বাবা মায়ের মুখে গ্রামের কথা শুনতে গেলেই ঘুরে ফিরে আসে তাদের ছেলেবেলার গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া, ঝড়ের দিনে আম কুড়ানো, পুকুরে একসাথে গোসল করা, নানান উৎসবে পাড়া ঘুরে বেড়ানো আরও কত কী। এই পুরোটাই আমার কাছে গল্পের মতন শোনায়, শহরে বেড়ে উঠা আমার কাছে গ্রামীণ এই অভিজ্ঞতাগুলো একেবারে অচেনা। আর এই গ্রামীণ অভিজ্ঞতাগুলোর সুখ অনুভূতির কিছুটা বোধ করেছি ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে গিয়ে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’। বিভূতি নিজের জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ‘পথের পাঁচালী’ লিখেছেন বলে ধারণা করা হয়। লেখকের নিজের বাবা ছিলেন পুরোহিত এবং গানের গলা ছিল বেশ ভালো। বিভূতির মা গ্রামের মেয়ে ছিলেন। যদিও নিজের কোনো বোন ছিল না তবে উনার এক পিসতুতো বোনের সাথে দূর্গার চরিত্রের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। উনাদের সাথে একজন বৃদ্ধ পিসিও থাকতেন।
বিভূতিভূষণ গ্রামের স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে কোলকাতা এসে কলেজে ভর্তি হন। কলেজে থাকাকালীন সময়ই তার বিয়ে হয়ে যায় এবং এক বছরের মাথায় ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে সহধর্মীনীর মৃত্যু হয়। এরপর বহুদিন আর বিয়ের করার কথা ভাবেননি। চল্লিশের মাঝামাঝি সময় আবার বিয়ে করেন। তারই এক বন্ধুর অনুপ্রেরণায় ‘পথের পাঁচালী’ একটি পত্রিকাতে পর্ব আকারে পাঠানো শুরু করেন, পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
১৯৫০ সালের কথা, বিভূতভূষণ গত হয়েছেন। তার সদ্য বিধবা হওয়া স্ত্রীর কাছে সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানাতে চাইলে তিনি মানা করেননি বরং বিভূতিভূষণের মনে সবসময়ের এ ধরনের একটা ভাবনা ছিল বলেও জানান।
সত্যজিৎ রায় এরপর চরিত্রগুলোর জন্য অভিনয় শিল্পী খুঁজতে থাকেন। অপুর বাবা হরিহরের চরিত্রের জন্য মঞ্চনাটকের কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঠিক করা হয়। অপুর চরিত্রের জন্য পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন দিলেও মন মতো কাউকে পান না। অবশেষে বিজয়া রায় তার বাসার পাশের ছাদে সুবীর ব্যানার্জিকে খেলতে দেখেন, এভাবেই অপুর চরিত্রের জন্য তাকে ঠিক করা হয়। দূর্গার চরিত্রের জন্য উমা দাশগুপ্তকে খুঁজে পান এক বন্ধুর মাধ্যমেই।
অপুর মায়ের চরিত্র, সর্বজায়ার চরিত্রের জন্য সত্যজিতের এক বন্ধু তার স্ত্রীর নাম প্রস্তাব করেন, করুনা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু করুনা মঞ্চ নাটকে কাজ করলেও সিনেমাতে কাজ করতে প্রথমে রাজি হননি। পরবর্তীতে সত্যজিৎ রায়ের সাথে কথা বলে সব মিলিয়ে রাজি হন। ইন্দির ঠাকরুনের চরিত্রের জন্য চুনীবালা দেবীকে ঠিক করা হয় যার সাথে দেখা হবার সাথে সাথেই সত্যজিৎ উনাকে দিয়েই চরিত্রটি করাবেন বলে ঠিক করে ফেলেন। চুনীবালা দেবীর তেমন কোনো চাহিদা না থাকলেও তার জন্য প্রতিদিন শুটিং এ কিছুটা আফিমের ব্যবস্থা রাখতে হবে বলে জানিয়েছিলে এবং যেদিন রাখা হয়নি সেদিন তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন।
