ব্ল্যাক কমেডি ধাঁচের ‘ওয়াইল্ড টেলস’ নামক অ্যান্থোলজি ফিল্মটি নির্মাণ করেন আর্জেন্টিনার বিখ্যাত টিভি সিরিজ নির্মাতা দামিয়ান জিফ্রন। ছয়টি গল্প নিয়ে তৈরি এই অ্যান্থোলজির সবগুলো গল্প পরিচালকের নিজের লেখা। প্রতিটি গল্পের পরিপ্রেক্ষিত আলাদা হলেও তার একটি কমন থিম আছে- প্রতিশোধ আর সহিংসতা।
আর্জেন্টিনার আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, কর্পোরেশন বা সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা, বিচারহীনতার কারণে প্রতিশোধপরায়ণতা বৃদ্ধি, ক্রোধ ইত্যাদি বিষয় খুবই বাস্তবিকভাবে নির্মাতা ফুটিয়ে তুলেছেন। বলা হয়ে থাকে, আর্জেন্টাইন সিনেমার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন জিফ্রন নির্মিত এই অ্যান্থোলজি। ফেস্টিভ্যাল সার্কিট থেকে শুরু করে সমালোচক মহলেও এটি বেশ সুনাম কুড়ায় এবং ব্যবসাসফলও বটে। দারুণ সব সিনেমাটগ্রাফি, সাবলীল ন্যারেটিভ এবং সাউন্ড ডিজাইন সবকিছু মিলিয়ে এটি ছিল যথাযথ।
পাতারনাক
মডেল ম্যারিয়া ম্যারুল প্লেনে তার পাশের সিটে বসা অপরিচিত এক মিউজিক ক্রিটিকের সাথে আলাপচারিতায় মেতে ওঠে। কথায় কথায় তারা একটি বিষয়ে মিল খুঁজে পায়- তারা দুজনেই গ্যাব্রিয়েল পাতারনাকের পরিচিত। মডেল ম্যারিয়া হলো পাতারনাকের প্রাক্তন প্রেমিকা। অন্যদিকে এই মিউজিক ক্রিটিকের সাথে বছরখানেক আগে পাতারনাকের ঝামেলা বাঁধে। দুজনের আলাপ শুনে সামনের সিটে বসে থাকা ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে পাতারনাকের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দেন। পরবর্তীতে তারা একে একে সবাই বুঝতে শুরু করে যে, এই প্লেনে উপস্থিত সব যাত্রী কোনো না কোনোভাবে গ্যাব্রিয়েল পাতারনাকের পূর্ব-পরিচিত।
এদের মধ্যে পাতারনাকের সাইকিয়াট্রিস্ট ভিক্টর, তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা দোকানের এক ম্যানেজার, বাল্যকালে পাতারনাককে নিয়ে হাসি-তামাশা করা সহপাঠী এবং পাতারনাকের একমাত্র বন্ধুও উপস্থিত। যে কিনা পাতারনাকের প্রাক্তন প্রেমিকার সাথেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। কেউই নিজেরা প্লেনের টিকেট কাটেনি। তারা তাদের নিজেদের কাজের জায়গা, কোম্পানি বা এজেন্সির কাছ থেকে টিকেট পেয়েছে। উপস্থিত সকলের মধ্যে এক সাধারণ সংযোগ হলো, এদের প্রত্যেকের উপরেই পাতারনাক কোনো না কোনো কারণে ক্ষিপ্ত।
পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যাকে নিয়ে এত আলোচনা, ঐ ‘পাতারনাক’ কোথায়? উপস্থিত সবাইকে চমকে দিয়ে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট ভয়ার্ত কণ্ঠে সকলকে জানায়,
“গ্যাব্রিয়েল পাতারনাক এই ফ্লাইটেরই কেবিন চিফ হিসেবে নিয়োজিত এবং সে এখন পাইলটের ককপিটে অবস্থান করছে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিয়ে।”
একথা শুনে ভয়ে সকলের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার উপায়। প্লেন উড়িয়ে গ্যাব্রিয়েল পাতারনাক তা নিয়ে যেতে থাকে এক ঠিকানায়। কী হতে পারে এই ঠিকানা? শেষ অংশের এই টুইস্টে সকলে রোমাঞ্চিত হতে বাধ্য।
অ্যান্থোলজির প্রথম এই গল্পটি প্রায় নয় মিনিটের হলেও তাতে দৃশ্যপটে একবারের জন্যও দেখা যায়নি গ্যাব্রিয়াল পাতারনাককে।
দ্য র্যাটস
রাতে বৃষ্টির কারণে হাইওয়ের পাশের রেস্তোরাটি একদম ফাঁকা। শুধু এক তরুণী ওয়েট্রেস ও তার সহকর্মী ছাড়া তৃতীয় আর কেউ নেই। এমন সময় আগমন ঘটে এক ব্যক্তির। ওয়েট্রেস তাকে চিনতে পারে। এই ব্যক্তির জন্যই নিজের বাড়ি হারিয়ে তরুণীর বাবা আত্মহত্যা করে। বাবার শেষকৃত্যের দুই সপ্তাহ পর ব্যক্তিটি তার মাকেও উত্ত্যক্ত করে; ফলে ঐ শহর ছেড়ে তাদের চলে আসতে হয়। ওয়েট্রেসের মুখ থেকে এই ঘটনা শুনে সহকর্মী পরামর্শ দেয়, লোকটির খাবারে ইঁদুরের বিষ মিশিয়ে দিতে। ওয়েট্রেস ভয় পেয়ে যায়, বিষ মেশাতে রাজি হয় না সে। সহকর্মী স্বপক্ষে যুক্তি দিয়ে বলে,
