মাথায় কদম-ছাট দেয়া স্যুট-টাই পরিহিত এক ভদ্রলোক পিস্তল তাক করে আছে ব্যাংকের কর্মচারীদের দিকে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, তিনি এসেছেন ব্যাংক ডাকাতি করতে। কিন্তু আর পাঁচটা ব্যাংক ডাকাত বা ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার থেকে সেলুলয়েডের ফিতায় দেখানো প্রিজন ব্রেকের এই দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর আভাস দিচ্ছে। মুখের সাথে সম্পর্ক নেই কোনো মুখোশের, শান্ত-ধীর-খোশ আমেজে দিয়ে যাচ্ছেন ডাকাতির কঠোর হুমকি-ধমকি। ধীর-স্থিরতা দেখে মনে হচ্ছে, পুলিশি গ্রেফতারের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন তিনি। পুলিশ আসার পর হাসিমুখেই নিজেকে হাতকড়ার কাছে সমর্পণ করলেন। সাথে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা স্বভাবসিদ্ধ মুচকি হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, পুরোটাই ছিল প্ল্যান-মাফিক। সামনে অবাক হবার মতোই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
এভাবেই পর্দায় অভিষেক ঘটেছিল তুমুল জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ প্রিজন ব্রেক-এর। অন্যান্য সিরিজ যেখানে ক্যারেক্টার বিল্ডাপের জন্য পুরো এক সিজন সময় নেয়, প্রিজন ব্রেক সেখানে থ্রিলের রোলার কোস্টিং শুরু করেছে পাইলট এপিসোডের পাঁচ মিনিট পর থেকেই। এরপর থেকে বয়ে যাওয়া দুর্দান্ত থ্রিল ও টুইস্টের আবহ পুরো সিরিজটাকে এনে দিয়েছে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, তৈরি করেছে নতুন এক থ্রিলার সিরিজ বেঞ্চ-মার্ক। আজও সিনেমা পাড়ার গলিতে গলিতে প্রিজন ব্রেক নিয়ে চলে দুস্তর আলোচনা, সিনেমা-প্রেমিদের চায়ের টেবিলে ঝড় উঠে প্রিজন ব্রেক আড্ডায়।
কাহিনীর সংক্ষিপ্ত সার হলো- মিথ্যা খুনের দায়ে ফাঁসানো হয়েছে লিংকন বারোজ নামক এক ভদ্রলোককে। নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করা লিংকন বারোজ শতবার চেষ্টা করেও নিজেকে আদালতে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেনি। গায়ে খুনের কলঙ্ক লেগে থাকা লিংকনকে আদালত থেকে দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা। এদিকে লিংকন বারোজের ভাই মাইকেল স্কোফিল্ড তখন সদ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেরিয়েছে। তুখোড় মেধাবী স্কোফিল্ড শুরুতেই বুঝে গিয়েছিল, সোজা আঙুলে যেহেতু ঘি উঠছে না, তাই আঙুল বাঁকা করতে হবে।
ফক্স রিভার জেলখানার নকশা নিয়ে বসলেন তিনি। দীর্ঘ কাঠখোট্টার পর মাথা থেকে বের আনলেন সূক্ষ্ম সকল পরিকল্পনা, রাখলেন প্রতিটার বিকল্প ব্যবস্থাও। উদ্দেশ্য নিজে জেল খানায় বন্দী হওয়ার পর ভাইকে নিয়ে জেল থেকে পালাবেন। কিন্তু পরিকল্পনায় প্রথম বাগড়াটা দিলো জেলখানার জটিল নকশা। কিছুতেই নকশার আঁকাবাঁকা দুর্বোধ্য ও জট পাকানো পথগুলো মনে রাখতে পারছেন না তিনি। একটার সাথে আরেকটা শরবতে মতো গুলিয়ে ফেলছেন। অস্থিরতায় পায়চারি করার পাশাপাশি ক্ষোভে ফেটে পড়তে লাগলেন বার বার। এমন সময় পিৎজা ডেলিভারি দিতে এলো এক মেয়ে। তার সারা শরীর ছিল ট্যাটু খচিত। তা দেখে মাথায় চমৎকার এক বুদ্ধি খেলে গেলো মাইকেলের। ভাবলেন, নকশাগুলোকে ট্যাটুর ফাঁকে ফাঁকে এঁকে ফেলছেন না কেন?
