ত্রিপুরার রাজা ছিলেন বীরচন্দ্র মাণিক্য। ভালোবাসতেন ফটোগ্রাফি, কবিতা, গান, নাচ আর বহু পত্নী-উপপত্নী পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে। অসংখ্য পত্নী-উপপত্নীর মধ্যে ভানুমতী দেবীই ছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয়। ভানুমতী দেবীকে তাই তিনি বসিয়েছিলেন মহারানীর আসনে। অথচ তার উপরে অভিমান করেই একসময় ভানুমতী দেবী আত্মহত্যা করেন। হঠাৎ ভানুমতী দেবীকে হারিয়ে রাজা কাতর হয়ে পড়েন, রাজকার্য পরিচালনায় সব উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেন, হয়ে পড়েন জীবনবিমুখ। এমন সময় তার হাতে আসে কলকাতার এক উঠতি কবির একটি কাব্য। নাম ‘ভগ্ন হৃদয়’, লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
“অরুণালোকে খুলিয়া হৃদয় প্রাণ
এ পারে দাঁড়ায়ে, দেবি, গাহিনু যে শেষ গান
তোমারি মনের ছায় সে গান আশ্রয় চায়–
একটি নয়নজল তাহারে করিও দান।
আজিকে বিদায় তবে, আবার কি দেখা হবে–
পাইয়া স্নেহের আলো হৃদয় গাহিবে গান”
কাব্যটি পড়েই বীরচন্দ্র একটি স্বর্গীয় সান্ত্বনা অনুভব করেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে কাতর মন হঠাৎ প্রশান্ত হয়ে ওঠে।
যে কবির কবিতা রাজাকে এমন অপার্থিব প্রশান্তি এনে দিয়েছিল, সে কবিকে কোনো উপহার না পাঠিয়ে, সে কবির সাথে দেখা করার তাৎক্ষণিক মনোবাসনা ব্যক্ত না করে রাজা আর থাকতে পারছিলেন না। তাই রাজা তার সচিব রাধারমণ ঘোষকে দিয়ে দ্রুত কবিকে উপঢৌকন পাঠান, রবীন্দ্রনাথও তা সানন্দে গ্রহণ করেন। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে একটি মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের। রাজার মৃত্যুর পর তার পুত্র রাধাকিশোরের সাথেও রবীন্দ্রনাথের এ সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে ত্রিপুরার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতাও পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন নির্দ্বিধায়।
রবীন্দ্রনাথ আর সমসাময়িক ত্রিপুরার রাজপরিবারের এসব গল্প দিয়ে শুরু হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসের কাহিনী। দুই খণ্ডের এই উপন্যাসটি প্রায় ১২০০ পৃষ্ঠা জুড়ে বিস্তৃত। উপন্যাসটি লেখকের ‘সেই সময়’ উপন্যাসের সিকুয়েল। ‘সেই সময়’ উপন্যাসটি যখন শেষ হচ্ছিল, তখন ১৯০০ সাল আসন্ন। উপন্যাসটির শেষ পত্রে তাই নতুন শতাব্দীতে নতুন আলোর আগমনের আভাস ছিল। ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসটি যেন নতুন শতাব্দীর সেই নতুন আলোকে ধারণ করেই এগিয়েছে।
এ উপন্যাসে ত্রিপুরার রাজপরিবার থেকেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বের করে আনেন ‘ভরত’ নামক একটি কাল্পনিক চরিত্র। আর ভরতকে কেন্দ্র করেই সন্নিবেশিত হতে থাকে উপন্যাসের প্লট। প্লটের সাথে সাথে জুড়ে দেয়া হয় একেকটি ঐতিহাসিক চরিত্র। ভরত সময়ের প্রতিনিধি হয়ে ঘুরতে থাকে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তরে, ইতিহাসের দ্বারে দ্বারে। ভরতের পাশাপাশি উপন্যাসেটির গল্পের সাথে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর সংযোগ তৈরিতে কাজ করেছে ভূমিসুতা নামক আরেকটি নারী চরিত্রও। সময়ের অন্যায্য দাবির সাথে আপোসহীন ভূমিসুতা একসময় নয়নমণি নামে বিখ্যাত হয়ে আবার ভূমিতেই নেমে আসে, আবার ভূমিসূতা হয়ে উঠে। ভরত আর ভূমিসুতাই তাই হয়ে উঠেছে উপন্যাসের প্রধান নায়ক ও নায়িকা।
প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথের কবি হয়ে উঠার পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর ভূমিকা। রবীন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরী দেবীর ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তিনিই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের কাব্যলক্ষ্মী, তার কবি হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা। তাদের দু’জনের সম্পর্কের ইতিবৃত্ত এবং রবীন্দ্রনাথের বিবাহের অব্যবহিত পরেই কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার ঘটনা ‘প্রথম আলো উপন্যাসে’ গল্পচ্ছলে অসাধারণ নাটকীয়তায় ফুটে উঠেছে। মৃত্যুর পরও রবীন্দ্রনাথের কাব্যচেতনায় ছায়া হয়ে ছিলেন কাদম্বরী, ছায়া হয়ে ছিলেন প্রথম আলো উপন্যাস জুড়েও।
