Applause and tears stirred into a bizarre cocktail.
যদিও এ সমন্বয় আপেক্ষিক বলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। সংশয়, উৎকণ্ঠায় সেমিকোলনে বিরাম নেয়া স্থরিবতার গল্পে সিনেমা বানিয়েছেন পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য্য। সে সিনেমায় চারজন মানুষ এক অনিবার্য পরিণতিরর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। তাদের প্রতীক্ষা দীর্ঘায়িত হয়ে বাড়ছে অস্বস্তি। প্রাগমেটিক হবার তাড়নার কথা শোনা যাচ্ছে অনবরত, কিন্তু এমন অপ্রত্যাশিত রূঢ় বাস্তবতাকে আমাদের সহজাত আবেগ, বিবেক, অনুভূতি এত সহজে মেনে নিতে সায় দেয় না। ইন্দ্রাশিস কেমন যেন বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছেন বাস্তবতার সাথে মানবিক সম্পর্কের। যে সম্পর্ক শতবার চাইলেও ছিন্ন করা যায় না। আবার এমন চাওয়াও ঘোরতর অন্যায় মনে হয়। এতদসত্ত্বে, নিষ্ঠুর বাস্তবতা উপেক্ষা করে স্বস্তি উপভোগের জন্য কখনো কখনো বিকল্পও থাকে না।
মুভির গল্প তার অবশ্যম্ভাবী পরিণামের পথে কাকা ভাইপোর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম লজিক-কাউন্টার লজিক বরাবরই জাহির রেখে সিদ্ধান্ত নেবার সংকটকে জটিল থেকে করেছে জটিলতর। আবেগ-ভালবাসার সাথে যুক্তিবিজ্ঞানের বৈসাদৃশ্য দেখিয়ে শেষপর্যন্ত পিউপার চিত্রনাট্যে আসলে খুন না মার্সিকিলিং সেই টানাপোড়েনকে জিইয়ে রাখতে চেয়েছে। ফলে পিউপার প্রতিটি মুহূর্ত, সম্পর্কের আবেগ-অনুভূতি-ভালবাসাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। একদিকে মনুষ্যত্ব, অন্যদিকে যৌক্তিক ভাবনাকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন নির্মাতা। সিদ্ধান্তহীনতায় মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের সংকট এই গল্পের প্রধান চালিকাশক্তি। সেখানে কোনো বাস্তবতাকে তুচ্ছ করে দেখার সুযোগ নেই। পরিস্থিতির দাবি মেটাতে অপেক্ষাকৃত শ্রেয়তর বাস্তবতা নির্বাচন সেখানে মুখ্য। ফলে অপরাপর সত্যকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তখন অস্বীকার করতে হয়। সময়ের স্রোতে জীবনের বাঁকে হারাতে হয় অনেক অমূল্য রতন। তারপরেও থেমে থাকার উপায় নেই। আধুনিক পৃথিবীর গতিশীলতায় এ হারানোর মধ্য দিয়েই সমৃদ্ধির পথে ধাবিত হতে হয়।
অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শুভ্র তার মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে দেশে আসে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে যখন তার দেশ ছাড়ার দিনক্ষণ ঠিক হয়, তখনই ঘটে নতুন এক অঘটন। শুভ্রর বাবা সজল সেরেব্রাল অ্যাটাকে কোমায় চলে যান। ডাক্তার বলেন- লাইফ সাপোর্টে হয়তো তিনি সর্বোচ্চ বাঁচবেন দিন পনের। মানুষের মৃত্যুতে সব নিঃশেষ হয়ে যায়। কিছুদিন পর হারানোর শোকও কেটে যায়। কিন্তু এমন অসাড় অবস্থায় জীবন থমকে যায়। বাবার আসন্ন মৃত্যু আসি আসি করে আর আসে না, ক্রমশই প্রলম্বিত হতে থাকে অপেক্ষার প্রহর। অন্যদিকে বাড়ির বড় মেয়ে মৌ, বাবার অসুস্থতায় পাশে থাকতে চাইলেও পেরে ওঠে না। এদিকে শুভ্রর নির্ধারিত ছুটি শেষ, তাই ওকেও ফিরতে হবে আপন কর্মক্ষেত্রে। যেখানে সামনে তার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের হাতছানি। শুভ্রর কাকু রজতও দেশের বাইরের কনফারেন্স নিয়ে বের হবেন অল্প কিছুদিনের মধ্যে। বাঙালি পারিবারিক মূল্যবোধ অনুসারে নিউক্লিয়াস পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই অরবিটে বাঁধা! এমতাবস্থায় পারিবারিক বন্ধনে পরস্পরে বাঁধা জীবন থমকে গিয়ে তাতে নেমে আসে স্থবিরতা। পিউপার এ সচেতন স্থবির অস্থিরতা ছুঁয়ে যায় দর্শক অব্দি। সিনেমার নামকরণের কী দারুণ সার্থকতা নিহিত এখানে! এর মধ্যেই বিধৃত হয় সায়েন্স, ক্রিমিনোলজি ও সাইকোলজির সমবেত দর্শন। শুভ্রর কাকু প্রফেসর রজত এমন এক বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, যেখানে মানুষের মুখাবয়ব এবং মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে বলে দেয়া যাবে সেই মানুষের অভিপ্রায়।
রজত বার বার তার ভাইপো শুভ্রকে বাস্তবিক হতে বললেও শুভ্র আবেগের মোহে আবিষ্ট বাঙালি সন্তান। পারিবারিক বন্ধন আর বাবার প্রতি ভালবাসা ও দায়িত্ব উপেক্ষা করে বাবাকে এই অবস্থায় রেখে বিদেশ ফিরতে সে নারাজ। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় আবেগ পরিত্যাগ করে অমানবিক সত্যের পক্ষে রজত যুক্তি দিয়ে বলে, “No, you don’t have to agree. But the counter argument must be logical.” বিপরীতে, মায়ের মৃত্যুর পর শুভ্র যেভাবে নিজের ঘরের বেডকে বাবার ঘরমুখো ঘুরিয়ে দেয়, তা বিনাবাক্যেই কত কী বলে দেয়! বলে দেয় একাকী বাবাকে দেখভাল করার জন্য ছেলের সদিচ্ছার কথা। পাশ্চাত্যের জীবনযাপনেও নিজেকে খুব একটা বদলে অনুভূতিহীন করতে পারেননি নিজেকে। বৃদ্ধ বাবার প্রতি ছেলের দায়িত্ব দারুণ এক দৃশ্যে দেখিয়ে দিলেন নির্মাতা। সত্যিই ইন্দ্রাশিস পারেনও বটে!
