রিচার্ড লিংকল্যাটার গ্রেট ফিল্মমেকার। তার সিনেমাগুলো বরাবরই স্বকীয় আর অনেক বেশি নিজস্ব হয়। তবে এমন দারুণ এক সরসতা থাকে, যা সিনেমাগুলোর মাঝে ফ্লুইডিটি আনে। ‘বয়হুড‘, ‘বিফোর ট্রিলজি’, ‘ডেইজড এন্ড কনফিউজড’, ‘স্ল্যাকার’-এর মতো গ্রেট সব সিনেমা আছে তার ক্যারিয়ারে। তবে প্রত্যেক গ্রেট ফিল্মমেকারেরই একটা ‘ওভারলুকড জেম’ বোধহয় থাকে। লিংকল্যাটারের ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে, ‘টেইপ’ (২০০১)। ৮৫ মিনিটের এই গোটা সিনেমাটা একটা মোটেল রুমে (এক চুলও বের হয়নি)। এবং পুরোটাই ধারণ করা হয়েছে ডিজিটাল ক্যামেরায়। ক্যামকর্ডারে। কোনো মুভি ক্যামেরায় নয়।
গোটা সিনেমা তিনজনকে ঘিরে। স্কুলের তিন বন্ধু। এর মধ্যে ভিন্স, যে দমকলকর্মী হিসেবে কাজ করতো আগে, এখন মাদক কারবারি- সে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মিশিগানে এসে মোটেল ভাড়া নেয়। জানতে পারে এই মিশিগানের ল্যান্সিং ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার স্কুলবন্ধু জন সল্টারের একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রদর্শিত হবে। মোটেলে আমন্ত্রণ জানায় বন্ধুকে। জন আসে। দুজনে মুখোমুখি বসে খুব সুন্দর অতীতের খেয়ালে ডুব দিয়েছিল। স্কুলের নানা কিছুর নির্দোষ স্মৃতিরোমান্থন চলছিল। কী মধুময় আবেশেই না বিরাজ করছিল তখন ফ্রেমজুড়ে। কিন্তু ভিন্সের উদ্দেশ্য ভিন্ন। তাই তো সে আগে থেকেই একটা ক্যাম রেকর্ডার রুমে সেট করে রেখেছিল!
নির্দোষ স্মৃতি নয়, কথায় কথায় একটা ভয়ংকর স্মৃতির কথা আওড়ায় ভিন্স। স্কুলে থাকতে অ্যামি নামের এক মেয়ে, ভিন্সের প্রেমিকা ছিল। এখনো আছে। তবে সেইসময় হুট করে ভিন্সের সাথে তার বিচ্ছেদ হয়। তখন কিছুদিন জনের সাথে জড়ায় এই অ্যামি। ওই সময়েই, এক রাতের ঘটনা নিয়ে কথা উঠায় ভিন্স। এবং তখন গিয়েই স্মৃতিরোমান্থনের এই চিত্রপট বিহ্বলতা আর সাইকোলজিক্যাল টেনশনে ভরে যায়। ভিন্স স্বীকার করিয়েই ছাড়বে, আর জন তা করবে না। পরিস্থিতি যখন চরমে পৌঁছাতে চলেছে, তখন হাজির হয় খোদ অ্যামি! সবকিছুকে আরো অস্পষ্ট আর জটিল করে তুলতে।
‘টেইপ’ এর একরুমের সেটিং ক্লস্ট্রোফোবিয়ার উদ্রেক ঘটায় না সেভাবে, যদি ফোবিয়া না থাকে। হ্যাঁ, একটা আবদ্ধ অনুভূতি তো কাজ করে। সেটা তো গল্পের কারণেই। এই আবদ্ধ আবহ তৈরি করা হয়েছে চরিত্রদের সাইকোলজিক্যাল টেনশনকে আরো অনুভূতিপ্রবণ করে তুলতে। তাদের দ্বন্দ্বকে আরো অভিঘাতী করে তুলতে। স্টিফেন বেল্পবারের মঞ্চনাটক হতে তৈরি সিনেমাটা। কিন্তু কোনো থিয়েট্রিক্যাল ভাব এতে নেই। আদ্যোপান্ত সিনেমা হয়েছে। ধীরে ধীরে সাসপেন্সকে যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, বক্তব্যের গভীরতায় যেভাবে ঢোকা হয়েছে, চরিত্রদের মনোজগতে যেভাবে আন্দোলন তোলা হয়েছে- তা ‘প্রোপার সিনেমা’র গ্যামাট আর অনুষঙ্গ ধরে এগোয়। এমন বহুমাত্রিক হয়ে উঠবে, তা অপ্রত্যাশিত ছিল। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, স্বীকারোক্তি-অস্বীকৃতি, অনুশোচনা, স্বাধীন ইচ্ছা; এই সকল কিছুর সীমানায় থাকা অমোঘ দ্বন্দ্ব আর দ্বৈততার ধূসর জায়গাকে ‘টেইপ’ এমন জেদ আর জোরের সাথে উপস্থাপন করেছে, সেটা অবিশ্বাস্য। টেনশনে পূর্ণ একটা নিখাঁদ সাইকো-ড্রামা হয়েছে এই সিনেমা।
আর এক্ষেত্রে চমৎকার তিনটি পারফর্মেন্স গুরুদায়িত্ব পালন করেছে। প্রত্যেকটি চরিত্রই সহজ-স্বাভাবিক থেকে বেপরোয়া-মারকুটে হয়ে ওঠার গোটা গ্যামাট পূর্ণ করেছে, যৌক্তিক পরিস্থিতির উপর ভর দিয়ে। বাড়িয়ে বলা হবে না, যদি বলি- নিখুঁত অভিনয় সবার। ভিন্স চরিত্রে ইথান হ্যক বিস্ময়কর অভিনয় করেছেন রীতিমতো। সেটা বলছি কারণ, চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রতিটা মুভমেন্ট, প্রতিটা ডেলিভারি সে নিখুঁতভাবে করেছে/দিয়েছে। সে একাই গোটা সিনেমাটাকে একটা সাইকো-ড্রামা হিসেবে এগোতে বাধ্য করেছে। পরিষ্কার উদ্বেগ কাজ করেছে, তার পরবর্তী কর্মকাণ্ড কী হবে; মুভমেন্ট কী হবে; কতটা আগ্রাসী সে হবে- তা নিয়ে। আবার অ্যামি ঘটনাস্থলে আসার পর এবং তার জবানের পর, (ভিন্স) ইথান হ্যকের মাঝে যে বিচলন; যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে (যা প্রকাশ পেয়েছে তার ফিজিক্যাল অ্যাক্টে) তা রীতিমতো শূন্য একটা অনুভূতির জন্ম দেয়। ইথান হ্যকের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় অভিনয়ের একটি, আয়রনিক্যালি যেটা স্মরণ হয় কম।
ওদিকে জনি সল্টার চরিত্রে রবার্ট শন লিওনার্দের অভিনয় পুরোদমে বিশ্বাসযোগ্য। প্রথমের অস্বীকৃতি, শেষের অসহায়ত্ব এবং বিমূঢ়তাকে সে ধারণ করেছে ইনহেরেন্টলি। সিনেমায় দ্ব্যর্থবোধকতার জায়গা এসেছে উমা থার্মানের করা ‘অ্যামি’ চরিত্র দিয়ে। তার প্রত্যেকটা ভাবভঙ্গীতে, ডেলিভারিতে অস্পষ্টতার প্রলেপ পুরোপুরি আছে। এবং দুর্বলতাকে গোপন করে এমন আত্মবিশ্বাসের সাথে অপরের বিশ্বাসে চিড় ধরানোর কাজটি সহজ নয়। কিন্তু উমার অভিনয়ে সেটা এতটা মসৃণভাবে এসেছে যেন উমা তা অনায়সেই পারেন। তার এই দৃঢ়তাই সিনেমার আসল বক্তব্যের জায়গাটায় আরো প্রগাঢ়তা যোগ করেছে।
মি-টু’র সময় তো এখন চলছে। তবে স্থূল এবং এক্সপোজিশনে ভারী না হয়ে অত্যন্ত নূন্যোক্তভাবে এই সিনেমা সেই বিষয়গুলোকে ধরেছে এবং উপস্থাপন করেছে। তা-ও এই সময়ের কত আগে! এই সবকটি উপাদানকে; গল্প, অভিনয়, সংলাপের ভেতর দিয়ে বক্তব্য কী নিরলসভাবে রিচার্ড লিংকল্যাটার চালনা করেছেন- তা দেখে অভিভূত হতে হয়। এতে স্টাইল তো আছেই। হুইপ প্যান, জুম ইন-জুম আউট, স্প্লিট ইমেজ; সব সিনেম্যাটিক স্টাইলগুলোই এতে আছে। কিন্তু তা-ও ফাঁকা আওয়াজের প্রদর্শনী হয়নি কোনোভাবেই। গ্রেট ফিল্মমেকারের দক্ষতা তো এতেই। প্রত্যেকটা স্টাইল ধরা যায় আলাদা করে, কিন্তু গল্পের উপর চড়ে বসে না কিছুই।