পুরো পরিকল্পনাকে ট্যাটুতে রূপ দেওয়ার পর সাজালেন ব্যাংক ডাকাতির নাটক। পুলিশের কাছে গ্রেফতারের পর, দুই ভাইকে একই জেলে রাখা হয়। সেই থেকে শুরু হয় শুরু হয় দুই ভাইয়ের জেল পালানোর অভিযান। কারাগারে প্রবেশের পর থেকে তাকে কোথায় কী করতে হবে, কীভাবে সে ধীরে ধীরে তার ভাইকে নিয়ে কারাগার থেকে পালাবে তার সমস্ত পরিকল্পনা যেভাবে মাইকেল করে রেখেছিল। এভাবেই আগাতে থাকে সিরিজটি, গল্পের সাথে যুক্ত হয় নতুন নতুন বাঁক, থ্রিল ও অসংখ্য টুইস্ট। কী ছিল মাইকেলের শরীরে আঁকা ট্যাটুগুলোর অন্তরালে?
CUTE POISON
মাইকেল স্কোফিল্ডের অগ্র-বাহুতে বড় হাতের অক্ষরে লেখা ‘CUTE POISON’ মূলত বৃহদাকার এক পাত্র থেকে রাসায়নিক কোনো তরল ঢালার চিত্র নির্দেশ করে। রাসায়নিক তরল বলার চেয়ে ‘পোশন’ বলাই শ্রেয়। রসায়নের খটরমটর ভাষায় বিশ্লেষিত বিজ্ঞান ক্ষেত্র বাদেও পুরাণ শাস্ত্রে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষ করে, হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজিতে পোশন ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং প্রতি পর্বে ছিল এর ছড়াছড়ি ও আধিক্য। প্রিজন ব্রেক সিরিজে কপার সালফেট ও ফসফরিক অ্যাসিডের সংমিশ্রণে তৈরি এই রাসায়নিক দ্রব্য ৪২.৩৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফোটানোর পর জেল পালানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক ধাপ এগিয়েছিল স্কোফিল্ড। জেলখানার সাথে হাসপাতালের সংযুক্ত থাকা পাইপগুলোতে সে কিউট পয়জন এমনভাবে ব্যবহার করেছিল, যাতে সেগুলো মরিচা ধরে ক্ষয় হয়ে যায়। মাইকেল সফলতার দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল প্রায়, কিন্তু শেষ মূহুর্তে কারা-কর্তৃপক্ষ বর্জ্য নিষ্কাশনের সেই পাইপ বদল করে ফেলে।
English, Fitz, And Percy
সিরিজের প্রথম সিজনের পঞ্চম এপিসোডে পুলিশ কর্তৃক সেল পরিদর্শনের সময়, মাইকেল সেখানে অনুপস্থিত ছিল। এ ফাঁকে সে পালানোর তিনটা বিকল্প পথ বেছে রেখেছিল। পথগুলো হলো ইংলিশ স্ট্রিট, ফিতজ স্ট্রিট, আর পার্সি অ্যাভিনিউ। একটা পথে পালাতে ব্যর্থ হলে, আরেকটা বেছে নেওয়া- এভাবেই সে তার পরিকল্পনার বিস্তীর্ণ নীলনকশা সাজিয়েছিল।
শয়তানের মুখাবয়ব
প্রথম সিজনের ‘রায়ট, ড্রিল অ্যান্ড দ্য ডেভিল পার্ট ওয়ান’, এপিসোডে এক টুকরো কাগজে খসখস করে এঁকে ফেলে পূর্বপরিকল্পিত এক শয়তানের মুখাবয়ব। তারপর এর নিখুঁত মাপ অনুযায়ী তার সেলমেট ফার্নান্দো সুক্রের সাহায্য একটা কংক্রিটের দেয়ালে ড্রিল মেশিন দিয়ে সেটাকে বসিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, কি-পয়েন্ট নির্ধারণ করা। এরপর নির্মাণ প্রকৌশলী মাইকেল স্কোফিল্ড হুকের স্থিতিস্থাপকতার নীতি (F = -kx) ব্যবহার করে দেয়ালের মুখ্য চাপ পরিমাপ করতে সক্ষম হয়, যা পরবর্তীতে তাকে জেল পালানোতে ব্যাপক সহায়তা করবে।
