১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর প্রান্তরে লর্ড ক্লাইভের বাহিনীর হাতে বিশ্বাসঘাতকতার দরুন পরাজিত হন। এই কাহিনী কম-বেশি সবার জানা। এর এক বছর আগে ১৭৫৬ সালের ২০ জুন নবাব ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করে ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করেন। তখন কলকাতার নাম বদলে নতুন নামকরণ করেন তার নানা আলীবর্দী খানের নামে আলিনগর।
না, আজ ইতিহাসের গল্প করতে এই লিখা লিখছি না, লেখাটি মূলত ‘আলিনগরের গোলকধাঁধা’ চলচ্চিত্র নিয়ে। এই আলিনগর, নবাবের নামকরণ করা সেই আলিনগর।
সায়ন্তন ঘোষাল পরিচালিত ‘আলিনগরের গোলকধাঁধা’ ছবিটি মুক্তি পায় ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল। সেই বছর পশ্চিমবঙ্গের বক্স অফিসে চুটিয়ে ব্যবসা করে। ছবির গল্প লিখেছেন সৌগত বসু। এটি পরিচালকের দ্বিতীয় ছবি। মূল চরিত্রে মঞ্চাভিনেতা অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়েরও ছবিতে প্রথম কাজ এটি। তবে ছবি দেখে মনেই হবে না কলাকুশলীরা নবীন। আর হ্যাঁ, এটি কোনো ঐতিহাসিক ছবিও নয়, পুরোপুরি গোয়েন্দা কাহিনীনির্ভর থ্রিলার চলচ্চিত্র। তবে রহস্যের ফাঁদ, রহস্য উন্মোচন সবই হয়েছে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে কেন্দ্র করে, সাথে এসেছে পুরোনো কলকাতার নানা অনুষঙ্গ।
ব্রিটিশরা কালিকট বন্দরের সাথে মিলিয়ে বাংলার এই বন্দর নগরীর নাম রাখে কলকাতা। যেমন করে কালিকট দিয়ে ভারতবর্ষের পাট, রেশম সস্তায় কিনে ইংল্যান্ডে পাঠাত, একই উদ্দেশ্যে কলকাতাকে ব্যবহার করতেই এই নামকরণ। নবাব এই সিন্ডিকেট ভাঙতে ফোর্ট উইলিয়াম যুদ্ধে জয়ের পর কলকাতার নাম বদলে রাখেন আলিনগর। পলাশীর যুদ্ধের আগে মীরজাফরের সাথে লর্ড ক্লাইভের চুক্তিতে স্পষ্ট লেখা ছিল আলিনগরের নাম কলকাতা ফিরিয়ে দিতে হবে।
ছবির কাহিনী শুরু হয় ১৯৯০ সালে, মুর্শিদাবাদে। এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়ির উত্তর প্রজন্ম ভোগ বিলাসের বলি হিসেবে সহায়-সম্পত্তি সব নিলামে তুলেছে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটি তরবারি একশত টাকা দিয়েও নিলামে বিক্রি করতে পারছে না। সেই তরবারি এক আগন্তুক এক হাজার টাকায় কিনে নেয়। একই তরবারি আরেকজন আগন্তুকের কাছ থেকে দশ লক্ষ টাকায় কিনতে চাইলেও তিনি সেটা বিক্রি করতে রাজি নন। কিন্তু হিন্দিভাষী সেই ক্রেতার যেকোনো মূল্যে সেটা চাই-ই চাই।
ছবির গল্পে দেখা যায়, কলকাতার বনেদি পরিবারের কর্তা আশুতোষ সিংহ, ঠাট বাট প্রভাব প্রতিপত্তিতে তারা অদ্বিতীয়। সেই সিংহ বাড়ির মেয়ে বৃষ্টি, যার বন্ধু ও প্রেমিক ইতিহাসের তুখোড় ছাত্র সোহম। সোহম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করতে চাচ্ছে, কিন্তু অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া সোহমের আর্থিক সঙ্গতি সামান্য। সোহমকে বৃষ্টি তার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, তাদের পারিবারিক শিক্ষাবৃত্তিটি দেয়ার সুপারিশও করে। বৃষ্টির বাবার কাছে সোহমের ইন্টারভিউতে প্রশ্ন ছিল, “হুতোম পেঁচার ক’টা টিকি?” এ ধরনের প্রশ্নে যে কেউ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও ইতিহাসের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া সোহম সহজেই উত্তর দেয় “৫১টি টিকি ছিল।“
আসলে হুতোম পেঁচা হচ্ছে কালী প্রসন্ন সিংহের ছদ্মনাম, তিনি যেসব ব্রাহ্মণদের মধ্যে অব্রাহ্মণ সুলভ আচরণ দেখতেন যেমন মিথ্যা বলা, লোক ঠকানো, নারীদের নাজেহাল ইত্যাদি তাদের টিকি কেটে রাখতেন, তার শোকেসে এরকম ৫১টি টিকি ছিল!
