সারা বিশ্বে চলচ্চিত্র শিল্পমাধ্যম রূপে যতটা সার্বজনীন, অন্য কোনো শিল্পমাধ্যম ততটা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্বান সমাজে এখনো এমন কথা প্রচলিত আছে যে, চলচ্চিত্র কোনো গভীর বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম হতে পারে না। এটি কেবলই মানুষের চিত্তবিনোদনের একটি মাধ্যম বৈ আর কিছুই না। এমনকি, চলচ্চিত্রের হাত ধরে অপসংস্কৃতির একটা প্রসার হয় বলেও ধারণা প্রচলিত আছে। অথচ বিশ্বের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, বিংশ হোক আর একবিংশ শতাব্দী, চলচ্চিত্রই হচ্ছে সবচাইতে বলিষ্ঠতম প্রকাশমাধ্যম।
আমাদের এ উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার ছিলেন হীরালাল সেন। বাংলাদেশেই তার জন্ম হয়েছিল। বর্তমান ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ জেলায় জন্মেছিলেন এই গুণী। কিন্তু বিশ্বদরবার তো দূরেই থাক, ভারতবর্ষেও তার নাম কেউ খুব একটা উচ্চারণ করেনি। আর করলেও কেমন যেন একটা কুণ্ঠাবোধ রয়েই যায় সে উচ্চারণে। ভারত আর বাংলাদেশ নিতান্ত দায়সারাভাবে তার নাম মাঝে মধ্যে উচ্চারণ করে। অথচ উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে হীরালাল সেনের প্রাপ্তির ঝুলিটা অনেক বিশাল আর বিস্তৃতই হওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হয়নি। চলমান এই যুগে আমরা নিতান্তই ভুলে যাই সবকিছু। যেমন হীরালালের মতোই ভুলে বসে আছি ঢাকাই চলচ্চিত্রের এক সিনেমা নির্মাতাকে। তিনি ঢাকাই চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ ছিলেন। তার হাত ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রচার ও প্রসার হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার পেছনেও তার ছিল দারুণ অবদান। এ নির্মাতা উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষায় সিনেমা নির্মাণ করে দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে। তার হাত ধরে রঙিন দুনিয়ায় পদার্পণ করেছিলেন পরবর্তী চলচ্চিত্র জগতের রথী-মহারথীরা। আজকের আয়োজনটা সেই মহান নির্মাতাকে নিয়েই- যার ক্যারিয়ারে ব্যর্থতা বলতে আদতে কোনো শব্দ ছিল না।
এহতেশাম বা ক্যাপ্টেন এহতেশাম নামেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। পুরো নাম আবু নূর মুহাম্মদ এহতেশামুল হক। ১৯২৭ (মতান্তরে ১৯২৬) সালের ১২ অক্টোবর পুরান ঢাকার বংশালে তার জন্ম। তার পিতা মোহাম্মদ ইউসুফ, ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তার মায়ের নাম মোসাম্মৎ কানিজ ফাতেমা। জনপ্রিয় সিনেমা নির্মাতা মুস্তাফিজুল হক তার আপন ছোটভাই। চিত্রনায়ক ফয়সাল তার নাতি।
পুরান ঢাকার অলিগলিতেই কেটেছে তার শৈশব আর কৈশোর। প্রাথমিক পড়াশোনার পাট চুকিয়ে পাড়ি জমান দিল্লী আর করাচিতে, উচ্চশিক্ষার প্রত্যয়ে। পড়াশোনা শেষ হবার পর তিনি তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং সামরিক বাহিনীর এক রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন পদাধিকার পান। জানা যায়, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের সৈন্য হয়ে। পরে তিনি বদলি হয়ে চলে যান পাকিস্তানের করাচিতে।
করাচিতে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে। সে সময় পাকিস্তানি পরিচালক আশিক মল্লিকের ‘বাঘী’ সিনেমার শ্যুটিং চলছিল ধারেকাছেই। এহতেশাম খানিকটা উৎসুক হয়েই শ্যুটিং দেখতে যান। শ্যুটিং দেখেই বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। ধাপে ধাপে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়াটা তার মনটাকে বেশ দোলা দেয়। চলচ্চিত্র নামক এই বিশাল আর বিস্তৃত শিল্পমাধ্যমের সমুদ্রে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে যান এহতেশাম।
তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এই সামরিক জীবনের শৃঙ্খলিত যাপন তার দ্বারা আর সম্ভব নয়। পরিবর্তন চাই এবার। ১৯৪৬ সালে নাটোর, লালমনিরহাট এবং সান্তাহারে তিনটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেন নিজের উদ্যোগে। এরপর সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে এসে বনে যান চলচ্চিত্রের পরিবেশক ও প্রদর্শক। উর্দু আর হিন্দী ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র দেখানো শুরু করেন তিনি। ব্যবসায় নেমেই ব্যাপক সফলতার মুখ দেখেন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় ইচ্ছে জাগে চলচ্চিত্র প্রযোজনার। নিজেকে যেন সত্যিকার অর্থেই খুঁজে পান এহতেশাম। পাকিস্তানি এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি একজন সিনেমা নির্মাতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ঢাকার চলচ্চিত্র জগতের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একজন পরিচালক হিসেবেও মান্য করা হয় তাকে।
১৯৫০ সালে এহতেশাম প্রথম চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন একজন চলচ্চিত্র পরিবেশক হিসেবে। ১৯৫৬-৫৭ সালের দিকে তিনি ‘লিও ফিল্মস’ নামে একটি চলচ্চিত্র বিতরণ সংস্থা (ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) শুরু করেন। পরিচালক হিসেবে তার অভিষেক হয় ‘এই দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্র দিয়ে; যা ২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৫৯ সালে প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার হয়েছিল। জহির রায়হান এবং কামাল আহমেদ তার সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন এ সিনেমায়। পরবর্তী সময়ে এরা দু’জনই চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসের শুরুতে নির্মিত এই সিনেমা, তখনকার সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এমনকি ব্যাপক খ্যাতি আর পুরস্কারও নিয়ে এসেছিল চলচ্চিত্রটি।
এ সিনেমায় রোমান্টিক জুটি হিসেবে ছিলেন খান আতাউর রহমান এবং সুমিতা দেবী। মূলত এ সিনেমা দিয়েই রোমান্টিক জুটির ধারণাটা একধরনের ঐতিহ্যে পরিণত হয় ঢাকাই চলচ্চিত্র জগতে। বা বলা চলে, রোমান্টিক ধারার যুগে প্রবেশ করে ঢাকাই চলচ্চিত্র। এর মাধ্যমেই অভিষেক হয়েছিল সুভাষ দত্ত, শবনম এবং রহমানের। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র জগতে যাদের অবদান, এককথায় অনস্বীকার্য।
প্রথম চলচ্চিত্র ব্যবসায় সফল হবার পর এহতেশাম দ্বিতীয় সিনেমার কাজ শুরু করেন। পরের বছর ১৯৬০ সালে প্রকাশ পায় তার ‘রাজধানীর বুকে’ নামক সিনেমাটি। ব্যবসায়িক সফলতার পাশাপাশি এহতেশামের খ্যাতি এনে দেয় এ চলচ্চিত্র। সিনেমা এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, একটি গান মানুষের মুখে মুখে রটে যায়। এমনকি এখনো সেই গান মানুষের মনে আর মুখে রয়ে গেছে। গানটি ছিল-
তোমারে লেগেছে এত যে ভালো,
চাঁদ বুঝি তা জানে।
সেসময় একটা চল ছিল। অমুক নায়কের চলচ্চিত্র শুনলেই মানুষ অগ্রীম টিকেট কেটে নিতে চাইত। কিন্তু এহতেশাম এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তার প্রথম দু’টি সিনেমা দিয়ে যে, তার নাম শুনলেই দর্শকরা বিনা দ্বিধায় ছুটে আসতো। পূর্ব আর পশ্চিম, দুই পাকিস্তানে ব্যাপক দর্শকনন্দিত তার সিনেমা দু’টি। এরপর ষাটের দশকের প্রাক্কাল থেকেই একের পর এক ব্যবসাসফল আর দর্শকনন্দিত সব চলচ্চিত্র উপহার দিতে থাকেন তিনি। সেই সময়কার পাকিস্তানি পত্রিকা ‘ডন’-এ এক সাংবাদিক লিখেছিলেন,
সিনেমা বানানো শিখতে চাইলে যেতে হবে সিনেমার তীর্থস্থান ঢাকাতে।
