১৯৪৩ সাল। সমগ্র ইউরোপের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের আওতাধীন বেলারুশও তখন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। ওপেনিং শটে দেখা মেলে দুজন সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া বালকের। তারা অবস্থান করছে একটা ট্রেঞ্চে। সেখানকার বালুকাময় মাটিতে তারা খোঁজ করছে পরিত্যক্ত রাইফেলের। যা পেলে তারা যোগদান করতে পারবে সোভিয়েত পার্টিজানদের দলে। যারা তেমন অস্ত্রশস্ত্র না থাকলেও হানাদার জার্মানদের ঠেকিয়ে দেয়ার পণ করেছে।
বালকেরা খুঁজে চলেছে রাইফেল। আর তাদেরকে এমন খোঁজাখুঁজি করতে চিৎকার করে নিষেধ করে চলেছেন একজন গ্রামের মোড়ল। তিনি বার বার তাদেরকে এই বলে সতর্ক করার চেষ্টা করছেন যে, অস্ত্রের জন্য তাদের খোঁড়াখুঁড়ি আকাশে উড়তে থাকা জার্মান বৈমানিকদের নজরে পড়বে। আর এলাকায় নরক গুলজার হবে। কিন্তু তাকে পাত্তা না নিয়ে বালকেরা তাদের খোঁজ জারি রাখে। এবং তাদের মধ্যে একজন একটি রাইফেল খুঁজেও পায়। নাম তার ফ্লিওরা (অ্যালেক্সেই ক্র্যাভচেঙ্কো)। কিন্তু তারা ক্ষুণাক্ষরেও টের পায় না যে, আকাশে উড়ুক্কু একটি বিমানের চোখে পড়েছে ব্যাপারটি।
অস্ত্রের সংস্থান হয়েছে। এবার যুদ্ধে যাবে। দেশকে শত্রুমুক্ত করবে। এ আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ে ফ্লিওরা। কিন্তু তাতে বাধ সাধেন তার মা (তাতিয়ানা সেস্তাকোভা)। কারণ তিনি জানেন যুদ্ধ কেমন। নিজের বড় সন্তানের প্রাণ বেঘোরে ঝরে পড়ুক তা তিনি চান না। এদিকে ফ্লিওরার অস্ত্র পাওয়ার ঘটনা পৌঁছে যায় সোভিয়েত পার্টিজানদের কানে। ফলশ্রুতিতে আমরা পরদিন দুজন পার্টিজান সদস্যকে তার বাড়িতে আগমন করতে দেখি তাকে নিজেদের দলে অন্তর্ভুক্ত করতে। কিছু ঘটনার পর, মায়ের শত নিষেধ সত্ত্বেও পার্টিজানদের দলে ভিড়ে যায় ফ্লিওরা।
পার্টিজান দলে ফ্লিওরার ভূমিকা হয় লো-র্যাংক মিলিশিয়ার। তার উপর অর্পিত হয় নানা ফুটফরমাশ খাটার বা পাহারার দায়িত্ব। এদিকে উচ্চশ্রেণির কর্তারা এসে বলে বড় বড়, বুক চাপড়ানো দেশপ্রেম আর শত্রুদের কচুকাটা করার কথা। এসব কথা ফ্লিওরাকে উদ্বুদ্ধ করে। তার কিশোর মনে আঁকে নানা রঙিন স্বপ্ন। তবে আকাশে স্বপ্নীল বিচরণ থেকে পপাত ধরণীতল হতেও সময় বেশি লাগে না। কেননা, যখন পার্টিজানরা যুদ্ধ অভিমুখে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়, তখন কমান্ডার কসাচ (লিউবোমিরাস লাউসেভিসিয়াস) ফ্লিওরাকে ক্যাম্পেই থেকে যেতে বলে। কারণ তার বয়স আর অভিজ্ঞতা দুটোই কম।
বিফল মনোরথে ফ্লিওরা হাঁটতে আরম্ভ করে ক্যাম্প সংলগ্ন বনে। কাঁদতেও শুরু করে। এ সময় তার সাথে দেখা হয়ে যায় সমবয়সী গ্লাশার (ওলগা মিরোনোভা)। সে-ও পার্টিজানদের সাথেই কাজ করছে নার্স হিসেবে। উভয় টিনেজারের মাঝে বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়। তাদের বন্ধুত্বের পর পরই পুরো বনভূমি কেঁপে ওঠে বিকট শব্দে। জার্মান প্যারাট্রুপার আর ডাইভ বম্বাররা হামলা করেছে পার্টিজান ক্যাম্পে!