পরিচালকের সিনেমাটিক ফর্মের মুন্সিয়ানার সাথে তপন শেঠের শিল্প নির্দেশনা সামগ্রিকভাবে বাড়িটিকে যে শৈল্পিকতা ও চরিত্রগুলোর সামাজিক অবস্থানের যে বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েছে তা প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে চিত্রগ্রাহক শান্তনুর ক্যামেরা বাঙ্ময়। স্থবিরতাকে তিনি ধরেছেন বিভিন্ন এঙ্গেলে। কিছু শট এত দুর্দান্ত আর চোখধাঁধানো, যেন তা পিউপা নামের সাথে সংগতি রেখে ক্যামেরাকেও খানিক সময়ের জন্য স্থবির করে দিয়েছে। শুভ্র যখন তার বাবাকে দরজাবন্ধ ঘরে আবিষ্কার করে, সেই শটে ক্যামেরা একবার তার কম্পোজিশন ধরেই স্থির। তাই ওপাশে ছড়ানো উদ্বেগ, অস্থিরতা, দরজা ভাঙা এসব আমরা সেই স্থির ক্যামেরায় দেখতে পাই না। কিন্তু আমরা অদেখা ম্যাজিকাল কম্পোজিশনেই বুঝে ফেলি সেখানে কী ঘটছে। এই একই কায়দায় শান্তনু আরও কয়েকবার ফ্রেম ধরেছেন, যার নান্দনিকতা দর্শকচোখে বেশ উপভোগ করেছি। মূলত, মলয় সাহার সম্পাদনায় শান্তনুর কম্পোজিশন জ্যামিতিক মাপে আরও স্ট্রেইট লাইনে রেন্ডার হয়েছে। জয় সরকার এবং অনির্বাণ সেনগুপ্ত তাদের শব্দ ও সঙ্গীতের কারিশমায় সিনেমার গুমোট ভাব, সংকট, ও সংশয়কে আরও গভীরে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। সেই সাথে বিথোভেনের পঞ্চম সিম্ফোনির ব্যবহার পিউপায় যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। কালার ইফেক্টসের সাহচর্যে অরিন্ধম দে পিউপার সচেতন স্থবিরতাকে করেছে আরও প্রকাশ্য। বিশেষ করে, নীল পাহাড় যেভাবে টিলের আভায় মোহনীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায় এই ছবির কালার দুর্দান্ত হয়েছে।
সর্বোপরি, এ সিনেমা তার দ্বন্দ্বকে যেভাবে উপস্থাপন করেছে তাতে বিদগ্ধ ইন্দ্রাশিসের দেখার চোখ আছে সে কথা স্বীকার করতে হবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শুভ্রর ইংরেজি বলার ধরন, এবং শব্দের সীমাবদ্ধতা শ্রুতিকটু লাগে। বাদবাকি সব ডিটেইলিংই দারুণ অস্বস্তি নিয়ে উপভোগ করার মতো। প্রেমিকা বর্ষাকে হারানোর শঙ্কা থেকে ওর উপর শুভ্রর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাওয়া, এবং পরক্ষণে হুঁশ ফিরে পেয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার দৃশ্য কেবল দুজনের সম্পর্কের দূরত্বর জন্য আক্ষেপই বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, ভাইকে ‘জ্যান্ত মৃত’ অবস্থায় বেঁচে থাকতে দেখে রজতের আফসোস, এবং অন্যান্য বাস্তবতার মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে ‘প্রায়োরিটি’কে প্রায়োরিটি দেবার যে দর্শন নির্মাতা দেখিয়েছেন, তা ভাবোদয় সৃষ্টিতে সহায়ক। ভিন্ন ভিন্ন কতগুলো মানুষকে পারিবারিক সম্পর্কে আবদ্ধ করে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশের গল্প পিউপা। ব্যক্তিগতভাবে পিউপার অমানবিক পরিসমাপ্তি আমাকে প্রবলভাবে আহত করলেও, এমন পরিণতি ইন্দ্রাশিসের মার্সিকিলিংকে যুৎসই জাস্টিফিকেশন দিচ্ছে বলেও মনে হয়েছে।