‘হারানো দিন’ (১৯৬১), ‘চান্দা’ (১৯৬২- বাংলাদেশের প্রথম উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র), ‘নতুন সুর’ (১৯৬২), ‘তালাশ’ (১৯৬৩), ‘সাগর’ (১৯৬৫- ১৯৬৪ সালে জহির রায়হানের সংগ্রাম চলচ্চিত্রের পর এটিই ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় রঙিন চলচ্চিত্র), ‘চকোরি’ (১৯৬৭), ‘পীচঢালা পথ’ (১৯৬৮), ‘চাঁদ আর চাঁদনী’ (১৯৬৮), ‘পায়েল’ (১৯৬৮), ‘আনাড়ি’ (১৯৬৯), ‘দাগ’ (১৯৬৯), ‘দূরদেশ’ (১৯৮৩- বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান যৌথভাবে নির্মিত), ‘শক্তি’ (১৯৮৪), ‘চাঁদনী’ (১৯৯১), ‘চাঁদনী রাতে’ (১৯৯৩), ‘মৌমাছি’ (১৯৯৬) ইত্যাদি তার নির্মিত উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমা।
এহতেশাম প্রচুর প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে চলচ্চিত্র জগতের উন্নতিতে কাজ করে গেছেন। মনে হতে পারে, তখনকার দিনে তেমন কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। কিন্তু আসলে তখনই ছিল কঠিন প্রতিযোগিতার সময়। কেননা, তখন চলচ্চিত্র মাত্রই পরিচিত ছিল পাকিস্তানি বা ভারতীয় চলচ্চিত্র; বা সোজা কথায় উর্দু আর হিন্দী চলচ্চিত্রের জমানা ছিল সেটা। হ্যাঁ, বাংলাও ব্যাপক প্রচলিত ছিল, তবে সেটা ভারতীয় বাংলা। এসব চলচ্চিত্র এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, চলচ্চিত্র মানেই উর্দু, নয়তো হিন্দী, আর নয়তো ভারতীয় বাংলা- এটা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। এই প্রথা ভেঙে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন এহতেশাম।
এছাড়াও, তখন অভিনেতা আর অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রেও ধরাবাঁধা এক রীতি ছিল। যেমন- নায়কের চরিত্রে অভিনীত ব্যক্তি নায়কই হবে; তেমনি খলনায়ক চরিত্রের অভিনীত খলনায়কই হবে। কিন্তু, এসব প্রথায় বিশ্বাস না করে বরং নিজের মতো করে নতুন এক চলচ্চিত্র জগত তৈরি করেছিলেন এহতেশাম। রহমান তার প্রথম চলচ্চিত্রে অভিষেক করেছিলেন খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরের চলচ্চিত্রেই তাকে নায়কের চরিত্রে দেখা গেছে। চলচ্চিত্র জগতে এমনই নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন এহতেশাম।
তার নির্মিত ‘চকোরি’ (১৯৬৭) সিনেমায় আনু চরিত্রের জন্য তিনি একদমই অপরিচিত এক সঙ্গীতশিল্পীকে বেছে নেন, যার নাম নাদিম বেগ। এ চলচ্চিত্রের পর নাদিম বেগ বাংলা এবং উর্দু, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ- উভয় দেশের সিনেমা জগতের এক খ্যাতিমান তারকায় পরিণত হয়েছিলেন। পরে ১৯৬৯ সালে নাদিম বেগ এহতেশামের একমাত্র কন্যা ফারজানাকে বিয়ে করেছিলেন।
উর্দু ভাষায় নির্মিত তার চলচ্চিত্রগুলো যেমন ব্যবসাসফল ছিল, তেমনি ছিল দর্শকপ্রিয়। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও বাংলা ভাষায়ও তিনি একজন সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজের অবস্থান শক্ত রাখতে পেরেছিলেন। ১৯৮৩ সালে তার মুভি ‘দূরদেশ’ একযোগে তিনটি ভাষায় মুক্তি পায়। বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনার এ সিনেমায় অভিনয়শিল্পীরা ছিলেন শশী কাপুর, নাদিম বেগ, শর্মিলা ঠাকুর, ববিতা, রাজ বব্বর প্রমুখ।
১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশ, বাংলাদেশ। এহতেশাম সেই নবজাতক দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলাতেই চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে এমন একটা পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে ব্যাপক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিতেই ভালোবাসতেন এহতেশাম; আর তাই হয়তো ব্যর্থতা তাকে কখনো ছুঁতে পারেনি। মাঝে অনেকদিন বিরতি নিলেও ১৯৯০ সালে ‘চাঁদনী’ সিনেমাতে নতুন জুটি শাবনাজ আর নাঈমকে নিয়ে ফিরে আসেন তিনি প্রযোজক হিসেবে। নব্বই দশকেও বাংলা সিনেমা গৎবাঁধা নিয়মে ছিল বন্দী। সে সময়ে ত্রাণকর্তার রূপে নতুন জুটি নিয়ে আসেন এহতেশাম। প্রযোজকদের নতুন শিল্পীদের উপর অর্থ বিনিয়োগ বা লগ্নী করার সেই সাহসটা তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি।
