সময়টা ১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। জাপানিরা বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) দখল করে নেওয়ায় ভারতবর্ষে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজশক্তি কলকাতায় অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর জন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্য মজুদ করা শুরু করে। ফলশ্রুতিতে হঠাৎ করেই চালের মূল্য তরতর করে বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে বাজার থেকে চালই যেন অদৃশ্য হয়ে যায়।
অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, মানবসৃষ্ট সংকট থেকেই দেখা দেয় ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ। অনাহারে মরতে থাকে লাখে লাখে মানুষ। খেতে পাওয়ার আশায় গ্রাম ছেড়ে ছুটতে থাকে শহরে। সেই সময়ের ব্রিটিশ শাসকদের অবশ্য মানুষের এই করুণ মৃত্যু নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তারা বরং এ নিয়ে সতর্ক ছিল যে, কোনো পত্রিকায় যেন ‘দুর্ভিক্ষ’ শব্দটা উচ্চারিত না হয়। এদিকে কলকাতার রাস্তায় বাড়তে থাকে হাড্ডিসার মানুষের ভিড়। মৃত মানুষের গলিত শব খুবলে খেতে থাকে কাকের দল। না খেতে পেয়ে ভারতবর্ষে এই সময়ে প্রায় ৩৮ লাখ মানুষ মারা যায়। ১৭৭০ সালের পর ভয়াবহতম এই দুর্ভিক্ষটি বাংলা ১৩৫০ সালে ঘটায় এটি ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামেও পরিচিত।
ক্ষুধার তাড়নায় মানুষের এই করুণ মৃত্যুর সাক্ষী হিসেবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন তার উপন্যাস ‘অশনি সংকেত।’ এই উপন্যাসটি অবলম্বনে ১৯৭৩ সালে একই নামে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের রঙিন চলচ্চিত্র। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল তার ভয়াবহ চিত্র পরিচালক ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তার ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রে।
বাংলার শত শত গ্রামগুলোর একটি এই চলচ্চিত্রের নতুন গাঁ। সেখানে এক ব্রাহ্মণ পরিবারের জীবনে দুর্ভিক্ষ কীভাবে বিপর্যয় হিসেবে নেমে আসে তা এই চলচ্চিত্রের উপজীব্য বিষয়। মাত্র দুইজন সদস্য নিয়ে ব্রাহ্মণ গঙ্গাচরণের সংসার— সে এবং তার স্ত্রী অনঙ্গ বৌ। বেশ কিছু গ্রাম ঘুরে অবশেষে নতুন গাঁয়ে এসেছে গঙ্গাচরণ। সেকালে নিচুবর্ণের হিন্দুদের মাঝে একঘর ব্রাহ্মণ বাস করলে তাদেরকে যথেষ্ট সমাদর করত গাঁয়ের লোক। কাজেই উঁচু জাতে জন্মানোর সম্মানকে পুঁজি করে নতুন গাঁয়ে এসে বেশ সুবিধাজনক একটি অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয় গঙ্গাচরণ। পুজা অর্চনার পাশাপাশি পেশা হিসেবে বেছে নেয় কবিরাজি (চিকিৎসাবিদ্যা) এবং পাঠশালায় ছেলেদের পড়ানোর কাজ।
তৎকালীন হিন্দু সমাজে উঁচু জাতে জন্মানোকে পুঁজি করে নিচু জাতের মানুষকে শোষণ করার ঘৃণ্য প্রথা- ‘ব্রাহ্মণতন্ত্রে’র বিরুদ্ধে সচেতনভাবে ঘৃণা রচিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রে। ‘অশনি সংকেতে’র গঙ্গাচরণের মাঝেও ব্রাহ্মণ হওয়ার অহংবোধ থেকে সৃষ্ট সুবিধাবাদী মনোভাব প্রবল। স্ত্রী অনঙ্গ বৌয়ের সাথে তাকে পরামর্শ করতে শোনা যায়, উপার্জন করতে সবদিক দিয়ে গাঁয়ের লোককে কিভাবে বেঁধে ফেলা যায়। আবার চলার পথে সুযোগ পেলেই সে কারো কাছে সরিষার তেল, কারো কাছে এক ভাঁড় রস চেয়ে বসে। অন্যদিকে অনঙ্গ বৌও যেন স্বামীর এই শোষণকামী- সুবিধাবাদী মনোভাবকে মেনে নেয়। তবে ব্রাহ্মনের স্ত্রী হওয়া নিয়ে তার মাঝে কোন অহংবোধ নেই। গ্রামের সব মেয়েদের সাথে সে বরং সমান ভালবাসা নিয়ে মেশে।