তুরুপের তাস
স্কোফিল্ডের ট্যাটুর এক জায়গায় তাসের চিত্র অঙ্কিত ছিল, যেগুলোতে ক্রমানুসারে 13129093529 নাম্বারগুলো দেওয়া ছিল। আপাতদৃষ্টিতে সেটাকে কেটে দেওয়া তাসের একটা গুচ্ছ মনে হলেও, এটা ছিল আসলে নিকা ভোলেক নামে একজনের ফোন নাম্বার। ব্যাংক ডাকাতিতে ধরা পড়ার আগের দিন চেক প্রজাতন্ত্রের এই অভিবাসীর সাথে মাইকেল তথাকথিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। জেল পালানোতে সাহায্য করার প্রতিদানে স্কোফিল্ড তাকে একটা গ্রিন কার্ডের ব্যবস্থা করে দেবে- এ রকম একটা চুক্তি হয়েছিল তাদের মাঝে।
ক্রুশ-সমেত কফিন
ক্রুশ চিহ্নিত এই কফিনের ট্যাটুর নিচে লুকানো ছিল ছোট্ট-কালো একটা ওষুধের বড়ি, যেটা খেলে সাময়িকের জন্য খাদ্যে বিষক্রিয়ার মতো প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে শরীরে। মূলত, স্কোফিল্ড আগে থেকেই সেটা তার চামড়ার নিচে ঢুকিয়ে রেখেছিল, যেন পরিস্থিতি অনুযায়ী কেটে বের করে ফেলা যায়। একা, অন্ধকার সেলে তার ভাই লিংকন যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে, চতুর মাইকেল তখন সবার অগোচরে সেই ছোট্ট বড়ি আর অল্প একটু কাগজে ‘EAT 8 : 10’ লিখে একটা ক্রুশ-চিহ্নের ভিতরে করে পাঠায়। বড়ি সেবন করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে লিংকন, ফলে তাকে তৎক্ষণাৎ জেলখানার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ফাঁকে আবার নতুন ফন্দি আঁটতে বসে যায় সেয়ানা মাইকেল স্কোফিল্ড।
Ripe Chance Woods
মাইকেলের কব্জির ট্যাটুতে ইংরেজি হরফে লেখা ‘Ripe Chance Wood’ মূলত মৃত ই. চাঞ্চ ওডসকে বুঝিয়েছে। কারণ Ripe শব্দকে ভাঙলে R.I.P পাওয়া যায়, যা দিয়ে বুঝানো হয় Rest in peace, আর শেষের e দিয়ে E. Chance Woods। বিস্তারিত বললে, সেটা ছিল স্কোফিল্ডের একটা ব্যাকআপ প্ল্যান। যদি কোনো কারণে তার আসল পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, সেজন্য এই বিকল্প পথ খোলা রেখেছিল সে। ইলিনয়ের এক গোরস্থানে মাইকেল কিছু পোশাক-আশাক, গাড়ির চাবি, আর একটা নকল পরিচয়পত্র ই. চান্স ওডসের সমাধির নিচে পুঁতে রেখেছিল। সিজন ২ এর প্রথম এপিসোড ‘ম্যানহান্ট’-এ আরেক চটপটে খেলোয়াড় এজেন্ট আলেকজান্ডার ম্যাহোন ছবি দেখে এই ট্যাটুটারই প্রথম রহস্যোদ্ধার করতে পেরেছিলেন।
বারকোড
বারকোড 38 12 1037 অনেকগুলো নির্দেশের সমষ্টি। 38 দিয়ে বোঝানো হয়েছে ইলিনয়ির পথকে, 12 ইঙ্গিত করে ব্রিজের কাছে পৌঁছুতে মোট কত মাইল পাড়ি দিতে হবে। 1037 নির্দেশ করে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি 103.7-কে, যেটা ওই ব্রিজে বোম ফোটানোর মাধ্যমে দুই ভাইয়ের ভুয়া মৃত্যু কাহিনী সাজাবে। এভাবেই নিরাপত্তা রক্ষীদের একের পর এক ফাঁদ চক্রে ফাঁসিয়ে যায় দুই ভাই।