সত্যজিৎ রায়ের নিজের প্রথম সিনেমা, শান্তিনিকেতনে বসে তিনি উপন্যাসের বিভিন্ন দৃশ্য নিয়ে তার নিজের ভাবনা স্কেচ করেছেন। সেগুলো দিয়েই প্রডিউসার খুঁজতে থাকেন। কমার্শিয়াল ফিল্মের কেউই সত্যজিতের গান নাচ ছাড়া সাদা মাটা একেবারে বাংলার কাহিনী নিয়ে কাজ করতে রাজি হয়নি, তবু সত্যজিৎ রায় পিছপা হননি।
১৯৫২ এর শুরুর দিকে, অর্থের অভাবে শুটিংয়ের কাজ শুরু করা যাচ্ছিল না। সত্যজিৎ নিজের ইন্সুরেন্সের কিছু টাকা আর ধার দেনা করে, সুব্রত মিত্রাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন গোপালনগর। সেখানে কিছু দৃশ্য ধারণের পর মনমত না হওয়ায় জায়গা পরিবর্তন করে কোলকাতা থেকে ছয় মেইল দূরে বড়াল গ্রামকে ঠিক করেন শুটিং স্পট হিসেবে। ১৯৫২ এর ২৭ অক্টোবর একটি মাঠের মধ্যে প্রথম শুটিং শুরু করেন।
অপু এবং তার বাবা হরিহর রায় (কানু বন্দ্যোপাধ্যায়), মা সর্বজায়া (করুনা বন্দ্যোপাধ্যায়), বোন দূর্গা (উমা দাশগুপ্ত), পিসিমা ইন্দির ঠাকুরুনকে (চুনীবালা দেবী) নিয়ে গড়ে উঠেছে অপু ত্রয়ীর প্রথম সিনেমা ‘পথের পাঁচালীর’ কাহিনী। সিনেমার প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায় প্রতিবেশীর বাগান থেকে দূর্গা ফল চুরি করে তার পিসিমার জন্য রেখে দিচ্ছে (যদিও প্রথম ধারণ করা দৃশ্য এটি ছিল না)। এ নিয়ে দূর্গার মা সর্বজায়াকে কটু কথা শুনতে হয় যার রাগ গিয়ে পড়ে দূর্গা এবং ইন্দির ঠাকুরণের উপর। এরপর জন্ম হয় অপুর যাকে ঘিরে পরবর্তী কাহিনী প্রবাহিত হয়।
অপুর বাবা হরিহর পেশায় পুরহিত, তার আয় সামান্য। গানের গলা বেশ সুন্দর এবং একদিন যাত্রাপালা লিখে তিনি আরও উপার্জন করতে পারবেন বলে স্বপ্ন দেখেন। সহজ সরল হরিহরের সংসার করতে এসে সর্বজায়াকে সংসারের পুরোটাই সামলাতে হয়। এই পুরো বিষয়টি সত্যজিৎ রায় ‘সর্বজায়া’ আর ‘হরিহরের’ নানা কথোপকথনের মাঝ দিয়ে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সিনেমাতে।
এত অল্প অর্থে সকলের পাতে অন্ন জোগানো মুশকিল। সে কারণেই ইন্দির ঠাকরুনের প্রতি সিনেমার শুরু থেকেই সর্বজায়ার বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পায় যার ফলে ইন্দির ঠাকরুন কিছুদিন এক প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে থাকেন এবং সেখান থেকে শেষ একবার ভিটে দেখতে এলে সর্বজায়ার কটু কথা শুনে তিনি চলে যান এবং সেটাই তার শেষ যাত্রা ছিল।
