পাখিয়াল: যাযাবর এক পাখিয়ালের জীবনালেখ্য

মজিদ পাখিয়াল, পাহাড়তলী ছেড়ে থানচির কোনো এক এলাকায় বাস করতে আসে স্ত্রী সুরমাকে নিয়ে। প্রথমে সে ছিল স্বদেশী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তবে আচানক আক্রমণে নিজের এলাকা ছাড়তে হলো। এখানে আসার পর খিয়াং আদিবাসীদের সাথে বসবাস শুরু করে মজিদ আর সুরমা। সেই চট্টগ্রাম থেকে ঠিক কী পরিস্থিতিতে পড়ে বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে এখানে এলো তারা?  

শহরতলীতে বেড়ে উঠেছে এই দুজন। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। প্রথমে কিছু সমস্যা হলেও পরে সবাই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হবার পর বাড়ি ছেড়ে পালাল। অস্থির পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে মজিদ যোগ দিল এক ভ্রাম্যমাণ দলের সাথে, সময়ের পরিক্রমায় সুরমাও যোগ দিল। সেই দলের প্রধান একটু আধ্যাত্মিক গোছের। তার কাছে কত কিছু শেখে এরা! জীবনকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, আর সেই সাথে ভাবতে শেখায় নিজেকে। 

মজিদ কোনোদিন হতে চেয়েছিল দরবেশ; কিন্তু একসময় সে হয়ে উঠল খুনী। আবার হয়ে গেল যাযাবর। আবার হলো গৃহী। এই গৃহী থেকে যাযাবর, আবার যাযাবর থেকে গৃহী হবার যে যুদ্ধ, যে সময় কিংবা যে গল্প- তা আসলেই বড্ড অদ্ভুত। মানিয়ে নেয়া সম্ভব হয়তো আমাদের মতো মানুষের পক্ষেই।

একদিন এই দলনেতার বদৌলতে মজিদের সাথে পরিচয় হয় খিয়াং সম্প্রদায়ের এক শুঁটকি বিক্রেতার। তার সাথে বিশাল পথ পাড়ি দিল মজিদ- সুরমা। তাদের এই যাত্রা কোনো থ্রিলার অভিযানের চেয়ে কম ছিল না। 

খিয়াং সম্প্রদায়ের বাস কোথায় বলতে পারেন? তাদের দিনলিপি, জীবনযাপন সব বেশ সুন্দর করে তুলে ধরেছেন লেখক। এদিকে এখানে আসার পর একসময় সাধু হতে চাওয়া মজিদ হয়ে উঠল খুনী। সে একের পর এক পাখি ও বন্যপশু ধরে আর খুন করে হাত লাল করে ফেলে। অনেকবার স্ত্রী বারণ করেছে, কিন্তু সে শোনেনি। বোধহয় প্রকৃতির পরিশোধ হিসেবে সে হারাল প্রেমিকা-স্ত্রী সুরমাকে। ছেলের জন্ম দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেল সে। হয়তো ছেলেকে দুষছিল সে। তাই সে পালাতে চাইল জীবন, ছেলে আর পাহাড়ের কাছ থেকে। 

কাজী সাইফুল ইসলামের লেখা বই পাখিয়াল; image source: Tasfia Promy

ছেলেকে রেখে সে পামির মালভূমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল, কিছু দূর চলেও গিয়েছিল।কিন্তু আবার ফিরে এলো? কী হয়েছিল সেখানে? এদিকে হাফিজ, সুরমার সেই নাড়ী ছেড়া ধনের জীবনাচার পুরোই ভিন্ন। তার মাথার উপর বাবা-মা নেই। এই ভয় মজিদকে খুব বেশি তটস্থ করে তুলছিল। এত বছর ধরে পাহাড়ের সাথে যে সংযোগ গড়ে উঠেছে মজিদ আর হাফিজের, তাদের আত্মার এক অংশ সুরমাও, যে ঘুমিয়ে আছে এখানে।  

এখান থেকে যেতে হলে সংযোগ ছিন্ন করে যেতে হবে। আবার শহরে গিয়ে কীভাবে সব মানিয়ে নেবে? পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে তারা এক দাঙ্গায়। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য মজিদ কী করবে? সে কি আবার পাখিয়াল হয়ে উঠবে? হাফিজই বা কীভাবে বাঁচবে?

