স্বপ্ন তা না যা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন বরং সেটাই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না।
স্বপ্ন নিয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে. আবদুল কালামের করা এই উক্তিটি জগদ্বিখ্যাত। প্রথম দেখায় স্বপ্নের এই সংজ্ঞায়ন অদ্ভুত ঠেকলেও একটু মন দিয়ে পড়লে, অন্তর দিয়ে অনুভব করলে এই উক্তির গভীরতা ঠিকই উপলব্ধি করা যায়। শুধু উপলব্ধির কথাই বা বলা হচ্ছে কেন? আজ আশেপাশে তাকালেই সমাজে যে মানুষগুলোকে আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাই, ইতিহাসে যে মানুষেরা স্মরণীয়-বরণীয় হিসেবে নিজেদের নাম খোদাই করে রেখেছেন, তারা কেউই একরাতে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাননি। তারাও স্বপ্ন দেখেছেন, এরপর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে রাত-দিন পরিশ্রম করেছেন, অধ্যবসায়ের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, এরপর ঠিকই একসময় নিজ নিজ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন।
‘কমান্ডো’ নামটি শুনলেই মানসপটে একজন শক্তপোক্ত মানুষের অবয়ব ভেসে ওঠে আমাদের, যে কিনা রূপালী পর্দার র্যাম্বোর মতো দুর্ধর্ষ কোনো মিশনে গিয়ে সেটা সফল করার লক্ষ্যে শত্রুর সাথে মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত। আমাদের আজকের আলোচ্য বইটিও একই নামের। লিখেছেন সাবেক সেনাসদস্য রাজীব হোসেন। বলতে দ্বিধা নেই, শুরুতে বইয়ের প্রচ্ছদে প্যারা-কমান্ডোর ইন্সিগ্নিয়া(পদমর্যাদাসূচক চিহ্ন) এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও প্রতিরক্ষায় সজ্জিত দুজন সেনাসদস্যকে দেখে যে কেউ মনে করতে পারে, ভেতরে সম্ভবত মারাত্মক সব গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ মিশনের বর্ণনা উঠে এসেছে, হোক সেটা ফিকশন কিংবা নন-ফিকশন। কিন্তু না, হবু পাঠকের এই আশার গুড়ে বালি ঢেলে লেখক নিয়ে এসেছেন তার নিজের প্যারা-কমান্ডো ট্রেনিংয়ের কাহিনি, যা পাঠকের পূর্বপ্রত্যাশা ছাড়াবে তো বটেই, তাকে এমন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই নিয়ে যাবে (অন্তত সেনাসদস্য কেউ যদি তার পরিবারে কিংবা নিকটজনদের মাঝে না থাকেন), যা তিনি পূর্বে কল্পনাও করেননি।
লেখক খন্দকার রাজীব হোসেন পড়াশোনা করেছেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। সেখানে পড়ালেখা শেষে যোগ দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনিতে, নেন দেশমাতৃকাকে রক্ষার দৃপ্ত শপথ। সেনাসদস্য হলেন ঠিকই, কিন্তু সেই শুরু থেকেই তার স্বপ্ন ছিল একজন প্যারা-কমান্ডো হবার। তাই তো ব্যাটালিয়নে যোগদানের মাত্র চারদিনের মাথায় কমান্ডিং অফিসারের (সিও) প্রথম ইন্টারভিউয়ে তিনি সরলমনে বলে ফেলেছিলেন নিজের প্যারা-কমান্ডো সুপ্ত বাসনার কথা। সেটা বলা যে মোটেও উচিত হয়নি, অন্তত সেই সময়ে তো বটেই, তা বোঝা যায় ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙে দেয়া সিও-র জবাবে, “দোয়া কুনুত বলো। তেলাওয়াত করা লাগবে না। এমনিতেই বলো!”
