‘একাত্তর’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা, শহীদ পরিবারের আহাজারি কিংবা ধর্ষিতার অশ্রুসিক্ত নয়নের দৃশ্য। যে গল্প শুনতে গেলে আমাদের হৃদয়-মন হয়ে ওঠে ভারাক্রান্ত। আবার এরই মাঝে যখন শুনি মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনি, তা আমাদের মাঝে জাগিয়ে দেয় এক শিহরণ। আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাই হয়তো জানি। কিন্তু কতটুকু গভীরভাবে জানি? ‘৭১ সালে যেমন আমরা রক্ত দিয়েছি, একইভাবে রক্ত নিয়েছিও! রচনা করেছি এমন সব বীরত্বের ইতিহাস যা আপনার কল্পনাশক্তিকেও ছাড়িয়ে যাবে। সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে।
মুক্তিযুদ্ধের এমন ১৫টি দুর্ধর্ষ, রোমাঞ্চকর ফ্রন্টলাইন অপারেশন নিয়েই ‘১৯৭১: ফ্রন্টলাইনের সেরা অপারেশন‘ বইটি রচিত। ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর নাপাম বোমা নৃশংসতার কথা আমরা অনেকেই শুনেছি মিডিয়ার কল্যাণে। রাসায়নিক আগুনে বোমাটি যেখানে নিক্ষেপ করা হয়, সেখানে ২,২০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা তৈরি হতে পারে। ফলে গলে যেতে পারে চামড়া, এমনকি হাড়ও! ভয়ানক যন্ত্রণা নিয়ে মারা যায় অথবা পঙ্গু হয় মানুষ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদারদের ছোড়া নাপাম বোমার ঘটনা আমরা কতজন জানি? ১৯৭১ সালে নাপাম বোমা নিক্ষেপ করা হয় আমাদের বাংলাদেশেও। এর ফলে আক্রান্ত হন চুয়াডাঙ্গা, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি জেলার মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধ যে শুধুমাত্র অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল তা না, বরং সেই সাথে একটি মনস্তাত্ত্বিক লড়াইও ছিল। লড়াইয়ের সময় শত্রুপক্ষের অনুমিত পথে না এগিয়ে সম্পূর্ণ অন্য পথে এসে ভড়কে দেওয়া অনেক বেশি কাজে দেয়। প্রতিপক্ষ ডিফেন্স সাজালো একদিকে, আর শত্রু আসলো আরেক দিক থেকে! এমনই এক ঘটনা ঘটে বয়রা-গরিবপুরের যুদ্ধে, যেখানে অ্যাম্ফিবিয়াস বা উভচর ট্যাংক দিয়ে হানাদারদের উপর আক্রমণ করা হয়। গ্রামের কর্দমাক্ত এলাকা দিয়ে পথ দেখিয়ে ভারতীয় ট্যাংক নিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধারা। কিছু জায়গায় খেজুর গাছ বিছিয়ে দেয়া হয় ট্যাংক পার হতে! বয়রার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ডগফাইট বা আকাশযুদ্ধ। দুটি ঘটনাই লেখক বেশ সুচারুরূপে বইয়ের পাতায় স্থান তুলে ধরেছেন লেখক।
মুক্তিযুদ্ধে যেমন হাতাহাতি যুদ্ধ ছিল, সেই সাথে ছিল ট্যাংক, পদাতিক, গোলন্দাজ, নৌ কিংবা বিমানযুদ্ধও। এমনই এক ঘটনা ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’, যে যুদ্ধের কৌশল পড়ানো হয় ৩৫টি দেশের সামরিক একাডেমিতে! তার মানে বোঝাই যাচ্ছে এই যুদ্ধটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ‘ব্যাটল ফর খুলনা’ শিরোনামে শিরোমণি যুদ্ধে পাক বাহিনীর ভুল এবং মুক্তিবাহিনীর কৌশল নিয়ে লেখক বেশ বিস্তারিতভাবে লিখেছেন, যা পাঠককে সেই সময়ে নিয়ে যাবে।
পাকবাহিনীর হাইকমান্ড থেকে মাঠে থাকা সেনাদের বলা হয়ছিল, “এই যুদ্ধ হিন্দুদের বিরুদ্ধে।” কোনো কোনো সেনা জীবনের অন্তিম মুহুর্তে এসে উপলব্ধি করতে পারেন যে এটা কোনো ধর্মযুদ্ধ নয়, বরং দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। এমনই একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা আছে বইয়ের একাংশে, যেখানে আহত এক পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নিজের ভুল বুঝতে পারেন। মৃত্যুর আগে তিনি ক্ষমা চান এবং নিজের অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দেন!
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ৪৫ দিন পার হবার পরও দেশে রয়ে গিয়েছিল এক টুকরো পাকিস্তান। ঢাকার বুকে মিরপুরে বিহারিরা তখনও পাকিস্তানকে দীর্ঘায়িত করার স্বপ্নে বিভোর। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিল দলছুট কিছু পাকসেনা এবং রাজাকার। মিরপুর মুক্ত করতে প্রয়োজন হয় ‘ডোর টু ডোর ফাইট’। মিরপুরের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধ। বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, ১৪৯ জন এই অন্তিম যুদ্ধে শহীদ হন। এটাই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ‘দ্য লাস্ট ব্লাড অব ফ্রিডম’ বা স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ। এ জন্য ঘটনাটি লেখক বইয়ের শেষের দিকে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়াও বইটিতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের ‘নরম্যান্ডি ল্যান্ডিং’-এর সাথে তুলনীয় ‘চিলমারী রেইড’, উপমহাদেশের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ‘কামালপুর যুদ্ধ’-এর কথা তুলে ধরা হয়েছে।
এরকমই পনেরটি রোমহষর্ক, শিহরণ জাগানিয়া গল্প নিয়ে ‘১৯৭১: ফ্রন্টলাইনের সেরা অপারেশন‘ বইটি রচিত। প্রতিটি গল্পেই প্রচুর পরিমাণে ছবি ও ম্যাপের ব্যবহার রয়েছে। মলাটে রয়েছে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার কিশোর পারেখের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তোলা একটি ছবি, যা পাঠককে তৎকালীন যুদ্ধাবস্থার কথা মানসপটে আনতে সাহায্য করবে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক যুদ্ধের সাথে তুলনা করে তুলনামূলক আলোচনা।
যেহেতু প্রথম মুদ্রণ, ফলে কিছু বানান ভুল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে তাতে মূলভাব প্রকাশে ব্যাঘাত ঘটেনি। আশা করব লেখক ২য় মুদ্রণে ব্যাপারগুলো খেয়াল রাখবেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলো পড়তে ভালোবাসেন, যারা সেসময়ের সত্য ঘটনা জানতে আগ্রহী, তাদের জন্য নিঃসন্দেহে চমৎকার এক খোরাকই হবে বইটি।