একসময়ের চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ও কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তার বইতে লিখেছেন,
বাংলাদেশে যে তরুণ, তরুণী শিল্পান্মেষার কৌতুহলে চলচ্চিত্র চর্চা করেছেন, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন, চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা নিয়ে লেখালেখি করেছেন, যিনি মনে মনে শিল্পসম্মত একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন, তাদের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুহম্মদ খসরুর সঙ্গে পরিচিত নন।
১৯৬৩ সালে যাদের হাতে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ গঠিত হয় তাদের মধ্যে মুহম্মদ খসরু অগ্রগণ্য। গতকাল ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের এই পথিকৃৎ মৃত্যুবরণ করেছেন। সমাপ্তি ঘটেছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনে ৫৬ বছরের ‘খসরু-অধ্যায়ের’।
১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায় এবং চিদানন্দ দাশগুপ্তের গড়া কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির অনুপ্রেরণায় মুহম্মদ খসরু, ওয়াহিদুল হকেরা মিলে ঢাকায় গড়ে তুলেছিলেন পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ। আমাদের উপমহাদেশে পঞ্চাশের দশক থেকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন হয়েছিলো ১৯২৫ সালে, লন্ডনে ‘দি ফিল্ম সোসাইটি’র হাত ধরে।
চলচ্চিত্রকে শিল্পকর্ম হিসেবে নিয়ে সেটাকে আগাগোড়া বুঝতে চাওয়া এবং অন্যদেরকে বোঝানোর জন্য বিশ্বব্যাপী যে চলচ্চিত্রচর্চার শুরু হয়েছিলো, সেই চর্চাই জন্ম দিয়েছিলো চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের। বিশ্বব্যাপী ফিল্ম সোসাইটিগুলো (চলচ্চিত্র সংসদ) তৈরির উদ্দেশ্য ছিলো মূলত শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্র দেখা, প্রদর্শনীর আয়োজন করা, সিরিয়াস পঠনপাঠন-লেখালিখি এবং ‘ভালো’ সিনেমার সংজ্ঞা নির্ধারণ করার চেষ্টা করা।
সেই ষাটের দশকের শুরু থেকেই এই অঞ্চলে চলচ্চিত্র সংসদের গোড়াপত্তন করে আধুনিক এই শিল্পমাধ্যমটিকে চর্চার বিষয়ে পরিণত করেছিলেন মুহম্মদ খসরু। তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ছায়ানটের প্রথম সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক, রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হক লিখেছিলেন,
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের আদিপর্বের সবটা জুড়ে তিনি, আমরা কেউ নই। খসরুই বাহিনী গড়ে তোলেন সংসদ কর্মীর। ছবি পাবার, ছবি দেখবার, সদস্য সংগ্রহের সমস্ত কাজ তাঁরই খাটুনি, ভাবনাচিন্তা, সুষ্ঠু নেতৃত্বের ফলে একটা পরিণতি পেতে আরম্ভ করে।
মুহম্মদ খসরু বাবার বাড়ি ঢাকার নিকটবর্তী কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুর গ্রামে হলেও তিনি জন্মেছিলেন ১৯৪৬ সালে ভারতের হুগলী জেলায়। তাঁর বাবা ছিলেন হুগলী জুট মিলের কর্মকর্তা। পঞ্চাশের দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে তাদের পরিবার ঢাকায় চলে আসেন। মুহম্মদ খসরু তাঁর শেষজীবন কাটিয়েছেন নিভৃতে, কেরানীগঞ্জের মোহনপুর গ্রামে। সংসারজীবনকে একেবারে বাতিলের খাতায় রেখে সারাজীবন সিরিয়াস চলচ্চিত্রচর্চাকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন।
মুহম্মদ খসরু বিসিকের ফটোগ্রাফার হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানরা বিসিক গড়ে তুললে তাঁকে সেখানে জোর করে ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তাঁর ধ্যানজ্ঞান সবকিছু ছিলো চলচ্চিত্রকে ঘিরে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তাঁর ছিলো অগাধ পড়ালেখা। লেখক, সম্পাদক, চলচ্চিত্রবোদ্ধা, আলোকচিত্রকর- এসব পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ চলচ্চিত্র-সংগঠক।
