চিলড্রেন অব ম্যান: আশা নিয়ে বাঁচার গল্প বলে যে সিনেমা

২০২৭ সাল। লন্ডনের কোনো এক ক্যাফেটেরিয়ায় আগত ক্রেতারা একটি ব্রেকিং নিউজ দেখছে খুব বিষণ্ন দৃষ্টিতে। তাদের বিষণ্নতার কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে কম বয়সী মানুষ ডিয়েগো রিকার্ডো খুন হয়েছে। তার বয়স ছিল ১৮ বছর ৪ মাস ২০ দিন ৮ মিনিট। অবাক লাগছে? সবচেয়ে কম বয়সী মানুষের বয়স ১৮ বছর হবে কেন? এর কারণ হচ্ছে গত ১৮ বছর ধরে পৃথিবীতে কোনো মানব সন্তান জন্ম নিচ্ছে না। একইসাথে বন্ধ্যা হয়ে গেছেন পৃথিবীর সকল নারী! তাই মানব সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটতে চলছে পৃথিবী থেকে!

সর্বশেষ জন্ম নেয়া মানব সন্তানের মৃত্যু সংবাদ শুনে স্বাভাবিকভাবেই সবাই মর্মাহত হয়ে পড়েছে। কিন্তু বেদনার ছোঁয়া স্পর্শ করতে পারছে না সেই ক্যাফেটেরিয়ায় আগত নতুন এক ব্যক্তিকে। তিনি ক্যাফের লোকজনের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে আসলেন আর কফির কাপ নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। কফি নিয়ে বের হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই সেই ক্যাফেতে বোমা বিস্ফারিত হলো। সেই ব্যক্তি আতঙ্কিত হয়ে কফির কাপ ফেলে দৌড় দিলেন। এই দৌড় দেওয়া ব্যক্তিটিই এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট চরিত্র থিও ফ্যারন।

চিলড্রেন অব ম্যান সিনেমায় কফিশপে ব্রেকিং নিউজ চলাকালীন সেই দৃশ্য;  Image Source: IMDb

শুরুর দেড় মিনিটের এটুকু দৃশ্যেই অনেকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সিনেমাটা অন্যান্য গতানুগতিক সিনেমার মতো না। সাধারণত প্রায় সব সিনেমাতেই দেখা যায়, প্রোটাগোনিস্ট চরিত্রটি থাকে অকুতোভয় কোনো মানুষ। মৃত্যুর মুখোমুখি হলেও তারা থাকে ভয়ডরহীন। কিন্তু থিও ফ্যারন এখানে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত। ডিয়েগোর মৃত্যু সংবাদ তাকে স্পর্শ না করলেও নিজের মৃত্যুভয় ঠিকই নাড়াতে পেরেছে তাকে।

নিকট ভবিষ্যতের এই পৃথিবীতে প্রায় সকল দেশের সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শুধুমাত্র ব্রিটেন এখনও সেটা ধরে রেখেছে। তাই সেখানে বেড়েছে অবৈধ অভিবাসীদের আনাগোনা। এমনই এক অবৈধ অভিবাসী মহিলাকে উপকূলীয় এলাকায় নেওয়ার জন্য ট্রানজিট পেপার যোগাড় করে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে থিও ফ্যারনের ওপর।

থিও ফ্যারন ব্রিটিশ সরকারের জ্বালানি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন আমলা। সে ছিল সাবেক অ্যাক্টিভিস্ট। তাকে অপহরণ করে ‘ফিশেস’ নামের একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের লোকেরা। যদিও সেই সংগঠনের দাবি তারা সন্ত্রাসী না, তারা অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে। এই সংগঠনের নেত্রী থিওর সাবেক স্ত্রী জুলিয়ান। জুলিয়ানও একসময় ছিল থিওর মতো অ্যাক্টিভিস্ট। একমাত্র ছেলে ডিলান ২০০৮ সালের ফ্লুয়ের মহামারিতে মারা যাওয়ার পর তাদের সংসার ভেঙে যায়। দীর্ঘ বিশ বছর পর দেখা হওয়ার সময় জুলিয়ান তাকে অনুরোধ করে কি নামের এক মহিলার জন্য ট্রানজিটের ব্যবস্থা করে দিতে। বিনিময়ে তাকে বড় অঙ্কের অর্থ দেয়।

অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সাবেক স্ত্রী আর অর্থের টানে কাজ করতে রাজি হয় থিও। কিন্তু ট্রানজিট আনার পর উপকূলের দিকে যাওয়ার পথে জুলিয়ান কিছু উগ্র অভিবাসীদের আক্রমণে খুন হয়। নির্মোহভাবে থাকা থিও সাবেক স্ত্রীকে চোখের সামনে খুন হতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এরপর সেখান থেকে পালানোর পর থিও জানতে পারে কি নামের অভিবাসী মহিলাটি ছিল গর্ভবতী। দীর্ঘ আঠারো বছর পর কোনো নারীকে গর্ভবতী হতে দেখে তার জন্যই জুলিয়ান এত ঝুঁকি নিয়েছিল।