সোহমের মেধার প্রখরতায় সিংহবাবু বৃত্তিটা মঞ্জুর করে দেন, একইসাথে নিজ বাড়িতে থেকে পিএইচডি করতে বলেন। সিংহবাবুর এক বন্ধু ২৭ বছর আগে তাকে একটা ধাঁধা লিখে পাঠান, যার সমাধান করতে পারলে বহুমূল্য এক উপহার তিনি পাবেন। তিনি সেই ধাঁধা সমাধানের দায়িত্ব সোহমকে দেন। ইতিহাসের জ্ঞান আর উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে সোহম ধাঁধা সমাধান করলে সেই ধাঁধা নতুন এক ধাঁধা সামনে নিয়ে আসে, এভাবে একসময় সর্বশেষ ধাঁধার সমাধান বহুমূল্য সেই উপহারের কাছে নিয়ে যাবে, সোহম কি পারবে শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে?
অন্যদিকে সিংহ বাবুর কাছে কে যেন কিছুদিন পর পর সাদা কাগজে টাইপ করে একটি করে চিঠি পাঠাতে থাকে। বেনামি সেই চিঠিতে পলাশীর যুদ্ধের বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি লেখা আছে। কে সেই চিঠি প্রেরক কেনই বা চিঠি পাঠাচ্ছে? এরকম মোট ছয়টি চিঠি পাঠানো হয়, সেগুলো হলো-
১. মীরনের মৃত্যু বজ্রাঘাতে
২. ঘষেটি বেগমের জলে ডুবে মৃত্যু
৩. নিজের গলায় ক্ষুর চালিয়ে লর্ড ক্লাইভের আত্মহত্যা
৪. উমিচাঁদ হলো উন্মাদ
৫. জগৎ শেঠেকে হত্যা
৬. মীরজাফরের কুষ্ঠ
ছবিতে আশুতোষ সিংহের চরিত্রে রুপদান করেন কৌশিক সেন। তিনি তার ঝানু অভিনয় দিয়ে ছবিটি জমিয়ে তোলেন। বৃষ্টির চরিত্রে পার্ণো মিত্রও বেশ সাবলীল; চঞ্চলা, স্মার্ট মেয়ে হিসেবে নিজেকে বেশ ভাল মানিয়ে নেন। আমির চাঁদ চরিত্রে গৌতম হালদারের অভিনয় কিছু কিছু জায়গায় চোখে লাগে। তবে সোহম চরিত্রে অনির্বাণ বেশ ভাল করেছে। ইতিহাসের এনসাইক্লোপিডিয়া হলেও তার সংলাপ ডেলিভারি ইতিহাসের কচকচানি মনে হবে না, বরং সচেতন দর্শকরা আগ্রহভরে শুনতে চাইবে। সাক্ষী গোপাল হিসেবে পরাণ বন্দোপাধ্যায় ছাড়া ছবিটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তার অভিনয় লা জবাব! চাদুর চরিত্র শুরুতে বাড়তি মনে হলেও শেষে এসে বোঝা যায় তার কারণে ক্লাইম্যাক্সের জট খোলা আরম্ভ হয়।