সব মিলিয়ে গ্রাম বাংলার সহজ, সরল এবং প্রাচুর্যপূর্ণ রূপটি চলচ্চিত্রের শুরুতেই আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিন দূর গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে করে নতুন গাঁয়ে ফেরার পথে গঙ্গাচরণ পথিমধ্যে আরেক দরিদ্র ব্রাহ্মণ দীনু ভটচাযের কাছে জানতে পারে চালের অভাবের কথা। প্রকৃতপক্ষে মাঠভরা ফসল রয়েছে, আবার কোন প্রাকৃতির দুর্যোগ ছাড়াই হঠাৎ যে চালের এমন অভাব দেখা দিতে পারে তা ছিল গ্রামের অজ্ঞ জনসাধারণের কল্পনার বাইরে। এরপর কয়েকদিনের মাঝেই দুর্ভিক্ষের লক্ষণ স্পষ্ট হওয়া শুরু করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা অক্ষশক্তি- মিত্রশক্তি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না রেখেও গ্রামের সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করে এক ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মানুষ ভাতের বদলে শাক- লতাপাতা, খোলস ভেঙে শামুক খেতে শুরু করে। সম্প্রীতির সহজ সম্পর্কগুলোতে চিড় ধরতে থাকে, বাড়তে থাকে অস্থিরতা। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ দিকগুলোকে খণ্ড খণ্ড চিত্রে ‘অশনি সংকেতে’ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন সত্যজিৎ রায়।
ব্রাহ্মণ হিসেবে যে সুবিধা এবং সম্মানকে রীতিমত নিজের অধিকার বলে বিবেচনা করতো গঙ্গাচরণ, দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতায় তার সেই সম্মানজনক অবস্থায়ও ফাটল ধরে। স্ত্রী অনঙ্গ বৌয়ের ধান ভাঙার প্রশ্নে আত্মমর্যাদাবোধের যে মিথ্যা জালে সে আটকা পড়তো, তাও ছিঁড়ে যায়। চলচ্চিত্রকার আমাদেরকে দেখান, অবস্থাপন্ন গৃহস্থের চাল লুকিয়ে মজুদ করার প্রবণতা। আরও দেখান ক্ষুধার তাড়নায় কাপালীদের ছোট বউ ‘ছোটি’ কীভাবে চালের জন্য কামাতুর পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
দুর্ভিক্ষের রূপটি আরও বেশি স্পষ্ট হয় যখন বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে অনঙ্গ বৌয়ের কাছে এসে হাজির হয় তার পূর্বপরিচিত মতি নামের একটি নিম্ন বর্ণের মেয়ে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে গ্রামের একটি বটগাছের নিচে সে পড়ে থাকে। খবর পেয়ে অনঙ্গ বৌ সেখানে গেলে মাছ দিয়ে দু’টো ভাত খাওয়ার আবদার জানায় সে। অনঙ্গ বৌ তাকে দু’টো ভাত এনে দিলেও ভাত খাওয়ার মত শক্তি সে আর অর্জন করতে পারে না। মৃত মতির লাশ পড়ে থাকে বটতলায়। ঝোপের আড়াল থেকে আরেক ক্ষুধার্ত কিশোরী এসে মতির মুখের সামনের খাবারটা নিয়ে পালিয়ে যায়।
এই সময়ে আমরা গঙ্গাচরণকে একটি মানবিক চরিত্ররূপে আবিষ্কার করি। নিম্নবর্ণের হওয়া সত্ত্বেও মতির সৎকারের ব্যবস্থা করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকে সে। এদিকে ক্ষুধা নিরসনের আশায় পরপুরুষের সাথে শহরে পালিয়ে যাওয়ার আগে কাপালিদের ছোট বৌ অনঙ্গ বৌয়ের সাথে দেখা করে বলে,