চিলড্রেন অব ম্যান সিনেমার একটি পোস্টার; Image Source: IMDb

শুরুতে শুধু টাকার জন্য কাজটা করলেও স্ত্রী হারানোর বেদনা আর পৃথিবীতে নতুন জীবনের মুখ দেখানোর তাড়নায় কাজটি সমাপ্ত করতে নতুন উদ্যোম খুঁজে পায় থিও। ঠিক করে কি’কে নিয়ে যাবে ‘টুমোরো’ নামের একটি জাহাজে। সেখান থেকে তারা যাবে ‘হিউম্যান প্রজেক্ট’ নামের একটি প্রকল্পে। গুঞ্জন শোনা যায় তারা মানব শিশু জন্ম নেয়া বিষয়ে গবেষণা করছে। এভাবেই এগিয়ে যায় চিলড্রেন অব ম্যান  সিনেমার গল্প।

সিনেমার গল্প যতটা আকর্ষণীয়, তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল গল্পের উপস্থাপন। ভবিষ্যতের পৃথিবীর কথা শুনলেই আমাদের মনে চলে আসে প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ নতুন এক পৃথিবী। কিন্তু চিলড্রেন অব ম্যান সিনেমায় শুরুর দেড় মিনিটেই বোঝা যায়, নিকট ভবিষ্যতের এই পৃথিবী বর্তমান সময় থেকে খুব বেশি এগোয়নি। বরং এই পৃথিবী আরও হতাশাচ্ছন্ন। 

সিনেমায় দেখানো নিকট ভবিষ্যতের এই পৃথিবী আরও বেশি হতাশাচ্ছন্ন; Image Source: IMDb

থিও যখন অফিসের উদ্দেশ্যে হেঁটে যায়, তখন দেখা যায় রাস্তার পাশে অভিবাসীদের খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়েছে পশুর মতো। কিন্তু থিওর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু থিও নয়, কারোরই সেদিকে মনোযোগ নেই। বোমা হামলা নিয়েও কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। এসব ইঙ্গিত দেয় ওই সময়ের পৃথিবীতে এগুলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তবে এই হতাশাগ্রস্ত পৃথিবীই নতুন দিনের স্বপ্ন দেখার আশা খুঁজে পায় আঠারো বছর পর কোনো মানব শিশুকে জন্ম নিতে দেখে। এই আশার শক্তি এতটাই যে, শিশুকে দেখে সাময়িকভাবে বন্দুক যুদ্ধও থেমে যায়।

মিউজিক বা শৈল্পিক কার্যক্রম নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে, তারা অনেক বিখ্যাত শিল্পের রেফারেন্স ধরতে পারবেন সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যে। ব্যাকগ্রাউন্ডে যখন দ্য কোর্ট অব ক্রিমসন কিং গানটি বেজে ওঠে, তখন দেখা যায় পিংক ফ্লয়েডের অ্যালবাম অ্যানিমেলস’-এর কভারের মতো শূকরের একটা বেলুন আকাশে উড়ছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাইকেল কেইন। তার চরিত্রেও আরেক বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের রেফারেন্স পাওয়া যায়।

সিনেমায় বিভিন্ন শিল্পকর্মের রেফারেন্স পাওয়া যায়; Image Source: IMDb

 

অ্যালকোহলে আসক্ত হতাশাগ্রস্ত থিও চরিত্রে অভিনয় করেছেন ক্লাইভ ওয়েন। তার আগে এই চরিত্রের জন্য বিবেচনা করা হয় রাসেল ক্রো, জর্জ ক্লুনি ও ম্যাট ডেমনকে। ক্লাইভ ওয়েনও দারুণ কাজ দেখিয়েছেন হতাশাগ্রস্ত সন্তানহারা মধ্যবয়সী পুরুষের চরিত্রে। তার সাবেক স্ত্রী জুলিয়ানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অস্কারজয়ী অভিনেত্রী জুলিয়ান মুর। অল্প সময় থেকেও সাবলীল অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে কি-কে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আনন্দঘন পরিবেশ থেকে আতঙ্কিত পরিবেশে প্রবেশ করা সবার অভিনয়ই ছিল মুগ্ধ করার মতো।

অস্কারজয়ী পরিচালক আলফনসো কুয়ারন ২০০৬ সালে সিনেমাটি নির্মাণ করেন ১৯৯২ সালে প্রকাশিত পিডি জেমসের উপন্যাস থেকে। যদিও উপন্যাসে মানব শিশু জন্ম না নেয়ার কারণ দেখানো হয় পুরুষদের শুক্রাণুর পরিমাণ কমে যাওয়াকে, সিনেমায় যা নারীদের বন্ধ্যাত্ব হিসেবে দেখানো হয়েছে। তার কাছে সিনেমাটি নির্মাণের প্রস্তাব যায় ২০০০ সালের দিকেই। কিন্তু তিনি এটা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না। তার কাছে মনে হয়েছিল এটা খুবই জঘন্য একটা স্ক্রিপ্ট!