এই সিনেমায় অপু দূর্গার সম্পর্ককে অত্যন্ত মমতার সাথে দেখানো হয়েছে। অপুর প্রতি দূর্গার মায়ের মতো ভালোবাসা ছিল অপর দিকে সারাদিন একে অন্যের সাথে খুনসুটি করতে ছাড়তো না। অপুর প্রথম ট্রেন দেখার অভিজ্ঞতা দূর্গার সাথেই। সাদা কাশফুলের মাঝে দাঁড়িয়ে কালো ধোয়া উড়িয়ে ট্রেন চলে যাবার দৃশ্যে অপুর চোখে মুখে প্রকাশ পেয়েছে অবাক বিস্ময়। এই দৃশ্যটি সত্যজিতের প্রথম ধারণ করা দৃশ্য। দৃশ্যটিতে দূর্গাকে খুঁজতে থাকে অপু কাশফুলের মাঝ দিয়ে। অপুর চরিত্রে অভিনয় করা সুবীর ব্যানার্জি কোনোভাবেই ভাবটি ফুটিয়ে তুলতে পারছিল না। তখন সত্যজিৎ রায় সুবীরের পথের মাঝে মাঝে নানা পাথর-বাধা দিয়েছিলেন এবং কয়েকজনকে কাশ ফুলের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলেন সুবীরের নাম ধরে ডাক দেবার জন্য যেন অপুর চরিত্রের খুঁজে ফেরার ভাবটি ফুটিয়ে তুলতে পারে, একেকদিকে তাকিয়ে।
এই দৃশ্যের পরের দৃশ্যটিই ছিল, যে বাড়ি ফেরার পথে ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যুকে অপু দূর্গা কাছ থেকে দেখবে, সেটিই অপুর প্রথম কাছের মানুষের মৃত্যু অভিজ্ঞতা। ইন্দির ঠাকুরণ অসাধারণ অভিনয় করেছেন এই দৃশ্যে। সত্যজিতের নিজের ইম্প্রোভাইজেশন পুরো দৃশ্যটি। কেননা মূল উপন্যাসে ইন্দির ঠাকুরণের মৃত্যু হয় মণ্ডপে এবং সেটি আরেক প্রতিবেশীর বাড়িতে। তার কাছে মনে হয়েছে বাঁশ বাগানের মাঝে, অপু আর দূর্গা তার মৃতদেহ আবিষ্কার করাটা অন্যরকম একটি মাত্রা নিয়ে আসবে এবং তিনি সঠিক ছিলেন।
অপু দূর্গার একসাথে মিষ্টি আনতে যাওয়া, বায়োস্কোপ দেখা, বৃষ্টিতে ভেজা সবগুলো দৃশ্যেই ফুটে উঠেছে নির্মল আনন্দ। বায়োস্কোপ দেখার দৃশ্যটিতে অপু দূর্গার পিছনে পিছনে একটি কুকুর হেঁটে যায়। এই দৃশ্যটি সঠিকভাবে ধারণ করতে প্রায় বারো বার টেক নিতে হয়েছে এবং উমার হাতে একটি মিষ্টি দিয়ে কুকুরটিকে লোভ দেখাতে হয়েছে।
সিনেমার মাঝের দিকে অপুর বাবা হরিহর ভাগ্যের সন্ধানে শহরে যান, মাসের পর মাস তিনি ফেরেন না, চিঠি লেখাও বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়টাতে সর্বজায়া তার সমস্তটা দিয়ে সংসার সামলে চলেন। এরপর নানা বিপর্যয়ের পর যখন হরিহর ফিরে আসেন তখন দেখেন তার ঘর ভেঙে গেছে, হারিয়ে গেছে আপন মানুষ। গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অপু দূর্গার চুরি করা পুঁতির মালা খুঁজে পায়। সেটি ডোবার জলে জমে থাকা কুটিপানার মাঝে ফেলে দেয়। সেখানে কুটিপানা ফাকা হয়ে পুঁতির মালা ডুবে গেলে সে জায়গাটা আবার কুটিপানা দিয়ে ভরে যায়।
সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায় অপু তার বাবা মাকে নিয়ে কাশির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে।
পুরো সিনেমায় সত্যজিৎ রায় নানা বৈপরীত্যের মাঝ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পের মূল নির্যাস। ইন্দির ঠাকুরণকে দূর্গার অনেক পছন্দের বিপরীতে ছিল সর্বজায়ার কটাক্ষ, অপু দূর্গার ট্রেন দেখার আনন্দে ঘরে ফেরার বিপরীতে ছিল পথের মাঝে ইন্দির ঠাকুরণের মৃতদেহ আবিষ্কার করা, হরিহরের শহর থেকে ছেলেমেয়েদের জন্য নানা জিনিসপত্র নিয়ে ফেরার বিপরীতে ছিল আবিষ্কার করা দূর্গা অনুপস্থিতি, ভাঙা ঘর।
গ্রামীণ জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে গড়ে ওঠা ‘পথের পাঁচালীর’ কাহিনী সত্যজিতের হাত ধরে পেয়েছে নতুন মাত্রা, যা আজ অবধি মানুষের মনে দাগ কেটে যায়।
দেখুন- সত্যজিৎ রায় এর বই সমূহ