খসরুর প্রচেষ্টায় চলচ্চিত্র সংসদ নিয়মিতভাবে সৎ ও শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে শুরু করে। তখন বিদেশি সিনেমা যোগাড় করা ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর বিদেশি সিনেমা বলতে তখনকার শুধুমাত্র কিছু ভারতীয় এবং হলিউডের সিনেমার সাথে সাধারণ দর্শকদের পরিচয় ছিলো। খসরুর বাহিনী তখন বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সহযোগিতায় ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপ থেকে শুরু করে আফ্রিকার অচেনা সব বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন। মুহম্মদ খসরুর রচনায় তাঁর বইতে লিখেছেন,
আর্থিক অসচ্ছলতা এবং নানাবিধ বাস্তব অসুবিধার দরুন সোসাইটি অন্যান্য কাজে সক্রিয় হতে না পারলেও এ পর্যন্ত (আগস্ট ১৯৬৮) সদস্যদের ৪৩টি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে পেরেছে।
চলচ্চিত্র নিয়ে পত্র-পত্রিকায় সিরিয়াস লেখালেখি, গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিলো ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি থেকে মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত ‘ধ্রুপদী’ নামে চলচ্চিত্রের কাগজ প্রকাশের মাধ্যমে। চলচ্চিত্র মহলে নন্দিত ধ্রুপদী’কে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পত্রিকা বলা হয়ে থাকে। সর্বশেষ ২০০৬ সালে ধ্রুপদী ষষ্ঠ সংকলন হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। সেই পত্রিকাগুলোই এখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত। তাছাড়া সেসময় চলচ্চিত্রপত্র, ক্যামেরা যখন রাইফেলসহ আরো কয়েকটি প্রকাশনা সম্পাদনা করেছেন মুহম্মদ খসরু।
মুহম্মদ খসরু তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের তত্ত্বাবধানে নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন চলচ্চিত্র বিষয়ক সাহিত্যের বিশাল পাঠাগার। এই লাইব্রেরিতে চলচ্চিত্রবিষয়ক সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রকাশনা ছাড়াও রয়েছে দুষ্প্রাপ্য বই, ম্যাগাজিন, জার্নাল ইত্যাদি। তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন ঢাকার আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে, সংগ্রহ করতেন দরকারি বইপুস্তক। চলচ্চিত্রকে বড় পরিসরে চর্চার স্বপ্ন নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফিল্ম স্টাডি সেন্টার। মুহম্মদ খসরুর চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ‘বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ’। এখন বাংলাদেশে অনেকগুলো চলচ্চিত্র সংসদ গড়ে উঠেছে, এসব সম্ভব হয়েছে খসরুদের আন্দোলনের ফলেই।
বাংলাদেশের প্রথম ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠারও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন মুহম্মদ খসরু। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাঠখড় পুড়িয়ে। আর্কাইভের প্রতিষ্ঠাতা কিউরেটর হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করতে সবাই একমত হয়ে তাঁর নাম প্রস্তাব করলেও শেষপর্যন্ত সেটা বাতিল হয়ে যায়, কারণ তাঁর নাকি কিউরেটর হওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই! এরপর তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষক হিসেবেও কিছুকাল কাজ করেছেন।
বাংলাদেশে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণেও মুহম্মদ খসরুর অবদান রয়েছে। ভারতের কেরালার চিত্রলেখা এবং ওডেসা ফিল্ম কো-অপারেটিভের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে ফিল্ম কো-অপারেটিভ গঠিত হয়েছিলো। এই কো-অপারেটিভের অর্থ দিয়েই বাংলাদেশের প্রথম স্বল্পদৈঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। মুহম্মদ খসরু চেয়েছিলেন ভারতের পুনের মতো ঢাকাতেও একটি চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। এজন্য তিনি পুনে থেকে বিখ্যাত বোদ্ধা সতীশ বাহাদুরকে বাংলাদেশে ডেকে এনেছিলেন এক প্রোগ্রামে। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও এমন কোনো ইন্সটিটিউট গড়ে তোলাতে পারেননি। এরপরও বিভিন্ন সময়ে অন্য দেশ থেকে চলচ্চিত্রবোদ্ধাদেরকে ডেকে এনে আয়োজন করেছেন সেমিনার, ওয়ার্কশপের।