জার্মানদের আক্রমণে কিছুক্ষণের জন্য শ্রবণশক্তি হারায় ফ্লিওরা। এরপর গ্লাশাকে নিয়ে জীবনরক্ষায় ব্রতী হয় সে। জার্মানদের ভয় কেটে গেলে সে গ্লাশাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে যাবে বলে ঠিক করে। যখন তারা বাড়িতে পৌঁছায়, তখন দেখা যায় সেটি জনশূন্য। খাবারদাবারের ওপর ভনভন করছে মাছি। তখন স্বাভাবিকভাবেই গ্লাশার মনে হয় তাদেরকে জার্মানরা মেরে ফেলেছে। কিন্তু ফ্লিওরা তা মানতে নারাজ। সে মনে করে তার পরিবার জলা পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছে। সে ঠিক করে তারাও সেই দ্বীপে যাবে।
দ্বীপে যাওয়ার পথে গ্লাশা কাঁধের ওপর দিয়ে তাকায়। তখন সে দেখতে পায় গ্রামবাসীদের মৃতদেহের স্তুপ। কিন্তু ফ্লিওরাকে সে এ ব্যাপারে আঁধারে রাখে। দ্বীপে যাওয়ার সময় যে জলাটা পেরোতে হয়, সেটিতে তারা নামে। সেসময় আগেরদিনের ভয়াবহ স্মৃতির দরুন উভয়েই হিস্টিরিয়াগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তখন গ্লাশা বলে বসে- ফ্লিওরার পরিবার আসলে মারা গেছে। সে লাশের স্তুপ দেখেছে তাদের গ্রামে। এ সত্য মেনে নিতে পারে না সে। বরং অসহ্য হয়ে সে গ্লাশাকে ডুবিয়ে মারতে চায়। এ অবস্থা থেকে তাদের উদ্ধার করে রুবেজ (ভ্লাদাস ব্যাগদোনাস)। যে নিজেও একজন পার্টিজান যোদ্ধা। সে তাদেরকে নিয়ে যায় দ্বীপে, জার্মান হামলা থেকে রক্ষা পেয়ে পালিয়ে আসা একটি বড় গ্রুপের কাছে।
সেখানে গিয়ে ফ্লিওরা দেখতে পায় গ্রামের মোড়লকে। তিনি জানান, তিনি ফ্লিওরার পরিবারকে খুন হতে দেখেছেন। আরো যোগ করেন, তোমাকে আমি এজন্যই বন্দুক খুঁজতে নিষেধ করেছিলাম। এ কথা শুনে ফ্লিওরার ওপর নেমে আসে পাপবোধের মেঘ। সে আত্মহত্যার পথে পা বাড়াতে চায়। কিন্তু গ্লাশা আর অন্যরা মিলে তাকে থামায়। আরো কিছু ঘটনা ঘটে দ্বীপে। এরপর রুবেজ ফ্লিওরা আর আরো দুজনকে সঙ্গী করে খাবারের সন্ধানে নেমে পড়ে। কিন্তু যে ওয়্যারহাউজে তারা খাবারের জন্য যায়, সেটিতে কড়া পাহারা বসিয়েছে জার্মানরা। বিফল হয়ে যখন ফেরার পথ ধরে, তখন তারা এসে পড়ে একটি মাইনফিল্ডে। ফলশ্রুতিতে দুজন সঙ্গীকে হারায় তারা।
সে সন্ধ্যায় জার্মান নিয়ন্ত্রিত একটি গ্রাম থেকে গরু চুরি করতে সমর্থ হয় তারা। খোলা মাঠ দিয়ে গরুটিকে নিয়ে আসার সময় জার্মান মেশিনগানের গুলিতে সেটি মারা পড়ে। এরপর একটি ঘোড়া চুরি করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে ফ্লিওরা এসে পৌঁছায় পেরেখোডি গ্রামে। জার্মানদের এসে যেখানে তান্ডবলীলা চালায়। অল্প ক’দিনেই বয়স বেড়ে যায় ফ্লিওরার। তার সাথে আবারও দেখা হয় গ্লাশার। কিন্তু এ অবস্থায় গ্লাশাকে দেখতে চায়নি ফ্লিওরা, চাইনি আমরাও।