“সমাজের অমানুষগুলোকে শাস্তি দিতে কাউকে না কাউকে আত্মত্যাগ করতেই হবে এবং এর জন্য গর্বিত হওয়া উচিত।”
পরিচালকের চমৎকার ন্যারেটিভের কারণে গল্পের এন্ডিং আগে থেকে আঁচ করা কঠিন হয়ে পড়ে দর্শকদের জন্য।
দ্য স্ট্রংগেস্ট
জনমানবহীন কান্ট্রি রোড দিয়ে বেশ দামি একটি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে দিয়েগো। সামনে থাকা নড়বড়ে, পুরনো টাইপের অন্য একটি গাড়িকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলেও গাড়িটি তাকে সাইড না দিয়ে অযাচিতভাবে রাস্তার এপাশ-ওপাশ করতে থাকে। পুরনো গাড়িটি যখন সাইড দেয়, তখন দিয়েগো গাড়ির উইন্ডো গ্লাস নামিয়ে ঐ গাড়ির চালককে বেশ গালিগালাজ করে। দিয়েগো গাড়ি নিয়ে তাকে বেশ পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বিপত্তি বাধে, যখন দিয়েগোর গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে যায়। দুজনের মানসিক ক্রোধ পরিণতি পায় হিংস্রতায়।
শ্রেণি-বৈষম্য বা উচ্চস্তরের লোকদের থেকে নিম্ন স্তরের লোকেরা অবজ্ঞা পাওয়ার ফলে যে ঘৃণা তৈরি হয়, তার চূড়ান্ত রূপ এই গল্পে প্রকাশ পায়। দর্শকদের অ্যাড্রেনালিন রাশের জন্য এই গল্পের শেষ দিকটি ছিল টপ নচ।
লিটল বম্ব
দিনটি ছিল সিমনের মেয়ের জন্মদিন। অফিস থেকে ফেরার সময় বার্থডে কেক কিনে দোকান থেকে বের হয়ে দেখে, তার গাড়িটি নেই। পার্কিং জোনে গাড়ি রাখা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ সিমনের গাড়ি তুলে নিয়ে যায়। পরিশোধ করতে হয় একগাদা টাকা। কর্তৃপক্ষ তার কোনো কথা শুনতেই রাজি নয়। সে সময়মতো যেতে পারে না মেয়ের জন্মদিনে। উপরি পাওনা হিসেবে জোটে স্ত্রীর ডিভোর্স।
গাড়ি তুলে নেওয়ার কৈফিয়ত চাইতে সরকারি অফিসে গেলে কর্মীদের খারাপ ব্যবহারে বাধে তাদের সাথে ঝগড়া। পরিণতি হয় জেল। জেল থেকে বের হয়ে শোনে, সে এরই মধ্যে চাকরি থেকে বরখাস্ত। পরে আবার তুলে নিয়ে যায় তার গাড়ি। তবে এবার এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে সিমন কোনো প্রতিবাদ করে না। তার হয়ে প্রতিবাদ করে ডিনামাইট। কারণ সিমন যে এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট!
দ্য প্রপোজাল
ধনী লোকের ছেলে সান্তিয়াগো। ভোরে ডাউনটাউনের বার থেকে ফেরার সময় গাড়ি চাপা দেয় এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে। গাড়ি না থামিয়ে সে চলে আসে বাসায়। সংবাদমাধ্যমে আসে নারীর মৃত্যুর খবর। ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে তার বাবা। দুর্বলতা থেকে ফায়দা লুটতে শুরু করে নিজের আইনজীবী, বাগানের মালি ও সরকারি আইনজীবী পর্যন্ত। পরিস্থিতির শিকার ও লোভ মানুষকে কোথায় টেনে নিয়ে যেতে পারে, এই গল্প তার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
ওপেন এন্ডিং এই গল্পে দর্শক নিজের মতো করে ব্যাখা দিতে পারবে।
টিল ডেথ ডু আস পার্ট
রমিনা তার বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালে বুঝতে পারে তার স্বামীর সাথে এক মেয়ের শারীরিক সম্পর্ক ছিল, যে কিনা তার স্বামীর সহকর্মী। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সেই সহকর্মী এই অনুষ্ঠানেও উপস্থিত। প্রতিশোধ নিতে বেপরোয়া হয় রমিনা। তারপর জল গড়ায় আরো বহুদূর। অন্য পাঁচটি গল্পের মতো এর শেষও ছিল অপ্রত্যাশিত।
বাফটা পুরস্কারজয়ী এই ফিল্মের আইএমডিবি রেটিং ৮.১। তাছাড়া অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে পায় সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন। আর্জেন্টিনার অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমার তালিকায় এর অবস্থান একদম উপরের দিকে। অ্যান্থোলজির পরিপূর্ণ স্বাদ আস্বাদন করতে হলে একে সিনেমা দেখার তালিকায় উপরের দিকে রাখাই যায়।