“তুমি আমার। আমার মনটাকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। মনটাকে মোর বসতে দিও। মুড়ি মুড়কি খেতে দিও। জলের গ্লাস দেয়ার ছলে একটু শুধু ছুঁয়ে দিও?” পরীমনির কণ্ঠে শুভ্রার বিচ্ছেদাসন্ন প্রেমের আকুতি অপেক্ষমান দর্শকবৃন্দ শুনতে পেয়েছিল ট্রেলারে। কিন্তু কোন নাটকীয় পরিণতির দিকে এগুবে তাদের কৈশোরিক প্রেম? ডাকাতি, খুন, গুম, দেশান্তরী- এসবের মাঝে তাদের চিঠি আর ল্যান্ডফোনের দিনগুলোর প্রেম কি সার্থক পরিণতি পাবে নাকি শেষটা হবে দেবদাস-পার্বতী, রোমিও-জুলিয়েট কিংবা লাইলি-মজনুর মতো?
“আমি মজনু, আমি দিওয়ানা,” প্রেমিকা শুভ্রাকে নিয়ে নৌকায় বসে বলছিল অপু নামের ছেলেটি, আর দৃশ্যপটে চাঁদপুর শহরের ডাকাতিয়া নদীর মনকাড়া নৈসর্গিক দৃশ্য। চাঁদপুরের মফস্বল যে শহরটি নিয়ে আমাদের এ ছবিটির গল্প সেখানে থাকে তিনটি পরিবার। কাছাকাছি বাড়িতে থাকেন হিরণ সাহা (অভিনয়ে মিশা সওদাগর) আর রহমান মিয়ার (অভিনয়ে শহীদুল আলম সাচ্চু) পরিবার। হিরণ সাহার মেয়েই শুভ্রা সাহা, ছবির নায়িকা অর্থাৎ পরীমনি। তার ছোট একটি ভাইও আছে, নাম গোপাল। বাবা-মা, ভাই-বোনের সুখের সংসার। ওদিকে রহমান মিয়া আর তার স্ত্রীরও দুই ছেলেমেয়ে, বড় ছেলেটির নাম অপু রহমান, গল্পের নায়ক (অভিনয়ে আছেন ইয়াশ রোহান)। দুই পরিবারই জানে যে তাদের ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে পছন্দ করে। কিন্তু সেটা কতোটা গভীর সেটা তারা জানে না। তাছাড়া হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের বিয়ে যে সম্মতিক্রমে হবে না সেটাও দুই পরিবার জানে, তাই এটা বেশি দূর এগোবে না ভেবেই বুঝি আর মাথা ঘামানো হয়ে ওঠে না।
তৃতীয় আরেক পরিবার, কেবল স্বামী আর স্ত্রী- আয়নাল গাজীর (অভিনয়ে ফজলুর রহমান বাবু) পরিবার। আমাদের এ সিনেমার মূল খলনায়ক তিনি। আর ছোট ভিলেন তারই সাগরেদ আর ডান হাত ঠাণ্ডু (অভিনয়ে ইরেশ যাকের)। তিন পরিবারের কর্তারই পেশা ছোটখাট ব্যবসায়ী। তেলের কল কিংবা চালের আড়ত- এরকমের ব্যবসা চালান তারা। কিন্তু ছবির গল্প শুরু একটা তুচ্ছ ঘটনা দিয়ে। একটি বড় মাছ নিলামে বিক্রির সময় ১৭,৫০০ টাকার মতো বড় অংক হেঁকে দিয়ে আয়নাল গাজীকে হারিয়ে দেন হিরণ সাহা। আর সে অপমানের প্রতিশোধ নিতে তার মাছ ধরবার নৌকায় ছিনতাই চালায় আয়নাল গাজীর লোকেরা। এ খবর জানবার পর হিরণ সাহা শাসাতে গেলেন আয়নাল গাজীকে। কিন্তু ওখানেই তাকে কৌশলে গুম করে ফেলে আয়নাল। শুধু গুম নয়, তার জায়গা-জমি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসাও কিনে নিল আয়নাল।
আর এরপর দিব্যি ভালো মানুষটির মতো হিরণের পরিবারের কাছে গিয়ে তাদের জানালো, তারা যতদিন চায় থাকতে পারে সেই বাড়িতে নিজের মনে করে, যদিও বাড়ি এখন আয়নালের। হিরণ সাহাকে দিয়ে জোর করিয়ে লেখা চিঠিও নিয়ে যায় আয়নাল, যেটা পড়ে পরিবার জানতে পারল হিরণ সাহা নাকি কমবয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে সব বিক্রি করে ভারত চলে গিয়েছে। এবং এ কাণ্ডে হিরণ দুঃখিত। আরো ক’দিন বাদে আরেক মেকি চিঠিতে হিরণ জানান, তিনি কলকাতায় শুভ্রার মাসীর বাড়িতেই আছে, সবাই যেন চলে আসে। পরিবারের সকলে সিদ্ধান্ত নিল, কিছুই তো নেই এখন বাংলাদেশে, চলেই তবে যাওয়া যাক ভারতে।
সেটিই বাদ সাধে আমাদের গল্পের নায়ক অপু আর নায়িকা শুভ্রার কিশোর প্রেমে। কীভাবে তারা ভুলে যাবে একে অপরকে। এ কি সম্ভব আদৌ? কিন্তু থাকবারও তো জো নেই শুভ্রাদের। তাই হৃদয় ভেঙে গেলেও কষ্ট নিয়ে লঞ্চঘাটে বিদায় দেয় শুভ্রাকে অপু। আর প্রতিটি দিন একে অন্যের চিঠির অপেক্ষায় থাকে তারা।
লঞ্চ ছেড়ে যেতেই জানে মেরে ফেলা হয় হিরণ সাহাকে। আর জলবৎ তরলং, ওপার বাংলায় গিয়ে শুভ্রার পরিবার হাসিমুখে তাদের বরণ করা মাসীর মুখ থেকে জানতে পারলো, হিরণ কোনোদিনই এখানে আসেননি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো তাদের।
স্থানীয় এক থিয়েটারে অভিনয়শিল্পীর কাজ নেয় শুভ্রা সংসারের হাল ধরতে। কিন্তু দুই কিশোর-কিশোরী যে মিষ্টি প্রেমের স্বপ্নের জাল বুনছিল তা কি তবে এক ঝড়েই ছিঁড়ে যাবে? আয়নাল গাজী যখন গোগ্রাসে সবার সম্পত্তি গিলে নিচ্ছে, তখন সবাই তাকিয়ে দেখবে কেবল? প্রেমের টানে দু’বাংলার সীমানা পেরিয়ে ছুটে আসা অপুর জন্য কী অপেক্ষা করছে? কেনই বা তাকে আবার ফিরে যেতে হবে? শেষ পর্যন্ত কি ন্যায়ের জয় হবে, নাকি আয়নাল গাজীর সর্বগ্রাসী রূপের কাছে হার মানতে হবে? জানতে হলে দেখতে হবে ছবিটি।
নয় বছর বাদে পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম বানালেন ‘স্বপ্নজাল’ সিনেমাটি। এতগুলো বছর আগে যখন ‘মনপুরা’ বানিয়েছিলেন তিনি, তখন বাংলা সিনেমার ধারাই বদলে গিয়েছিল। তাই এতদিন পর তার নতুন ছবি যে সাড়া ফেলে দেবে তা কি আর বলতে?
যতটা আশা নিয়ে দর্শক সিনেমা হলে যাবেন ছবিটি দেখতে তা পুরোপুরি পূরণ হবে কিনা সেটা নির্ভর করবে দর্শকের উপরেই। আপনি যদি আশা করে থাকেন এ ছবিতে আপনি প্রচুর মারপিট দেখতে পাবেন, তবে এটি আপনার জন্য নয়। কিংবা, খুবই গভীর কাহিনী? না, সেটাও নয়। ছবির কাহিনীটি খুবই সাধারণ, কিশোর প্রেম, ব্যবসায়ীর দ্বৈরথ, খুন, প্রতিশোধ। এগুলো তো সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু কত অসাধারণভাবে পরিচালক ফুটিয়ে তুলেছেন সেটাতেই আপনার চোখেমুখে খেলে যাবে মুগ্ধতা। আন্তঃধর্ম প্রেমকে এ সমাজ কী চোখে দেখে সেটিও পরিচালক চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেবেন।
এ ছবির সেরা পাওয়াটা ফজলুর রহমান বাবু। এভাবে চলতে থাকলে তিনি যে কোন উচ্চতায় গিয়ে থাকবেন বলাই মুশকিল। তার অভিনয় এতই নিখুঁত আর বাস্তবিক হয়েছে এ ছবিতে, যে আপনি হাততালি না দিয়ে পারবেন না। যেমন, বিশেষ একটি দৃশ্যে, বাবু তথা খুনী আয়নাল গাজী রিকশা থেকে আল্লাহ্-বিল্লাহ করে কসরত করে নামবার দৃশ্য হলভর্তি দর্শককে হাসিয়ে তোলে। বাকি দৃশ্যগুলোর কথা তো বলাই হলো না।
এরপর আসা যাক পরীমনির কথায়। এ ছবিতে যেন অন্য এক পরীমনিকে দেখা গেল। সম্পূর্ণ নতুন রূপে, নিজের বয়সের চেয়ে বেশ কম কিশোরী এক মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছে তাকে। কিশোরী প্রেমিকা হিসেবে যেমন মানিয়ে গেছে তাকে, তেমনই ওপার বাংলায় গিয়ে রক্তকরবীর চরিত্রেও যেন সাবলীল তিনি। এরকম অভিনয় চালিয়ে গেলে পরীমনির রাস্তাটা গিয়ে ঠেকবে বহুদূর!