গোলাপে অঙ্কিত যীশু কিংবা 617
গোলাপে অঙ্কিত যীশু বা ‘ক্রাইস্ট ইন অ্যা রোজ‘ চিত্রলিপিটা মূলত পানামায় নোঙর বাঁধা বোট ‘ক্রিস্টিনা রোজ’ এর কথা স্পষ্ট করে বোঝায়। স্কোফিল্ডের মায়ের নামে এই বোটের নামকরণ করা হয়, যা সে পানামা থেকে পালানোতে ব্যবহার করে। 617 হলো সে বোটের কম্বিনেশন কোড। এছাড়াও এ ট্যাটুতে গ্রিক বর্ণ ওমেগার দেখা মেলে, যা পালানো প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপকে নির্দেশ করে।
Bolshoi Booze
‘Bolshoi Booze’ শব্দগুচ্ছটা মূলত একটা মিরর ইমেজ যেটা টেক্সাস-মেক্সিকো বর্ডারের স্থানাঙ্ক ৩২°০′০৯″ উত্তর, ১০৪°৫৭′০৯″পশ্চিমকে নির্দেশ করে। দ্বিতীয় সিজনের এগারো নং এপিসোডের এই একই নাম রাখা হয়েছে। অর্থাৎ পুরোটা এপিসোডই টেক্সাস-মেক্সিকো বর্ডারের কাহিনী নিয়ে চিত্রায়িত।
ফুল (অ্যাপাচি ডেসার্ট ঘোস্ট)
মেক্সিকোতে পলায়নে সহায়তা করার বিনিময়ে স্কোফিল্ড পেদ্রো র্যামোস নামক এক লোককে এক বাক্স নাইট্রোগ্লিসারিন দেয়ার ওয়াদা করেছিল। সেই নাইট্রোগ্লিসারিন সে লুকিয়ে রেখেছিল ব্ল্যান্ডিং বোটানিক্যাল গার্ডেনের এক ফুলগাছের তলায়। ওখানে কর্মীদের বেশভূষা নিয়ে যাওয়ার পরেও দুইজন অ্যাজেন্ট মাইকেলকে চিনে ফেলতে সক্ষম হয়, যদিও তাদের হাতের ফাঁক গলে বরাবরের মতো বেরিয়ে যায় স্কোফিল্ড।
যে ট্যাটুগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলো সব স্কোফিল্ড করিয়েছে ফক্স রিভার জেলখানায় প্রবেশ আগে। পঞ্চম সিজনেও জেলখানায় বন্দি হবার পর স্কোফিল্ডের শরীরের আরবি হরফের কিছু ট্যাটু দেখা গেছে, যেগুলো দিয়ে তিনি ওই জেল থেকেও পালাতে পেরেছিলেন। কারাগারে প্রবেশ করা যত সহজ, সেখান থেকে বের হওয়া তার থেকে শতগুণ কঠিন। মাইকেল স্কোফিল্ড সে কথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই যেন সে অসাধ্যকে করেছেন সাধন। এর জন্য অনেক জটিল জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার পাশাপাশি, মৃত্যু পরোয়ানার কাছাকাছিও ঘেঁষতে হয়েছে তাকে।
প্রিজন ব্রেক সিরিজটা একপ্রকার ফাঁদ ও নেশার মতো। দেখা শুরু করলে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্যকিছুতে মন বসানো যায় না। ডেভেলপমেন্টের সময় প্রথম সিজনে ১৩টি এপিসোড থাকার কথা থাকলেও তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে সেটি গিয়ে ২২ পর্বে ঠেকে। ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিরিজ এ পর্যন্ত ৫ সিজনে মোট ৯০টি এপিসোড মুক্তি দিয়েছে। ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট, গল্প, আবহ সঙ্গীত, দুর্দান্ত অভিনয়, অসাধারণ সব টুইস্ট ও থ্রিলের অনুপম মিশ্রণে প্রিজন ব্রেক সিরিজের জগতে হয়ে উঠেছে চির-অম্লান, যার আবেদন কখনোই ফুরোবে না।