সাফল্যের ব্যাখ্যা: সফল যদি হতে চাও

আনিসুল হক কিশোর ও তরুণদের জন্য বেশ কিছু লেখা লিখেছেন। তাদের মধ্যে সাম্প্রতিক প্রকাশনা ‘সফল যদি হতে চাও’। এটি মূলত তার বিভিন্ন সময় নেওয়া সাক্ষাৎকারের আলোকে লেখা। লেখক এ বইতে উল্লেখ করেছেন একজন মানুষ কীভাবে সফলতার শীর্ষে পৌঁছাতে পারে। এ বইতে তিনি বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে সফল ব্যক্তিদের সফলতার ঘটনা তুলে ধরেছেন। সঙ্গে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সময়ের সফলতার গল্প, যা মানুষকে সফল হতে এবং সফলতার পথে অনুপ্রেরণা দিতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি তিনি কিশোর-তরুণদের দিয়েছেন প্রাসঙ্গিক কিছু উপদেশ। যেহেতু বইটি অনেকের সাক্ষাৎকারের আলোকে লেখা, তাই এতে অনেকের চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে।

সফল যদি হতে চাও বইয়ের প্রচ্ছদ; প্রচ্ছদ শিল্পী: মাসুক হেলাল 

বইয়ের শুরুতে লেখক নিজেকে ব্যর্থ বলে গণ্য করেছেন। আর সফলতার পরামর্শ দানের বেলায় ব্যর্থরা সফলদের চেয়ে সফল। বইটি শুরু করেছেন স্বপ্ন দিয়ে। স্বপ্ন কী? স্বপ্ন দেখলে তা পূর্ণ হওয়া কতটা জরুরী? শুরুর দিকে আছে এ. পি. জে আবদুল কালামের ব্যর্থতার গল্প। তিনি হতে চেয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। দেরাদুন গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আটজনকে নেওয়া হয়, আর তিনি পরীক্ষায় হলেন নবম।

খুব মন খারাপ হয়েছিল তার। ভগ্ন মনে একটা নদীর ধারে বসে ছিলেন তিনি। এ সময় একজন সাধু এলেন তার কাছে, বললেন, “খােকা, তুমি কেন একা একা নদীর ধারে বসে আছ? তোমার কি মন খারাপ?” আবদুল কালাম বললেন, “আমার জীবনের আর কোনো মানে নেই। আমি পাইলট হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়েছি। ব্যর্থ এই জীবন নিয়ে আমি এখন কী করব?” সাধু বললেন, “তুমি পরীক্ষায় ফেল করেছ তার একটা কারণ হয়তো আছে। নিয়তি তোমাকে বিমান বাহিনীর পাইলট হওয়ার জন্য তৈরি করেনি। তোমার ভাগ্যে নিশ্চয়ই অন্য কিছু হওয়া নির্ধারণ করে রাখা আছে। তুমি ওঠো, যাও, অনুসন্ধান করো যে নিয়তি তোমাকে কী হওয়ার জন্য বানিয়েছে। যাও, অনুসন্ধান করো।”

তিনি উঠলেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা করলেন। তিনি হলেন ভারতের সবচেয়ে নামী মহাকাশ বিজ্ঞানীদের একজন। শেষে ভারতের রাষ্ট্রপতি।

এ. পি. জে আব্দুল কালাম; Image: jagranjosh.com

এ. পি. জে আব্দুল কালামের মতো হুমায়ূন আহমেদ, অধ্যাপক এম জাহিদ হাসান, বিল গেটস ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন এফ. আর. খান ছাড়াও আরো অনেক সফল ব্যক্তিদের সফলতার গল্প উঠে এসেছে। বিখ্যাত কিছু বইয়ের অংশবিশেষ, যেমন- পাওলো কোয়েলহোর দ্য  অ্যালকেমিস্ট বইয়ের গল্পটা ।

এক ছেলেকে তার বাবা পাঠালেন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির বাড়িতে উপদেশ নেওয়ার জন্য। ছেলেটা সেই জ্ঞানী ব্যক্তির প্রাসাদে গিয়ে হাজির হলাে। বললো, আমার বাবা আমাকে পাঠিয়েছেন উপদেশের জন্য। আপনি আমাকে উপদেশ দিন। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, তোমাকে আমি উপদেশ দেবো। তার আগে তোমাকে একটা চামচ দিচ্ছি। এই চামচে তেল ভরে। তুমি পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখবে । তবে শর্ত আছে। তােমার চামচ থেকে যেন তেল পড়ে না যায়। ছেলেটা পুরাে বাড়ি ঘুরল। ফিরে এসে বলল, এবার আমাকে উপদেশ দিন।

জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, বলাে তাে পাশের ঘরে কী আছে? আমি বলতে পারব না। কেন পারবে না? কারণ, আমি সারাক্ষণ চামচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যেন চামচ থেকে তেল পড়ে না যায়। কাজেই আশপাশে কী আছে, সেদিকে আমি তাকাতে পারিনি। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, তুমি আবার যাও। তােমার হাতে চামচ থাকবে, চামচে তেলও থাকবে, সেই তেল তুমি ফেলতে পারবে, কিন্তু আমাকে বলতে হবে কোন ঘরে কী আছে।

ছেলেটা চামচ হাতে পুরাে বাড়ি ঘুরে দেখল। বলল, এবার আমি বলতে পারব কোন ঘরে কী আছে। পাশের ঘরে আছে সুন্দর সুন্দর ছবি। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, তােমার চামচের তেল কোথায়? ছেলেটি তাকিয়ে দেখল, চামচ থেকে তেল পড়ে গেছে। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, এটা তোমার প্রতি আমার উপদেশ। আমাদের চামচ থেকে তেল পড়তে পারবে না। কিন্তু আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে, তা দেখতে হবে । যা কিছু আনন্দের, উপভোগের তাতে অংশ নিতে হবে, উপভোগ করতে হবে। কিন্তু চামচ থেকে যেন তেল পড়ে না যায়।

আনিসুল হক; Image: SazzadHossain/Wikimedia Commons

বইটির ‘মানবিক শিক্ষালয় চাই’ অংশটি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ধরা যায়। এ শিক্ষালয়ের কথা বলা হয়েছে আমাদের প্যান অপটিক সমাজে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তোতার কাহিনীতে রাজা তার প্রিয় পাখিটাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য পুথি থেকে রাশি রাশি পাতা পাখিটার মুখে ঠেসেছিলেন। ফলে পাখির মৃত্যু ঘটে। তেমনই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার, দেশ ও রাষ্ট্র ইত্যাদি সব মিলে যা তৈরি হয়েছে তা পাখিকে বিদ্যা গেলানোর মতো হয়ে যায়নি তো?

প্রতি বছর রেজাল্টের পর আত্মহত্যা নতুন সংবাদ নয়। পরীক্ষার ফল জীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধু পরীক্ষার ফলের উপর গুরুত্ব না দিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ২০ জন শীর্ষ ধনীর মধ্য ১ জনও ক্লাসের ফার্স্ট বয় নেই।

বইয়ের মতে সফল হওয়ার সূত্র আসলে এই-

১. যা ভালো লাগে তা-ই করো;

২. কাজকে ভালোবাসো, ফলকে নয়। কাজ উপভোগ করে ফলের আশা করে কাজ করো না;

৩. প্রচুর পড়ো;

৪. শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, সমাজসেবা, মানুষের সেবার চর্চা করো;

৫. নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখো; 

৬. স্বাস্থ্য ভালো রাখো; 

৭. অন্যের সাফল্যে খুশি হও; 

৮. যােগাযােগ বাড়াও। নিজেকে প্রকাশ করতে শেখাে; 

৯. প্রচণ্ড সাধনা করো; 

১০. ব্যর্থতায় ভেঙে পড়ে না।

সফলতা বলতে শুধু যে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানো বা লেখাপড়া করে গাড়ি চড়া তা নয়। সফলতা হলো জীবনকে সুন্দর করা, নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার সীমাকে প্রসারিত করা। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কৌতূহল ও সচেতন করে তোলা। মানবতার উপকারে আসা।

বইয়ের নাম: সফল যদি হতে চাও || লেখক: আনিসুল হক
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন || প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
পৃষ্ঠা সংখা: ২২০ || অনলাইনে প্রাপ্তির স্থান: rokomari.com 

Its a review of Sofol Jodi Hote Chao by Anisul Hoque. 

Featured Image: Cover design of Masuk Helal

RB-SM

Related Articles

Exit mobile version