মুহম্মদ খসরু চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহীদের প্রচুর অনুপ্রেরণা দিতেন। তিনি কোনো কিছুকে অযথা প্রশ্রয় দিতেন না, প্রচন্ড গালিগালাজ করতেন। তবে তাঁর গালিগালাজের সবকিছু ছিলো এই সিনেমাকে নিয়েই। সামনাসামনি মুখের উপর সত্যি কথা বলতে পারা এই মানুষটি আমাদের দেশের বহু মেধাবী তরুণকে চলচ্চিত্রে ধরে এনেছেন যারা এখন জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচিত। এখনকার চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে যেসকল সামনের সারির কর্মী আছেন তাদের সবাই মুহম্মদ খসরুর শিষ্য। তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের এক আড্ডায় বলেছিলেন,
আমরা খসরু ভাইয়ের ওভারকোটের বিভিন্ন পকেট থেকে বের হয়েছিলাম।
মুহম্মদ খসরু ছিলেন একজন ক্ষ্যাপাটে চলচ্চিত্রপ্রেমী, সিরিয়াস চলচ্চিত্রবোদ্ধা। একবার কোনো একটা লেখা তারেক মাসুদকে লিখতে দিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা মেরে দিয়েছিলেন। দরজার বাইরে থেকে বলেছিলেন, ‘’লেখা শেষ হলে তালা খুলে দেবো’’। তিনি চলচ্চিত্র সংসদের শিষ্যদেরকে মাঝেমধ্যে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখাতেন। আবার গেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন যাতে তারা সিনেমা দেখা ছেড়ে পালিয়ে না যায়। মূলত এই দেশে শিল্পগুণসম্মত চলচ্চিত্রের দর্শক এবং নির্মাতা তৈরির নেপথ্য কারিগর ছিলেন মুহম্মদ খসরু। তরুণদের উদ্দেশ্যে মুহম্মদ খসরু বলেছিলেন,
ফিল্মকে ভালোবেসে তবেই এই আন্দোলনে আসতে হবে। এখানে হিপোক্রেসির কোনো অবকাশ নেই।
সবাই সিনেমা বানায় আর মুহম্মদ খসরু বানিয়েছেন বিকল্প ধারার নির্মাতা। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছিলো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রকারের। এর মধ্যে অনেকের সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার, শামা জায়েদী ও আদুর গোপাল কৃষ্ণানের সাথে তাঁর কথোপকথন ‘সাক্ষাৎকার চতুষ্টয়’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো।
১৯৭৫ সালে ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার রাজেন তরফদার পরিচালিত ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘পালঙ্ক’-তে মুহম্মদ খসরু সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। নিজের চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন, হাসান আজিজুল হকের লেখা ‘নামহীন গোত্রহীন’ অবলম্বনে একটি চিত্রনাট্যও তৈরি করেছিলেন অনেকদিন আগে। রাষ্ট্রীয় অনুদানের জন্য জমাও দিয়েছেন দুবার, কিন্তু অনুদান পাননি। তাই শেষপর্যন্ত অর্থাভাবে নির্মাণ হয়নি তাঁর বহুল প্রতিক্ষিত সিনেমাটির।
মুহম্মদ খসরু কখনও তথাকথিত লাভের আশায় চলচ্চিত্রকে ভালোবাসেননি। অনুদান পাননি, রাষ্ট্রীয় কোনো পদক পাননি। তবুও তিনি আমাদের চলচ্চিত্র চর্চার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী ও মুহম্মদ খসরুর সহচর কামরুল মিথুনের ভাষায় বলতে চাই,
মুহম্মদ খসরু, অমরত্ব পোষা কুকুরের মতো যার পায়ে পায়ে চলে।
মুহম্মদ খসরুর লেখা বইসমূহ
- বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন
- বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ভূমিকা
- সাক্ষাৎকার চতুষ্টয়
মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত চলচ্চিত্রের পত্রিকা
- ধ্রুপদী
- চলচ্চিত্রপত্র
- ক্যামেরা যখন রাইফেল
- ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ বিশেষ সংখ্যা
পুরস্কার ও সম্মাননা
- চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে দীর্ঘ ৫০ বছর অবদানের জন্য মুহম্মদ খসরু হীরালাল সেন আজীবন সম্মাননা
- বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণ জয়ন্তী পদক
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ-এর আজীবন সম্মাননা