ক্যামকর্ডার দিয়ে যে এমন ‘পরিপূর্ণ সিনেমা’ বানানো সম্ভব, তা ‘টেইপ’ দেখার আগে পূর্ণ মাত্রায় বিশ্বাস করাটা কঠিন। এখানে আবারো গ্রেট ফিল্মমেকারের বৈশিষ্ট্যটি চলে আসে। গ্রেট ফিল্মমেকার নতুন প্রযুক্তিকে বশ মানিয়ে ব্যবহার করেন, সেটা দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত কিংবা চালিত হন না। লাগাম থাকে পুরোপুরি, মাস্টারের হাতেই। হ্যান্ডিক্যাম কিংবা ফাউন্ডফুটেজ সিনেমার মতো কোনো আমাচুরিশ ট্রিটমেন্টে যাননি। লিংকল্যাটারের প্রত্যেকটা শটই খুব ভেবেচিন্তে কম্পোজ করা। এবং ব্লকিংটাও তিনি সুচিন্তিতভাবে করেছেন। এমন নয় যে, শুধু এদিক-ওদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে ক্যামেরা ঘুরিয়ে সেটাকে জোর করে রিয়ালিস্টিক মুভমেন্টওয়ালা সিনেমা বলেছেন। হ্যান্ডহেল্ড হওয়ায় এই ডিজিটাল ক্যামেরাকে তিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী চরিত্রের কাছাকাছি রেখেছেন। আবার এমন সংকীর্ণ জায়গায় তার মধ্যে যে একরকম হাঁসফাসের মুহূর্ত তৈরি হয়, সেটাকে ধরতে তিনি ছোট জায়গাতেই সতর্কতার সাথে ক্যামেরা ঘুরতে/ভাসতে দিয়েছেন।
লিংকল্যাটারের সিনেমাগুলোর একটা জোরালো আর চমৎকার বিষয় হলো ন্যারেটিভকে কখনোই তিনি অত এঁটে বসতে দেন না। একটা ছান্দিক প্রকৃতি থাকে, যাতে অনেককিছু ঢুকে যায়। বিখ্যাত ‘বিফোর ট্রিলজি’ই তো সেই কথার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এই সিনেমার ন্যারেটিভ অবশ্য প্রথম থেকেই গন্তব্য লক্ষ্য করে এগিয়েছে। তবে বহুমাত্রিকতা আর হেলেদুলে চলবার কিছু জায়গা অবশ্যই আছে। আর ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজমের আর্টিস্টিক টাচটা তো বরাবরই থাকে তার কাজে।
লিংকল্যাটার যে স্টাইল এই সিনেমার ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছেন সেটা ‘ডগমে ৯৫’ ফিল্ম মুভমেন্ট দ্বারা অনুপ্রাণিত। ডেনমার্কের এই ফিল্ম মুভমেন্ট, লার্স ভন ত্রিয়ার; থমাস ভিন্টারবার্গের মতো বর্ষিয়ান ফিল্মমেকাররা চালু করেছিলেন। এই মুভমেন্টের স্টাইল অনুযায়ী ‘টেইপ’ অন লোকেশনে ধারণ করা। আলাদা করে কোনো প্রপ্স নেই। আলাদা করে সাউন্ড প্রোডিউস করা হয়নি। আবহসঙ্গীতের ব্যবহার নেই। ক্যামেরা হ্যান্ডহেল্ড। আলাদা করে কোনো লাইট ব্যবহার করা হয়নি। গ্রেইনি ভাবটা যথাযথ রাখা হয়েছে। আর ক্যামেরা তো সাবজেক্টিভ ছিলই সর্বদা। এই সবকিছুই দারুণভাবে সিনেমাকে বাস্তবিক এবং রুদ্ধশ্বাস করে তুলেছে।
যথার্থই তাই বলা হয়েছে, রিচার্ড লিংকল্যাটারের ‘এড়িয়ে যাওয়া গ্রেট’ সিনেমা এটি। আঙ্গিক, নন্দন- দুই বিচারেই যেমন গুরুত্বপূর্ণ; তেমনি উপভোগ্যতা এবং চিন্তার উদ্রেক ঘটাবার ব্যাপারেও পরিপূর্ণ।