“আশীর্বাদ করো, বামুনদিদি, যেন নরকে গিয়েও দু’টো খেতে পাই।”
ক্ষুধার সাথে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের দ্বন্দ্বের একটি চিত্র আমাদেরকে দেখান পরিচালক, যেখানে জয় ঘটে ক্ষুধার। একই সময়ে সন্তান সন্ততিসহ বিশাল পরিবার নিয়ে দীনু ভটচাযকে তার বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে দেখেও ভড়কে যায় না গঙ্গাচরণ। এখন কি হবে, অনঙ্গ বৌয়ের এমন প্রশ্নে বরং শান্তস্বরে সে বলে,
“কি আর হবে! দুইজনের জায়গায় দশজন হবে।”
গর্ভে সন্তানধারণ করার কথা স্বামীকে প্রথমবারের মত জানিয়ে অনঙ্গ বৌ তখন লাজুকস্বরে বলে, “এগারজন।” অর্থাৎ এই ভয়ংকর দুঃসময়কে সামলে উঠতে লড়াই করার শক্তি এবং মনোবলও যে তাদের মাঝে আছে, তা দর্শকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘অশনি সংকেতে’র প্রধান চরিত্রগুলো নিখুঁত অভিনয় করলেও চলচ্চিত্রকার তাদেরকে ব্যবহার করে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ রূপ এবং ক্ষুধার যন্ত্রণা হয়তো বা আরও বেশি স্পষ্ট করে তুলতে পারতেন। দুর্ভিক্ষের রূপায়ণ থাকলেও এর করুণতম দৃশ্যগুলো এই চলচ্চিত্রটিতে যেন অদেখা রয়ে যায়। হাড্ডিসার মানুষ দেখানোর চেয়ে পরিচালক বরং দেখাতে চেয়েছেন দুর্ভিক্ষজনিত মানসিক সংকটের দিকগুলোকে। এছাড়া ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষের এই ভয়াবহ দুঃসময়ে যে নিস্পৃহ ভূমিকা পালন করেছিল, তাও সুকৌশলে ফুটিয়ে তুললে চলচ্চিত্রটি আরও বেশি পূর্ণতা পেত।
চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ছিলেন একজন আশাবাদী স্রষ্টা। এই চলচ্চিত্রের শেষেও তিনি আশাবাদের বীজ বপন করেছেন। দীনু ভটচাযের সন্তান সন্ততিসহ বিশাল পরিবারকে গ্রহণ করে গঙ্গাচরণের একসাথে লড়াই করার মানসিক দৃঢ়তা এবং অনঙ্গ বৌয়ের এই দুর্দিনে সন্তান ধারণ করার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ চলচ্চিত্রকারের এই আশাবাদী মনোভাবেরই পরিচায়ক।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসটির কাহিনিকে পুরোপুরি অনুসরণ না করে এ চলচ্চিত্রের গল্পটি বরং নিজের মত করেই সৃষ্টি করেছেন সত্যজিৎ রায়। এই চলচ্চিত্রের প্রধান দু’টি চরিত্র- গঙ্গাচরণের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অনঙ্গ বৌয়ের ভূমিকায় বাংলাদেশি অভিনেত্রী ববিতা অভিনয় করেন। ১৯৭৩ সালে বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কার লাভ করে ‘অশনি সংকেত।’ এছাড়া বাংলা ভাষায় নির্মিত ‘শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র’ এবং ‘শ্রেষ্ঠ আবহসঙ্গীতে’র জন্য একই বছরে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে চলচ্চিত্রটি।
দুর্ভিক্ষের করুণ রূপটি ধারণ করে ‘অশনি সংকেত’ সত্যজিৎ রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। এছাড়াও কৃত্রিম খাদ্যাভাব এবং দুর্মূল্যের বাজারে দরিদ্রশ্রেণির টিকে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা বা অসৎ ব্যবসায়ীর খাদ্য মজুদ করার হীন মনোভাবের সাথে চলচ্চিত্রটি বর্তমান সময়ে এসেও অতি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক।