মানুষ বেঁচে থাকার আশায় গুহা ছেড়ে বিপদসঙ্কুল পাহাড়, সমুদ্র, বন্যতা, বর্বরতা পেরিয়ে সভ্যতার পথে যাত্রা করছে। মানবসভ্যতার এই যাত্রা আদতে কীসের জন্য? জহির রায়হানের মতে, তা জ্ঞান, আলো ও সুখের জন্য। কিন্তু তবুও যেন কোথাও আলো নেই, মানবসভ্যতা বারবার পতিত হয় অন্ধকারে।
হিংস্র জানোয়ার ও শূকর-শুকরীর বন্যতার ভয়ে একদল ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, যুবক-যুবতী আর এক সন্তানসম্ভবা নারী লুকিয়ে ছিল একটা নোংরা অন্ধকার ঘরে। বাচ্চা ছেলেটি কেশে উঠলে সবাই তার দিকে আগুনচোখে তাকায়। শব্দ করা যাবে না। তাদের উপস্থিতি টের পেলেই যে হিংস্র হায়েনারা বন্য ক্ষুধার তাড়নায় তাদের জান-জবান কেড়ে নিতে আসবে।
পাশের বাড়ির বুড়িমা নিজের বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় দিতে তাদের দরজায় কড়া নাড়লে তারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে, কাউকেই যে বিশ্বাস করা যায় না। একটি ছেলে দরজা খুলতে যায়, কিন্তু সমস্বরে সবাই প্রতিবাদ করে ওঠে। ছেলেটি বলে-
“মরতে হলে বিশ্বাস করেই মরব।”
তপুর বুড়িমা তাদের সবাইকে নিজ বাড়িতে নিয়ে এসে বাক্সঘরে আশ্রয় দেন। বাইরে থেকে পশুদের হল্লা আর পাশবিক চিৎকার ভেসে আসে। পশুগুলো বুড়িমা’র বাড়িতে প্রবেশ করে তন্নতন্ন করে আশ্রিতদের খুঁজতে থাকে, কিন্তু খুঁজে পায় না। ঠিক এমন সময়েই বিপদের সাথে উপহাস করে সন্তানসম্ভবা নারীটির প্রসববেদনা ওঠে।
“সবাইকে হতাশ করে উনিশজন মানুষের অভিসম্পাত কুড়োতে কুড়োতে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হলো।”
সদ্যোজাত বাচ্চার গলা টিপে ধরে একজন, যেন কান্নার শব্দ না হয়। জন্মলগ্নেই পৃথিবীর প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে মারা যায় বাচ্চাটি। সেই সাথে মারা যায় তার মা। মৃত নারীর স্বামী শব্দ করে কাঁদতে চেয়েও নিজের মুখ চেপে ধরে। কারণ, এখন যে কান্নাও বারণ।
নানা বর্ণের, বয়সের মানুষ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাঁটুপানি, কাদা মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। তারা ক্লান্ত, তারা জরাগ্রস্ত। কেউ বা দানবের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। তারা একজন আরেকজনের পানে প্রশ্ন করে,
“আমরা এখন কোথায়? ইন্দোনেশিয়ায়। না ভিয়েতনামে। না সাইপ্রাসে।”
তারা জানে না, তারা কোথায়। জ্বালিয়ে দেওয়া ঘরবাড়ি পেছনে ফেলে তারা ছুটে চলে শরণার্থী হিসেবে।
নিজের ছেলে তপুর খোঁজ পাওয়ার জন্য সেই বুড়িমা ছুটে চলা শরণার্থীদের কাছে তার চেহারার বর্ণনা দিতে থাকে। কিন্তু সবাই নিজ চিন্তায় মগ্ন। ছেলে তপুর মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা ভেবে বুড়িমা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদে। তার কান্না দেখে শরণার্থীদের স্রোত থেকে একজন এগিয়ে এসে বুড়িমাকে বলে,
“তুমি কাঁদছো কেন গো। কেঁদে কী হবে। আমার দিকে চেয়ে দ্যাখো, আমি তো কাঁদি না। ওরা আমার ছেলেটাকে মেরেছে হিরোশিমায়। আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়। আমার বোনটা এক সাদা কুত্তার বাড়িতে বাঁদি ছিল। তার প্রভু তাকে ধর্ষণ করে মেরেছে আফ্রিকাতে। আমার বাবাকে হত্যা করেছে ভিয়েতনামে। আর আমার ভাই, তাকে ফাঁসে ঝুলিয়ে মেরেছে ওরা। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতো।”
বাথটাবে রক্ত আর পানির মধ্যে ডুবে আছে ইভার মা-বাবা, ভাইয়ের মৃতদেহ। তপু ছুটে চলে ইভাকে নিয়ে। গন্তব্য তপুর বাড়ি। সেখানে তার বুড়িমা, ভাইবোন, বাবা অপেক্ষা করছে। তপু আর ইভাকে তাড়া করে পেছন পেছন ছুটে আসছে পাগলা কুকুরের দল। তপু আর ইভা অন্ধকার খুঁজে বেড়ায়, যেন লুকাতে পারে হিংস্র এই দলটি থেকে।
তপু-ইভা গির্জায় পাদ্রীর কাছে আশ্রয় নিলে পাদ্রী তাদেরকে নিরাপদে রেখে এসে দেখতে পায়, গির্জা ভরে গেছে একদল সাদা ধবধবে মানুষের ভিড়ে। বুড়ো পাদ্রীকে তারা চিৎকার করে বলে,
“ওই নিগ্রোগুলোকে ওখান থেকে বের করে দাও। আমাদের হাতে ছেড়ে দাও।”
পাদ্রী অস্বীকার করে বলে, গির্জায় কোন নিগ্রো নেই। সাদা মানুষগুলো চলে যায়। তপু-ইভা আবার ছুটে চলতে থাকে। পথে শুধু মৃতদেহ পড়ে আছে থরে থরে কুকুরের, বিড়ালের, শুকর ছানার, পাখির। আর মানুষের। ইভা-তপু একে অপরকে বলতে থাকে,
আমরা কোথায়?