এক অস্থির সময়ের গল্প নিয়ে বইটি লিখেছেন কাজী সাইফুল হাসান। খুব ছোট্ট একটি বই। শেষ করে আক্ষেপ জাগে- এত দ্রুত কীভাবে শেষ হলো? অল্প কথায় বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই। যে সময়ের গল্প এটি, সেসময় তো আরো বেশি পিছিয়ে আছে সেই মানুষগুলো। কিন্তু প্রকৃতি তাদের দিয়েছে আপন ঐশ্বর্য। 

লেখক সাইফুল হাসান নিজে তাদের সাথে ঘুরেছেন, বাস করেছেন এই গল্প লেখার খাতিরে। তার অন্যতম বড় গুণ হলো- অল্প কথায় ঘটনা বেশ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে পারেন, সাথে পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন। বইটি ফিকশন হলেও কিছু কিছু ঘটনা বেশ গবেষণা করেই লিখেছেন, কেবল গল্পের খাতিরে বাড়তি বা অতিরঞ্জিত কোনো চরিত্র বা ঘটনার অবতারণা করেননি। 

গল্পে আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে। রহস্যের খাতিরেই আমরা সেসব চরিত্রের নাম বলছি না। তবে এই চরিত্রগুলো ছাড়া কাহিনী অসম্পূর্ণ। পুরো বইয়ে সমান্তরালে চলেছে প্রেম-ভালোবাসা, রহস্য, হারানোর কষ্ট, নতুন জীবনের কষ্ট, মা-সন্তানের ভালোবাসা, কিংবা দেশকে ভালোবাসার গল্প। ভালোবাসার টানে, আবার তার স্মৃতি থেকে বাঁচতে মজিদ ঘর ছেড়েছিল, আবার ফিরেও এসেছিল। 

হাফিজ নিজের মায়ের ভালোবাসা পায়নি, বাবার আদর পায়নি, কিন্তু তার বাবা-মা হয়ে উঠেছিল পাহাড়ি এক দম্পতি। তারা নিজের ছেলের মতোই ভালোবেসেছে তারা। কিছু ক্ষেত্রে যেন হাফিজ তাদের চোখের মণি। কী অদ্ভুত এই সম্পর্কগুলো, কী সুন্দর ভাবনা তাদের! 

পাহাড়ের সৌন্দর্য এত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন, বিশেষ করে পাহাড়ি জোছনা কিংবা পাহাড়ি নদীতে বয়ে চলা ভেলার গল্প। মন ভালো করে দেবে সবার। বইয়ের শেষটা কেমন যেন অসম্পূর্ণ; শেষ জানা আছে, তবু কোথায় যেন কিছু নেই! একটা শূন্যতা! আধুনিক সরঞ্জাম বা খাবার ওষুধ না থাকলেও চলতে চলতে সব শিখে নেয় মানুষ। আধুনিকতা বর্জিত মানুষেরা কী সুন্দরভাবে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে! অনেক ক্ষেত্রে তারা আমাদের চেয়েও এগিয়ে আছে। 

কাজী সাইফুল ইসলাম; Image source: Writer’s Social Media handle 

এই বইয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কিছু বিষয় আছে, যে কারণে সব বয়েসী মানুষ বইটি পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। আরো কিছু খাবারের নাম আমাদের জন্য অস্বস্তিকর হলেও কিছু মানুষের জন্য খুব সাধারণ। এই দুই-একটা দিক বাদ দিলে সবাই বইটির পাঠক হতে পারেন। বানান ভুল কিংবা বাঁধাইয়ে খুব একটা সমস্যা চোখে পড়েনি।  

বইটির প্রচ্ছদ বেশ সুন্দর। জল রঙে আঁকা পাখি আর নীল-সবুজের মিশেলে এক শান্তির ছায়া আছে। পাখিয়ালের জীবন নিয়েই পুরো গল্প; নামকরণ পুরোপুরি সার্থক। 

লেখকের লেখা নজরুল, পয়গম্বরের ভূমি বই দুটিও অদ্ভুত সুন্দর। এই দুটি বই বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। লেখকের প্রতিটি লেখাই গবেষণাধর্মী। তিনি ফিকশন আর নন-ফিকশন সমান তালে লিখতে পারেন। 

 

বইটির ফ্ল্যাপের কথাগুলোতে কিছুটা স্পয়লার পেতে পারেন, তবে সেটা অগ্রাহ্য করে বইটি পড়ে নিতেই পারেন। অনেক কিছু জানতে পারবেন। ভেঙে পড়লে হয়তো বইটি আপনাকে সাহায্য করবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে। বোহেমিয়ান জীবনের অনেক কিছু, আপনাকে, আপনার দৃষ্টিভঙ্গীকে বদলে দিতে পারে।

Language: Bangla

Topic: 'Pakhiyal' book review

Image source: Tasfia Promy 

 

Related Articles

Exit mobile version