অনেক নামীদামী অভিনেতা-অভিনেত্রী আবিষ্কারের কৃতিত্ব রয়েছে তার ঝুলিতে। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। বরং নিজের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি প্রতিভাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি জহির রায়হানের মতো পরিচালকও চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেছিল তারই হাত ধরে। এছাড়া, প্রযোজক ও পরিচালক মুস্তাফিজুল হক, আজিজুর রহমান, আইআর খান, কামাল আহমেদ, শিবলী সাদিকদের উত্থান হয়েছিল তার হাত ধরেই। শুধুই কি প্রযোজক আর পরিচালক? সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষ এবং শাহনাজ রহমতুল্লাহর মতো গায়িকাকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার সিনেমাতেই প্রথম নারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন ফেরদৌসী রহমান।
‘শাব’ একটি উর্দু শব্দ। যার অর্থ রাতের আলো। রাতের অন্ধকারে আলো যে মায়াজাল তৈরি করে, সেটা বিশেষ পছন্দের ছিল এহতেশামের কাছে। আর তাই, তার হাত ধরে আসা সকল নায়িকাদের নামটাও শুরু হয়েছিল এই শব্দ দিয়েই। আফরোজা সুলতানা রত্না থেকে শাবানা, ঝর্ণা বসাক থেকে শবনম, কাজী শারমিন নাহিদ নুপুর থেকে শাবনূর এবং শাবনাজ। এছাড়া, গোলাম মুস্তফা, আজিম রহমান, নাদিম বেগ, চিত্রা জহির, নাইম, খান জয়নুল, রাণী সরকার, সাদেক বাচ্চু, সাব্বির, শামস, মুনমুন এবং আরো অনেকেই চলচ্চিত্রে জগতে প্রবেশ করেছিলেন এহতেশামের কল্যাণেই। আর তাই হয়তো, ছোট থেকে বুড়ো- চলচ্চিত্র জগতের সবাইকে তাকে ‘দাদু’ বলে সম্বোধন করতো।
তার আরেকটি অগ্রণী প্রচেষ্টা ছিল পাকিস্তানের পূর্ব প্রদেশের রাজধানী তথা ঢাকাতে, রাষ্ট্র পরিচালিত ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের অধীনে ফিল্ম স্টুডিও এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রতিষ্ঠা করা। সে সুবাদেই গড়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র সমিতি (ইস্ট পাকিস্তান সিনেমাটিক সোসাইটি)। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এর নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)।
‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’ নামক একটি সিনেমা নির্মাণ করার ছিল তার। পাণ্ডুলিপির কাজও গুছিয়ে এনেছিলেন। চলচ্চিত্র জগত অপেক্ষায় ছিল এই গ্র্যান্ডমাস্টারের নতুন চমকের আশায়। কিন্তু ২০০২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতের ঘুমকে পরিপূর্ণতা দান করে চিরদিনের জন্য ঘুমের দেশে পাড়ি জমান এহতেশাম। তাই বলা হয়, তার শেষ ইচ্ছেটা আর পূরণ হলো না।
কিন্তু এই চলচ্চিত্র গুরুকে স্মরণে রাখেনি স্বয়ং চলচ্চিত্র জগতই। কেবল গুটিকয়েক কাছের মানুষরাই মনে রেখেছেন এই গুণী নির্মাতাকে। ক্যারিয়ারে কখনো ব্যর্থতা যাকে ছুঁতে পারেনি; তেমনই এক মানুষকে ভুলে বসে আছে চলচ্চিত্র জগতের প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠনই তার জন্ম কিংবা মৃত্যু দিবসেও জানায় না কোনো শ্রদ্ধা। উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হীরালাল দাসের মতোই ক্যাপ্টেন এহতেশাম নামটাও হয়তো একদিন মুছে যাবে মানুষের মন থেকে। কিন্তু আজীবন তিনি বেঁচে থাকবেন তার কাজে আর তার কাছের মানুষের ভালোবাসাতে।