ছবিতে বেশ কিছু সমালোচনার জায়গা আছে। লেডি ক্যানিংয়ের কবরের মালি ২৭ বছর আগের চিঠি তাৎক্ষণিকভাবে পকেট থেকে বের করে দেয়, এই অবিশ্বাস্য কান্ড না করলেও হতো। বৃষ্টি, ফিল্মমেকার মেয়েটি তাদের ফলো করছে এটি ধরতে পারলেও খুনের ব্যাপারে তাকে সন্দেহের তালিকায় না রাখা গোলমেলে ঠেকে। ২৭ বছর ধরে যে লোক ধাঁধার কোনো সমাধান বের করতে পারে না, সে কেমন করে সর্বশেষ ধাঁধার সমাধান নিজে নিজে বের করে! ঐতিহাসিক স্থাপনায় দিনে-দুপুরে বাইরের মানুষ শাবল দিয়ে খোঁড়াখুড়ি করবে, এটা মানা যায় না।
ক্যামেরায় তোলা কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, গঙ্গা নদী, লেডি ক্যানিংয়ের কবরের ছবিগুলো মন ভোলানো ছিল। পুরোনো কলকাতার ইতিহাস, দেবী দুর্গার কাহিনী শুনতেও ভাল লাগবে। ছবিতে দুটি গানের একটি সূচনা সংগীত, তবে কোনোটাই মনে দাগ কাটার মতো নয়। ছবির শুরুর দিকে খালি গলায় গাওয়া মনসা পূজার গানটি বেশ শ্রুতিমধুর। বেশ কিছু প্রবাদ বাক্যের জট খোলা হয়েছে, একটি সংলাপ ইতিহাসের চিরসত্যের সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে, “কোনো বিশ্বাসঘাতকই পার পাবে না।“
১৭০৪ সালে আওরঙ্গজেবের দেওয়ান হয়ে মুর্শিদকুলি খান গঙ্গার উত্তর পূর্ব কোণে আসেন, নিজের নামে এই অঞ্চলের নাম রাখেন মুর্শিদাবাদ। তার শেষ ইচ্ছে ছিল কাটরা মসজিদে সিঁড়ির তলায় তার কবর হবে, মসজিদে যত তীর্থযাত্রী আসবে তাদের পায়ের ধূলি যেন তার কবরকে পবিত্রতর করে তোলে। সেই সিঁড়ির তলায় মুর্শিদাবাদের নগর-জনক ঘুমিয়ে আছেন। অতি চমৎকার এই কাহিনীও পাওয়া যাবে সোহমের বর্ণনায়।
ছবির পুরোটা জুড়েই নবাব সিরাজের বিভিন্ন কাহিনী এবং কলকাতার ইতিহাস অন্যরকম এক অনুভূতি জাগাবে। যেকোনো মুগ্ধ ইতিহাসের পাঠক ও থ্রিলারপ্রেমীর ছবিটি ভাল লাগবেই। সমঝদার দর্শকরাও ছবিটি পছন্দ করবে। আরেকটা কথা না বললেই নয়, উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রুপদান খুব সাধারণ ব্যাপার হলেও এই ছবির ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো, সৌগত বসু ছবি নির্মাণের এক বছরের মাথায় গল্পটিকে উপন্যাসে রুপ দেন এবং ছবির নামেই উপন্যাসের নাম রাখেন।
ছবির একটি ধাঁধা দিয়ে দেয়া যাক। ধাঁধাপ্রেমীরা সমাধানের চেষ্টা করতে পারেন। সমাধান হোক বা না হোক, ছবিটি দেখলে সময়টা ভালই কাটবে।
আকাশি আয়না ইংরেজিতে সাহেবের কারাবাস
স্মরণে স্রষ্টা অনুবাদকের জন্মদিনের পাশ