে পিএইচডি করতে গেলেন ভৌত রসায়নের উপর। দু’বছর কেটে গেছে, কোর্স ওয়ার্ক সব শেষ। একদিন বারান্দায় সিগারেট টানতে টানতে হাঁটছেন, খেয়াল করলেন এক বুড়ো ভদ্রলোককে। ঢুকে গেলেন সেই ক্লাসে। পলিমার রসায়ন বিভাগের প্রধান তিনি। তার লেকচার শুনে তিনি মুগ্ধ! সিদ্ধান্ত জানালেন তাকে, তিনি ঐ বিভাগে যেতে চান। ভৌত রসায়নের প্রফেসর শুনে রাগ করলেন, হম্বিতম্বি করলেন, কিছুতে কাজ হলো না। পিএইচডি করলেন পলিমার রসায়নে।
গুলতেকিনের সাথে তার বিয়েটাও হয় অমন ঝোঁকের মাথায়। তখন তিনি হতদরিদ্র। লেকচারার হিসেবে ইউনিভার্সিটি থেকে সব মিলিয়ে সাত/আটশ’ টাকা পান। বাবর রোডের এক সরকারি বাসায় থাকেন, যেটার এভিকশন নোটিস তখন হয়ে গেছে, ম্যাজিস্ট্রেট নিজে এসে বলে গেছেন বাড়ি ছাড়তে, না ছাড়লে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হবে। নিতান্ত পাগল না হলে অমন অবস্থায় কেউ বিয়ের চিন্তা করে না। উনি করলেন। গুলতেকিনকে একদিন তিন মিনিট সময় দিলেন ভাবার জন্য, কোর্টে বিয়ে করবে কিনা। গুলতেকিন এক মিনিটেই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। অথচ তিনি তখন মাত্র ক্লাস টেনের ছাত্রী! পরে অবশ্য কোর্টে তাঁদের যাওয়া হয়নি। কনের বয়স মাত্র চৌদ্দ বলে। বিয়ের পরদিনই তাঁদের পুরো পরিবারসহ ঐ বাসা থেকে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হয়।
দুটো জিনিস নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের তীব্র আগ্রহ ছিল, মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু। খুব কাছ থেকে এ দুটি ব্যাপার দেখতে চাচ্ছিলেন তিনি। এক ডাক্তার বন্ধুকে বললেন, কোন মুমূর্ষু রোগী যদি মৃত্যুশয্যায় থাকে তাকে যেন ফোনে জানানো হয়, তিনি এসে দেখবেন, শুধু একবারের জন্য। হলোও তাই। চল্লিশ বছরের হত-দরিদ্র এক রোগী, সাথে তীব্র খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে, কিন্তু রোগী নিতে পারছে না, ফুসফুস কাজ করছে না। হঠাৎ কি হলো কে জানে, ডাক্তারদের সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে লোকটির খিঁচুনি বন্ধ হলো, স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস শুরু হলো। মৃত্যু আর দেখা হলো না সেদিন।
পরবর্তীতে হুমায়ূন-কন্যা শীলার জন্মদৃশ্য সামনে থেকে দেখার সুযোগ হলো হুমায়ূন আহমেদের। দ্বিতীয় ইচ্ছেটিও একদিন পূর্ণ করে দিলো প্রকৃতি। তারই ছেলের মৃত্যু হলো তার চোখের সামনে। দুটো ইচ্ছেই পূর্ণ হলো তার সন্তানদের জন্ম-মৃত্যুর মাধ্যমে। কী লীলা ঈশ্বরের!
ঘড়ি জিনিসটির প্রতি লেখকের দুর্বলতা শৈশব থেকেই। এখনকার মতো সেকালে তো সবার হাতে হাতে ঘড়ি ছিল না। অষ্টম শ্রেণিতে প্রথম বৃত্তির টাকা পেয়ে তিনি তার মাকে বললেন একখানা ঘড়ি কিনে দিতে। মা শুনে বললেন, তিনি কখনো শোনেনইনি ম্যাট্রিকের আগে কেউ ঘড়ি পরে। কিন্তু আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ থাকাতে ম্যাট্রিকের সময়ও তিনি হাতঘড়ি পাননি। সাড়ে তিনশ’ টাকা দিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো ঘড়ি কিনলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকারও দেড় বছর পর, স্কলারশিপের টাকা দিয়ে। কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় রেলস্টেশন থেকে ঐ ঘড়ি কেউ টান দিয়ে ছিনিয়ে নেয়। খুব অভিমান হলো লেখকের। আর ঘড়ি কিনলেন না। পরে তার ৩২তম জন্মদিনে গুলতেকিনের দেয়া ঘড়ি হাতে পড়েন।
“আমি এখনো নিশিযাপন করি। মাঝে মাঝে কেমন জানি লাগে। মনে হয় হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা যেন হারিয়ে যায়নি— আছে, আমার পাশেই আছে। এই তো ভালোবাসা এবং মমতায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এমন অনুভূতি কখনো দিনে হবার নয়— তার জন্যে প্রয়োজন চিররহস্যময়ী— রাত্রি। অনন্ত অম্বর।”
হুমায়ূন আহমেদের রাত জাগার অভ্যাস যার মাধ্যমে শুরু, তাকে নিয়ে এই লাইনটা, যিনি থ্রোট ক্যান্সারে ভুগে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যান।
বইটা হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনীমূলক, তার অভ্যাস, উৎসাহ, নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, যুক্তি, মুক্তিযুদ্ধের কিংবা চিত্রগল্প বানানোর খণ্ড খণ্ড কাহিনী নিয়ে লেখা এই বইটি। হুমায়ুন আহমেদ নিয়ে আগ্রহী সকলেরই ভালো লাগবে।
বইয়ের নাম : অন্তরে অম্বরে || লেখক : হুমায়ুন আহমেদ
প্রকাশক : কাকলী প্রকাশনী || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান : রকমারি.কম