ইরেশ যাকেরকে প্রথম দৃশ্যগুলোতে চেনাই যায়নি! একজন অভিনেতা হিসেবে এটা একটা বড় সার্থকতা। একদম নিজের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত তিনি দর্শকের মন জয় করে নিয়েছেন। ছবিটিতে যে ভিলেন দুজনই দর্শকদের প্রিয় হয়ে উঠল। তবে এমনিতে ভিলেন হিসেবে অভিনয়ে অভ্যস্ত মিশা সওদাগর এ ছবিতে অল্প সময়ের জন্য পজিটিভ চরিত্রে ছিলেন, এবং ভালো অভিনয় দেখিয়েছেন।
নায়ক অপুর চরিত্রে ইয়াশ রোহানের অভিনয় অবশ্য সকলের মন মতো হয়নি। তবে সেটা চিত্রনাট্যের দোষ নাকি তার অভিনয়টাই এরকম হবার দরকার ছিল সেটা তর্কের বিষয়। কৈশোরের প্রেমের অপরিণত সিদ্ধান্তগুলো ইয়াশ রোহানকে অভিনয় করে দেখাতে হয়েছে বিধায় তার প্রতি দর্শকমনে বিরক্তির সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু, কমবয়সী ইন্টার পাশের আগের প্রেমের অবস্থা এমনটাই হবার কথা। সেক্ষেত্রে হয়ত তার অভিনয় সার্থক।
শুটিং স্পট হিসেবে চাঁদপুরের যে জায়গাটি বেছে নেয়া হয়েছিল, এর চেয়ে সুন্দর বুঝি আর সম্ভব ছিল না। ক্যামেরার কারুকাজও ছিল অসম্ভব সুন্দর- সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে কোনোই কথা হবে না। কিন্তু কথাটা হতে হবে আসলে মিউজিক নিয়ে। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর চমৎকার ছিল, হয়ত আরো ভালো করা যেত আরো বৈচিত্র্য এনে- সেটি বড় অভিযোগ না। কিন্তু মনপুরার মতো মনকাড়া গান কিন্তু এ ছবিতে নেই, যেটা নিয়ে মানুষ কথা বলবে বছরের পর বছর।
বাংলাদেশের বেঙ্গল ক্রিয়েশনস ও ভারতের বেঙ্গল বারতার যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘স্বপ্নজাল‘ ২ ঘণ্টা ২৭ মিনিট দীর্ঘ। মুক্তি পায় ৬ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে সেন্সর বোর্ডের বিনা কর্তনেই। প্রযোজক আবুল খায়ের, সুরকার রশীদ শরীফ শোয়েব, চিত্রগ্রাহক কামরুল হাসান খসরু আর সম্পাদুক ইকবাল আহসানুল কবির। পশ্চিম বাংলার বিপ্লব ব্যানার্জি, ব্রাত্য বসু, রজত গাঙ্গুলি, শর্মিলা রায় প্রমুখ অভিনয় করেছেন ছবিটিতে। ছবিটিতে প্রদর্শিত হচ্ছে ঢাকায় স্টার সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার, শ্যামলী, মধুমিতা ও বলাকা সিনেমা হলে। ঢাকার বাহিরে বগুড়ার সোনিয়া, জয়দেবপুরের বর্ষা, শেরপুরের কাকলি, দিনাজপুরের মডার্ন, ময়মনসিংহের ছায়াবানী, নওগাঁর তাজ, ভৈরবের মধুমতি, নারায়ণগঞ্জের মেট্রো, খুলনার সংগীতা ও লিবার্টি, সিলেটের বি.জি.বি., মুক্তারপুরের পান্না, ডেমরার রানীমহল, রাজশাহীর উপহার এবং পাঁচদোনার ঝংকার সিনেমা হলে। বাংলাদেশে মুক্তির সপ্তাহ দুয়েক পর সিনেমাটি উত্তর আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে মুক্তি পাবার কথা ছবিটির, তাছাড়া আসছে ভারতের দর্শকদের জন্যও।
স্বপ্নের জালে কি বাস্তবতা সব সময় ধরা পড়ে? হয়ত কখনো পড়ে, কখনো পড়ে না। ‘স্বপ্নজাল’ এর শুভ্রার স্বপ্নের কী হয়েছিল সেটি জানতে দেখতে হবে ছবিটি!
ফিচার ইমেজ: Bengal Creations