বুখেনওয়াল্ডে।
না। অসউইজে।
না। স্টালিনগ্রাডে? অথবা ভিয়েতনামে?
‘আর কতদিন’ নামক সাহিত্যকর্মটি জহির রায়হান রচিত। তিনি ছিলেন একাধারে কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার। ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামক ডকুমেন্টারি তৈরি করে জহির রায়হান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য আরো কাজের মধ্যে রয়েছে ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘হারানো বলয়’, ‘নয়াপত্তন’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘কতকগুলো কুকুরের আর্তনাদ’ ইত্যাদি।
শাসক-শোষক ও যুদ্ধবাজরা বরাবরই শিল্প-সাহিত্যকে তাদের নিজ স্বার্থ, শাসনের হাতিয়ার বা প্রোপাগান্ডা চালানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু বিপরীত চিত্রে দেখা যায়, একদল শুভবোধ সম্পন্ন সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার ও নানা মাধ্যমের শিল্পীগণ তাদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে অন্যায়-অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদ জারি রাখতে বা সত্য তুলে ধরতে সচেষ্ট। জহির রায়হান তাদেরই একজন। জহির রায়হানের কলম ও ক্যামেরা সর্বদাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিল।
স্বাধীনতার আগমুহূর্তে পাকিস্তানি সেনার এদেশীয় মিত্রপক্ষ আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হন জহির রায়হানের ভাই বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার। পরবর্তী সময়ে, ১৯৭২ সালে জহির রায়হান তার ভাইকে খুঁজে বের করার জন্য মিরপুর বিহারী ক্যাম্পে যান। কিন্তু এরপর থেকে তাকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
‘আর কতদিন’ নামক রচনায় জহির রায়হান নির্দিষ্ট কোনো সময়ের চিত্র না তুলে বরং পৃথিবীতে একেক কালে একেক স্থানে ঘটে যাওয়া মানবজাতির দুঃখ-দুর্দশা, যুদ্ধবিগ্রহের চিত্র সমান্তরালে এঁকেছেন। ভিয়েতনাম, জেরুজালেম, স্তালিনগ্রাদ, হিরোশিমা- সব অঞ্চলের নিপীড়িতদের লেখক এক কাতারে নিয়ে এসেছেন। কারণ তারা সকলেই যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হয়েছে নির্যাতিত-নিপীড়িত। লেখক রূপকের সাহায্যে অত্যাচারীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন হিংস্র জানোয়ার বা রক্তপিপাসু সিংহ হিসেবে। যাদের তাণ্ডবে নগরী এখন জীবনের স্পন্দনহীন, পথগুলোতে কবরের শূন্যতা।
বর্তমান সময়ে এসেও আমরা দেখতে পাই শরণার্থীদের স্রোত। নিজ দেশ ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে পালিয়ে এসে পথে ঘটে মৃত্যু। তেমনই এক শরণার্থী ছিল সিরিয়ার পাঁচ বছর বয়সী আয়লান কুর্দিও। পরিবারের সাথে সমুদ্রপথে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে যাওয়ার পথে নৌকাডুবির পর সৈকতে তার মরদেহ ভেসে আসে। আয়লান কুর্দিসহ এরকম ভাগ্যহারা শত শত মানুষের চিত্র বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিলেও তাদের স্রোত থামে না, অথবা থামতে দেওয়া হয় না।
এই ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাত-পাতের দোহাই দিয়ে পৃথিবীতে ক্রমাগত অনাচার ঘটতে থাকা নিয়ে তাই লেখকের মনেও জিজ্ঞাসা, আর কতদিন চলবে এই অত্যাচার-অনাচার?