চিলড্রেন অব ম্যান সিনেমার একটি দৃশ্যে ক্লাইভ ওয়েন ও জুলিয়ান মুর; Image Source: IMDb

২০০১ সালে টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভেলে তার নতুন সিনেমা ই তু মামা তামবিয়েন প্রদর্শনীর জন্য কানাডায় যান কুয়ারন। তখনই ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। কুয়ারন তখন চিলড্রেন অব ম্যান সিনেমাটি নিয়ে চিন্তা করেন। তিনি মনে করেন, এটা ভবিষ্যতের পৃথিবীর গল্প নয়। তিনি ইতোমধ্যে ঐ সময়ের পৃথিবীতেই আছেন!

তখনই এই সিনেমা নির্মাণের তাগিদ পান। তবে সেটা আলোর মুখ দেখতে সময় লাগে আরও পাঁচ বছর। এর মাঝে বানিয়ে ফেলেন হ্যারি পটার অ্যান্ড প্রিজনার অব আজকাবান  সিনেমাটি। চিলড্রেন অব ম্যান পরিচালনার পাশাপাশি স্ক্রিপ্ট লেখার কাজও করেছেন তিনি। ২০১৬ সালে ইউরোপে সিরিয়ান শরণার্থী সঙ্কট শুরু হলে এই সিনেমাটি আলোচনায় আসে। দশ বছর আগেই এমন একটি সঙ্কট তুলে আনায় প্রশংসিত হন কুয়ারন। যদিও তিনি মনে করেন, এতে তার আলাদা কোনো কৃতিত্ব নেই। তার মতে, শরণার্থী সঙ্কট আরও আগে থেকেই লোকমুখে প্রচলিত ছিল, শুধু মূল ধারার মিডিয়াতে এসেছে সিরিয়া সঙ্কটের পর থেকে।

কুয়ারনের পাশাপাশি সিনেমাটোগ্রাফার ইমানুয়েল লুবেজকির কথা না বললে অন্যায়ই হয়ে যাবে। এব ছর অস্কারে প্যারাসাইট  সিনেমার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ১৯১৭ সিনেমাটি যারা দেখেছেন, তারা লং শটের ভালো একটি উদাহরণ দেখেছেন। চিলড্রেন অব ম্যান  সিনেমাতে বেশ কয়েকটি দৃশ্যে এরকম লং শটের মাধ্যমে ডিস্টোপিয়ান আবহ তুলে ধরেছেন অস্কারজয়ী সিনেমাটোগ্রাফার লুবেজকি।

সিনেমাটোগ্রাফার ইমানুয়েল লুবেজকি (বামে) ও পরিচালক আলফনসো কুয়ারন (ডানে); Image Source: IMDb

 

চিলড্রেন অব ম্যানের পর তার ঝুলিতে যোগ হয়েছে গ্র্যাভিটি, বার্ডম্যান, দ্য ট্রি অব লাইফ, দ্য রেভেন্যান্ট, নাইট অব কাপস এর মতো সিনেমা। এর মাঝে গ্র্যাভিটি, বার্ডম্যান আর দ্য রেভেন্যান্টের সিনেমাটোগ্রাফির জন্য অস্কার জিতে নেন।

তবে এত ভালো সিনেমা হওয়ার পরও সেই সময়ে এটা খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। বক্স অফিসে ফ্লপ হয়। অস্কারে সেরা সিনেমার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো সিনেমা হলেও সেই বিভাগে মনোনয়নই পায়নি। শুধুমাত্র সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা আর চিত্রনাট্যের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল। অবশ্য এর জন্য ইউনিভার্সাল পিকচার্সের উদাসীনতাও দায়ী। তারা সে বছরের অস্কারের জন্য ইউনাইটেড ৯৩  সিনেমার যে প্রচারণা চালায়, তার সিকিভাগও করেনি চিলড্রেন অব ম্যানের জন্য।

অনেকটা অভিমান থেকেই তাই দীর্ঘদিন সিনেমা পরিচালনা থেকে দূরে ছিলেন কুয়ারন। তবে ২০১৩ সালে গ্র্যাভিটি  সিনেমা দিয়েই আবার স্বরূপে ফেরেন তিনি। জর্জ ক্লুনি ও সান্ড্রা বুলক অভিনীত সিনেমাটি জিতে নেয় সাতটি অস্কার। কুয়ারন-লুবেজকি জুটি সেই সিনেমাতেও একসাথে কাজ করেন এবং দুজনই অস্কার জেতেন। গত বছর রোমা’র জন্যও অস্কার জিতে নেন কুয়ারন। তবে চিলড্রেন অব ম্যান সেই সময়ে প্রাপ্য সম্মান না পেলেও বর্তমানে এটাকে মাস্টারপিস হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

This is a Bengali article written about 2006 film Children of Men. All the references are hyperlinked in the article. 

Featured Image: Universal Pictures Studio

Related Articles

Exit mobile version