উপন্যাসটিতে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কাহিনী, স্ত্রী মৃণালিনীর সাথে তার সম্পর্ককের স্বরূপ। পরিপূর্ণ কবি হয়ে ওঠার পাশাপাশি একজন প্রেমিক, একজন স্বামী, একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ, সর্বোপরি একজন সমাজসেবক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নানামুখী চরিত্র উপন্যাসটিতে নিখুঁতভাবে অঙ্কিত হয়েছে; অঙ্কিত হয়েছে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পেছনে কবির শ্রম, ভালোবাসা আর ত্যাগের গল্প। ফুটে উঠেছে সেখানে একজন কবির ‘গুরুদেব’ হয়ে উঠার প্রেক্ষাপট।
উঠে এসেছে সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিবেকানন্দের ধর্মীয় পুনর্জাগরণ আন্দোলন, কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা থিয়েটারের উত্থান ও অন্তর্কোন্দলের নানা চিত্র।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটও উপন্যাসটিতে বিধৃত হয়েছে। উপন্যাসে বঙ্গভঙ্গ এবং স্বদেশী আন্দোলনকে লেখক কলকাতার তৎকালীন বাঙালি বাবুদের দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করেছেন। বঙ্গভঙ্গের পেছনে ব্রিটিশদের যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, তা যে পূর্ববাংলার মানুষের উন্নতির জন্য একটা সম্ভাবনাময় উদ্যোগ ছিল এবং পূর্ববাংলার অধিকাংশ বাঙালি একে সমর্থন করেছিল- এ ব্যাপারটি লেখক একেবারেই চেপে গেছেন। বরঞ্চ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে নেতৃত্ব দানকারী স্যার সলিমুল্লাহকে লেখক অনেকটা সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে মুসলমানদের সমর্থন দেওয়া নিয়ে লেখক বলেন,
“মুসলমানরা প্রায় সকলেই এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে রাতারাতি ইংরেজভক্ত হয়ে গেছে।”
অথচ সমসাময়িক ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে বঙ্গভঙ্গের মূল্যায়নটি ছিল এমন,
”তিনি (লর্ড কার্জন) বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা দিয়েছেন… আসাম, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী নিয়ে হবে পূর্ববঙ্গ। ঢাকা হবে রাজধানী আর চট্টগ্রাম হবে বিকল্প রাজধানী। ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। এতে ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজ ফুঁসে উঠে। বাংলা ভাগ করা যাবে না। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হবে এটিও হিন্দুসমাজ নিতে পারছিল না। পূর্ববাংলা হলো চাষার দেশ তারা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কী করবে।”
এই জায়গাটিতে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্যিকদের চিন্তার ব্যবধান ফুটে ওঠে।
প্রথম আলোর প্রায় পুরোটা জুড়ে রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দের বিচরণ মুখ্য হয়ে থাকলেও গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ক্ষুদিরাম বসু, মহাত্মা গান্ধী, জগদীশ চন্দ্র বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, সুরেন ব্যানার্জির মতো অসংখ্য ঐতিহাসিক চরিত্র উপন্যাসটির পাতায় পাতায় জীবন্ত হয়ে আছে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পক্ষে প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু আন্দোলনটি যখন ক্রমেই বিতর্কিত এবং সহিংস হয়ে ওঠে, তখন রবীন্দ্রনাথ এ আন্দোলন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। সুনীলও ঠিক এ জায়গাটি থেকে ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসটিকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা ভরত আর ভূমি ছিল পুরো উপন্যাসে বিচ্ছেদবেদনায় ভারাক্রান্ত। দীর্ঘ এক যুগ পর তাদের সামনে হাজির হয় মিলনের বহুল কাঙ্ক্ষিত রাত, কিন্তু সেটি আট-দশটি বাসর রাতের মতো প্রণয়-রোমাঞ্চে ভরপুর ছিল না। তবে কেমন ছিল সে রাত? বইয়ের ভাষায়,
“প্রথম রাত্রেই ভূমিসুতার অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। এই প্রথম সে একজন পুরুষের সাথে এক কক্ষে রাত্রিবাস করছে… এই রাত্রিই তো তার বাসর রাত। কিন্তু এ কেমন বাসর রাত? ফুল নেই, মালা নেই, চন্দনের সুবাস নেই। এমনকি মনের মানুষটি থেকেও নেই। সে ভূমিসুতার অস্তিত্বের কথাই জানে না। স্পর্শ টের পায় না। এ যেন বেহুলা-লখিন্দরের লৌহবাসরের মতন। এ যেন মিলন হয়েও মিলন থেকে বহুদূরে।”
তবুও একটি জায়গায় এসে তাদের সম্পর্ক সত্যিকারের মিলনাত্মক পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। তারপর,
“তারপর ওরা হাত ধরে চুপ করে বসে রইল। ঘাট ক্রমশ নির্জন হয়ে আসছে। বাতাস বইছে বেশ জোরে। বজরাগুলো ফিরে যাচ্ছে। সবাই ঘরে ফিরছে। এই দু’জনের যেন কোনো ঘর বাড়ি নেই, কোথাও ফিরতে হবে না। এরকম একটি অনন্তকালের দৃশ্য হয়ে ওরা বসেই থাকবে।”
এভাবেই শেষ হয় ‘প্রথম আলো’।