১৪২ মিনিট দৈর্ঘ্যের কাম অ্যান্ড সি পরিচালনা করেছেন এলেম ক্লিমভ। এর চিত্রনাট্যে তার সাথে ছিলেন আলেস আদামোভিচ। চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রে তারা অবলম্বন করেছেন দুটি সাহিত্যকর্মকে। একটি হলো ১৯৭১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত উপন্যাস খাতিন। অন্যটি হলো ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্মৃতিকথন আই অ্যাম ফ্রম আ ফায়ারি ভিলেজ। যেটিতে সহ-লেখক ছিলেন চিত্রনাট্যকার আদামোভিচ। সিনেমাটি নির্মাণ করতে গিয়ে সোভিয়েত সেন্সর কর্তৃপক্ষের সাথে দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধে নামতে হয় ক্লিমভকে। তারপরই তিনি নিজের মতো করে সিনেমাটি নির্মাণের অনুমতি পান।
যুদ্ধ নিয়ে বীরত্বসূচক, বুক চাপড়ানো দেশপ্রেম বিষয়ক সিনেমার তো অভাব নেই। কাম অ্যান্ড সি-তে স্বেচ্ছায় এ পথের বিপরীতে হেঁটেছেন পরিচালক। তার সিনেমার বিষয়বস্তু আরো প্রগাঢ়, গুঢ় এবং সূক্ষ্ম। প্রতিটি দৃশ্যে এখানে আন্দোলিত হয়েছে যুদ্ধবিরোধীতার কথা এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা। এটি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের জ্বালিয়ে দেওয়া ৬২৮টি বেলারুশীয় গ্রামের প্রতি একটি ট্রিবিউট।
যুদ্ধের সাথে এখানে সুচিন্তিত সংমিশ্রণ ঘটেছে হাইপার রিয়ালিজম, সুক্ষ্ম সাররিয়ালিজম, ফিলোসফিক্যাল এক্সিসটেন্সিয়ালিজম, সাইকোলজিক্যাল, পলিটিক্যাল এবং অ্যাপোক্যালিপটিক থিমের। এগুলোর প্রকাশভঙ্গি কাব্যিক, যা দর্শকের ওপর প্রভাব ফেলে, অনুভব করাতে পারে এবং এর রেশ থেকে যায় বহুদিন। আমরা অবলোকন করি কীভাবে যুদ্ধ হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসে। কীভাবে এটি মানুষের শিকড়কে উপড়ে ফেলে, টিনেজারদের কীভাবে এক লহমায় বুড়ো করে দেয়। যুদ্ধ কীভাবে আমাদের অতীতকে মুছে দেয়। ভবিষ্যতকে করে লুণ্ঠিত।
এ বিষয়গুলোর প্রকাশের জন্য সিনেম্যাটোগ্রাফিকে হতে হতো পোক্ত। আর সে কাজই দক্ষতার সাথে করেছেন অ্যালেক্সেই রোদিওনোভ। বার বার তিনি ফ্লিওরার মুখের ক্লোজ-আপ শট নিয়েছেন। তার চোখ আর মুখের অভিব্যক্তিতেই যেন যুদ্ধের ভয়াবহতা মূর্ত হয়। সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিকও তাই এসব ক্লোজ-আপ শট এবং ফ্লিওরা চরিত্রে অ্যালেক্সেই ক্র্যাভচেঙ্কোর অভিনয়।