বিফোর সানসেট: তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়

আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন—কতদিন আমিও তােমাকে
খুঁজি নাকো,—এক নক্ষত্রের নিচে তবু—একই আলাে পৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনাে পথের রেখা হ’য়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, 
হয় নাকি?” 

– জীবনানন্দ দাশ (দুজন)  

জেসে আর সেলিনের জীবন যেন জীবনানন্দ দাশের ‘দুজন’ কবিতার এই লাইনগুলোর মতোই হয়ে গেছে তখন। কথা ছিল ছয় মাস পর ভিয়েনাতে দেখা করবে তারা দুজন, কিন্তু নিয়তি সেই সুযোগ তাদের দেয়নি। ১৯৯৫ সালের ভিয়েনায় কাটানো সেই রাতের পর বহুদিন পার হয়ে গেছে। কতদিন হয়ে গেল কেউ কাউকে দেখেনি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনোকিছুই শাশ্বত নয়। মহাবিশ্বের নিয়ম এই যে একটা সময় পর সবকিছুই শেষ হয়ে যায়। বহুদিন হয়ে গেলে এমনকি নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয়। অনেকদিন হয়ে গেলে যেমন ক্ষয় হয়ে যায় পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা, তেমনি মুছে যায় প্রেম, হারিয়ে যায় অনুভূতিও।

সময় যদিও অনন্ত, তবু প্রেম যেন অনন্ত নিয়ে নয়; Image courtesy: Golden Age Cinema

কিন্তু স্মৃতি? সে তো মোছা যায় না। স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় কিছু মানুষকে সবসময়। সেসব স্মৃতি প্রেমকে মুছতে দেয় না, হারিয়ে যেতে দেয় না জীবন্ত অনুভূতিগুলোকে। জেসে ওয়ালেস আর সেলিনের সাথেও এমনটাই হয়েছে। দুজন দুই মহাদেশে থাকলেও তারা কেউই ভুলতে পারেনি ভিয়েনার সেই রাত। তাদের মাঝে রয়েছে আটলান্টিকের বিশাল দূরত্ব, কিন্তু তাদের মন যেন একত্রেই। একই নক্ষত্রের নিচে, একই পৃথিবীর পারে দুজনে থেকেও কেউ কাউকে দেখেনি বহুদিন তা সত্য। কিন্ত তারা কি কেউ কাউকে খোঁজেওনি? খুঁজেছে তো অবশ্যই, তবে সময় আর পরিস্থিতি তাদের একে অপরকে সামনাসামনি আসতে দেয়নি। তারা ছ’মাস পর ভিয়েনাতে দেখা করবে বলে কথা দিলেও সময় সেই ছ’মাসের অপেক্ষাকে নিয়ে গেছে নয় বছরে।  

ভিয়েনার সেই রাতের নয় বছর পরের কথা। জেসে ওয়ালেস তখন জনপ্রিয় লেখকে পরিণত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে তার বই ‘দিস টাইম’। বইটি যুক্তরাষ্ট্রে বেস্টসেলারের তকমাও পেয়ে গেছে ইতোমধ্যে। আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপেও তার বই বেশ জনপ্রিয় ততদিনে। ভিয়েনার সেই প্রণয়মূলক রাতের গল্প লিখেই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন জেসে ওয়ালেস। ভুলতে না পারা সেই রাতের গল্প লিখে সেলিনকে খুঁজার চেষ্টা করেছে জেসে। সেই বই সেলিনের কাছেও পৌঁছে গেছে ততদিনে। আসলে উপন্যাসটি জেসে সেলিনকে আবারও খুঁজে পাওয়ার আশায় অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিল। 

লেখক জেসে ওয়ালেস এক বুক-ট্যুরে প্যারিসে এসেছেন। প্যারিসের একটি বুকস্টোরে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন তিনি। তখন সেখানে এসে হাজির হয় সেলিন। নয় বছরের অপেক্ষার অবসান হলো অবশেষে। সেলিনের শহর প্যারিসে এসেই তাকে খুঁজে পেয়েছেন জেসে। যার স্মৃতি, যার জন্য অপেক্ষা আর যে আবেগ এতদিন খুঁড়ে খুঁড়ে খেয়েছে জেসেকে, সেই নারীকে এতদিন পর কাছে পেয়েছেন তিনি। কিন্তু আবারও সময় যেন তাদের দুজনকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় রত। কেননা, ঘন্টাখানেক পরই জেসের ফ্লাইট। তবে এবার এতকিছু না ভেবেই জেসে সেলিনের সাথে বেরিয়ে পড়েন প্যারিস ঘুরতে ঘুরতে গল্প করবেন বলে।  

তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়; Image courtesy: Letterboxd Limited

এই নয় বছরে অনেককিছুই বদলে গেছে। জীবন খুব অদ্ভুত, কতকিছু ঘটে গেছে ততোদিনে। আবার শুরু হয় তাদের গল্প। তাদের রসায়ন সেই আগের মতো জমে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। শুধু মাখোমাখো প্রেমালাপই প্রেম না। প্রেম তো তা-ই যেখানে বিপরীত মানুষটার সাথে মন খুলে কথা বলা যায় সবকিছু নিয়ে। তাদের প্রেমটা এমনই, দুজন মানুষ নির্দ্বিধায় বলতে থাকে জীবনের সব কথা। তাদের মধ্যে আবারও খোলামেলা কথাবার্তা শুরু হয়। নিজেদের চিন্তাভাবনা, দর্শন, জীবন, ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে বলতে প্যারিসের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকে তারা। 