এ তো গেল মাত্র শুরুর দিককার কথা। এরপর বিভিন্ন সময় গিয়েছে, বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু সেই স্বপ্ন লেখক কখনও ছাড়েননি। অধিনায়কের বিরূপ ও অসহযোগিতামূলক আচরণে তিনি কষ্ট পেয়েছেন, নীরবে অশ্রু বিসর্জন করেছেন, হতাশায় নির্ঘুম রাতও কাটিয়েছেন, কিন্তু তারপরও হাল ছেড়ে দেননি। অবশেষে দীর্ঘ সংগ্রামের পর যখন তিনি কমান্ডো কোয়ালিফিকেশন টেস্টে অংশ নিলেন এবং সফলভাবে নির্বাচিতও হলেন, তখন মনে হয় কেবল তিনি না, পাঠকরাও অন্যরকম এক প্রাপ্তির আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠবে।
কিন্তু এটা তো কেবলমাত্র শুরু। আসল কাহিনি তো ট্রেনিং শুরু হবার পর। দ্বিতীয় রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, নিত্যদিনের অতিমানবীয় ট্রেনিংয়ের ধকল, ভোল্টেজ পয়েন্টের আতঙ্ক, দলদলের রক্তচোষা, পরীক্ষায় অসাধু পন্থাবলম্বনের বিচিত্র শাস্তি, স্পিড মার্চ, পান থেকে চুন খসলেই শপাং শপাং বেতের বাড়ি, কুমিরের বাচ্চা, রনা গাছ, এক কিলোমিটার সাঁতার, বড় খানার অদ্ভুত রেসিপি (সঙ্গত কারণেই উপাদানের নামোল্লেখ করা হলো না), সারভাইভ্যাল ট্রেনিংয়ের মতো জায়গাগুলোতে যে পরিমাণ হাস্যরসের উপাদান উপস্থিত রয়েছে, তা পাঠককে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করে দেয়ার মতো অবস্থাতেই নিয়ে যাবে। এটুকু পড়ে আবার ভাবতে যাবেন না যে লেখক রাজীব হোসেন কোনো রম্যরচনা লিখেছেন, বরঞ্চ তার লেখকসত্তার অসামান্য নৈপুণ্যেই কমান্ডো ট্রেনিংয়ের কষ্টকর অভিজ্ঞতাগুলোও সাধারণ পাঠকের কাছে অদ্ভুত রূপে ধরা দেয়, যেখানে আছে হাসি-কান্না-বিস্ময়সহ আরও অনেক রকম অনুভূতিই।
হরেক রকম আবেগের রোলার কোস্টারে চড়িয়ে অবশেষে যখন লেখকসহ তাদের ৭৮ জনের ট্রেইনি কমান্ডো দলটি কমান্ডো হবার স্বীকৃতি পেয়ে গেল, তখন এক অদ্ভুত আনন্দ পাঠকের চোখে-মুখে ভেসে উঠবে। না, পাঠক তো আর কমান্ডো হননি! কিন্তু এই যে এতদিন ধরে লেখকের এতসব ট্রেনিংয়ের কাহিনি শোনা, তার নানা অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী হওয়া- এসব যেন নিজের অগোচরেই একজন পাঠককে লেখকের সাথেই যুক্ত করে দেবে; লেখকের কষ্ট-আনন্দ-প্রাপ্তি আর পাঠকের একই অনুভূতির মাঝে তখন যেন কোনো ফারাকই থাকে না।
এতসব চমৎকার অনুভূতির মাঝে পাঠক হিসেবে কিছু অপ্রাপ্তির কথাও বলতে হয়, যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলে পরবর্তী মুদ্রণে বইটি আরও চমৎকার হয়ে উঠবে:
১) বইয়ের বিভিন্ন জায়গাতেই সামরিক বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রচুর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু অনেক সময়ই সেসবের কোনো ব্যাখ্যা আসেনি। যারা সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্ত, তাদের জন্য সেগুলো নিত্যদিনের শব্দ হলেও আমজনতার জন্য তা কোনোভাবেই নয়। ফলে বইয়ে উল্লেখিত সামরিক বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি শব্দেরই সহজ ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠার নিচে টীকা হিসেবে, কিংবা বইয়ের একেবারে শুরুতে বর্ণানুক্রমে দিয়ে দিলে বিষয়টি পাঠকদের জন্য আরও সহজ হয়।
২) বইয়ের বর্ণনাকে জীবন্ত করবার জন্য উনত্রিশটি ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাদা-কাল মুদ্রণে কিছু কিছু ছবির বেহাল দশা পাঠককে কষ্ট দেবে। এক্ষেত্রে যদি ছবিগুলোকে রঙিন হিসেবে যুক্ত করা যেত, তাহলে বেশ চমৎকার হতো। অবশ্য এক্ষেত্রে বইয়ের ক্রয়মূল্য অতিরিক্ত বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকলে একটি কিউআর কোড স্ক্যান করার ব্যবস্থাও বইয়ে রাখা যেতে পারে, স্মার্টফোনের মাধ্যমে যেটি স্ক্যান করলে তা পাঠককে একটি অনলাইন স্টোরেজে সরাসরি ক্যাপশনসহই রঙিন ছবির স্বাদ দেবে!
৩) বানান ভুল অতিরিক্ত না হলেও মাঝে মাঝেই নজরে এসেছে, যা সম্পাদকের আরও সযত্ন ছোঁয়ার মাধ্যমে সহজেই কাটিয়ে ওঠা যাবে।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ আর্মি প্যারা-কমান্ডো নিয়ে লেখা প্রথম এ বইটি যে বাংলা ভাষাভাষী পাঠককে ভিন্ন এক জগতের সন্ধান দেবে, সে কথা না বললেও চলে। লেখক সফল হয়েছেন তার প্যারা-কমান্ডো ট্রেনিংয়ের দিনগুলির কথা তুলে ধরতে, তিনি সফল হয়েছেন সেসব দিনের অভিজ্ঞতার সাথে পাঠককে চমৎকারভাবে সংযুক্ত করতে, সর্বোপরি নিজের সরব আগমনী-বার্তাও ‘কমান্ডো’ বইটির মাধ্যমে দিয়েছেন লেখক রাজীব হোসেন।
…
বই: কমান্ডো
লেখক: রাজীব হোসেন
প্রকাশনা সংস্থা: নালন্দা
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২১
মুদ্রিত মূল্য: ৫০০/-