তাদের মধ্যে খুব শীঘ্রই ব্যক্তিগত এবং গভীর কথোপকথন শুরু হয়। সেলিন তখন কথামতো ছয় মাস পর ভিয়েনায় দেখা করতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। সেলিন জানায় যে তার দাদী মারা যাওয়ায় সে তখন ভিয়েনাতে দেখা করতে যেতে পারেনি। কিন্তু জেসে কি সেদিন ভিয়েনায় গিয়েছিল? এই প্রশ্ন করতেই জেসে বলে যে সে-ও সেদিন যায়নি। এরপর সেলিন তাকে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে। জেসে তখন বাকরুদ্ধ। সে আসলে সেলিনকে মিথ্যে বলেছে। প্রকৃতপক্ষে সেই রাতের ছয় মাস পর ডিসেম্বরে জেসে তাদের কথামতো ঠিকই ভিয়েনায় গিয়েছিল। জেসে সেই কথা অবশেষে স্বীকার করে সেলিনের কাছে। সে তার কথা রেখেছিল। কিন্তু সেলিন পরিস্থিতির কারণে তার কথা রাখতে পারেনি। 

এই নয় বছরের ব্যবধানে তাদের জীবন কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা একে অপরকে বলতে শুরু করে তারা। জেসে তখন বিবাহিত এবং হ্যাঙ্ক নামে তার একটি ছেলেও আছে। জেসে জানায় যে, সময় আর পরিস্থিতির কারণে তাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। সে সবসময়ই সেলিনের কথা মনে করেছে, এমনকি বিয়ের সময়ও তাকে ভেবেছে সে। জেসের হৃদয়ে সেলিন সবসময়ই ছিল। এদিকে সেলিন তখন একজন পরিবেশবাদী হিসেবে কাজ করছে। সে বিয়ে না করলেও সম্পর্কে আছে একজন ফটো সাংবাদিকের সাথে। তারা কেউই নিজেদের জীবন নিয়ে খুশি নয়। জীবনের চরম হতাশাগুলো একে অপরের কাছে প্রকাশ করে তারা। ক্রমেই তাদের সেই পুরনো রোমান্টিক অনুভূতিগুলো, সেই মায়া, সেই প্রেম পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে।  

চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার; Image courtesy: film grimoire 

এরপর জেসে সেলিনের সাথে তার বাসায় যায়। জেসে জানতে পারে যে সেলিন খুব ভালো গান গায় এবং সে টুকটাক গান লেখে। শুধু জেসে নয়, সেলিনও তাদের একসঙ্গে কাটানো সেই রাতের স্মৃতি নিয়ে লিখেছে। জেসে উপন্যাস লিখলেও সেলিন লিখেছে গান। জেসের অনুরোধে সেই গান তাকে গেয়ে শোনায় সেলিন। সেই গানে জেসেকে নিয়ে সেলিনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ পেয়েছে। গানের মাধ্যমে সেলিন বুঝিয়ে দেয় যে সে জেসের কাছ থেকে অনেক দূরে থাকলেও তার হৃদয় জেসের কাছেই। সেই রাতের মতো আরো অন্তত একটি রাতের কামনা করে সে। সেসব স্মৃতির টানে তাদের প্রেম যেন আবারো উথলে ওঠে। তাদের জীবন আলাদাভাবে চললেও হৃদয় একে অপরের কাছেই ছিল। তাদের অবস্থা তেমন জীবনানন্দ তার ‘সুচেতনা’ কবিতায় যেমন বলেছিলেন, 

সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।

সময়ের ব্যাবধানে জীবন অনেক বদলে গেছে, পৃথিবী পাল্টে গেছে, সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেলেও হৃদয় আজও সেই মানুষের কাছেই রয়ে গেছে। সেই রাতের প্রণয়, সেই স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারেনি তাদের কেউ। একে অপরকে পুনরায় দেখার অদম্য ইচ্ছার কাছে সময় হার মেনেছে। সময় তাদের আবারও একত্রিত করেছে। এবার সিদ্ধান্ত তাদের সমগ্র জীবনটা তারা একসাথে কাটাতে চায় কিনা। জেসে কি তার ফ্লাইট ধরে চলে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে নাকি থেকে গিয়েছিল তার কাছে যাকে খুঁজেছে সে এত বছর ধরে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে দেখতে হবে বিফোর ট্রিলজির পরবর্তী সিনেমা ‘বিফোর মিডনাইট’।   

রিচার্ড লিংকলেটারের সাথে ইথান হক এবং জুলি ডেলপি মিলে এই সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। নয় বছর পরের ঘটনা অত্যন্ত দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তারা। একদম ন্যাচারাল অভিনয়ের মাধ্যমে গল্প জীবন্ত করে তুলেছেন ইথান হক আর জুলি ডেলপি।

This content is in Bangla language. This is the review of the 'Before Sunset' movie. Featured image is taken from Filmlab.

Related Articles

Exit mobile version