বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে হাতে ব্রেসলেটটা পরে নিয়ে পকেট সাইজ নোটবুকটা বের করল সে। আরো একটা নাম লিখল। পরের পৃষ্ঠায় চারটা দাগ শেষে আরেকটা দাগ টেনে ট্যালি বানাল। আরো বেশকিছু ট্যালি আছে ওই পৃষ্ঠায়। ট্যালির সূত্র ওই নামগুলো। কিন্তু ওই নামগুলোই বা সে নোট করে রাখছে কেন? এর একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা পাওয়া যায় আগের দৃশ্য, অর্থাৎ, সিনেমার ওপেনিং সিন থেকে।
বারে বসে বিক্ষিপ্ত আলাপে মশগুল তিন বন্ধুর চোখ যায় ওই কোণে একা বসে মাতাল হয়ে টলতে থাকা যুবতীর দিকে। মাতাল অবস্থায় দুই বন্ধু মেয়েটিকে যাচ্ছেতাই কটু মন্তব্য করতে লাগল তারা।
তাদের চটুল কথায় বাগড়া দিয়ে ভদ্রবেশী তৃতীয় বন্ধু মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। দেখে মনে হলো, বাকি দুই বন্ধুর নোংরা দৃষ্টি থেকে বাঁচাতে সে রক্ষকরূপে উদয় হয়েছে। দুটো কথার পর, মাতাল মেয়েটিকে বাসায় যেতে সাহায্য করবে বলে ট্যাক্সি ডাকল সে। তার নিয়ত তখনো অব্দি ভালো বলেই ঠেকছিল। ভুল প্রমাণ করে একটু পরেই নেশায় চুর যুবতীকে তার বাসায় বসে আরেক পেগ খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল। মেয়েটির তো নেই হুঁশ। সে বশীভূত হয়ে চলল অচেনা যুবকের অ্যাপার্টমেন্টে।
একটু পরেই মদের গ্লাসে ভালোমানুষি শটিত হতে দিয়ে মেয়েটার শরীরের নানা জায়গায় হাত আর ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগল যুবক। নিচে নেমে গেলে মেয়ে মাতাল সুরে তাকে থামতে বললো বেশ ক’বার। কিন্তু থামল না ছেলেটি। তারপর হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠে বসল মেয়েটা। চোখের দৃষ্টি একদম স্পষ্ট। মাতলামির কোনো চিহ্নই কোথাও নেই। তবে কি পুরোটাই সাজানো খেলা, এমন সুবিধাবাজদের শিক্ষা দিতে?
পরের দৃশ্যে অর্থটা পরিষ্কার হয় কিছুটা। মেয়েটির নাম ক্যাসি। যুবতী বয়স পার করে ফেললেও এখনো থাকে মা-বাবার ঘরে। তারা কত বোঝান মেয়েকে, নিজের জীবনটা গোছাতে, কিছু করতে, অন্তত একটা প্রেমিক বানাতে। ওই কফিহাউজ নামক শিটহাউজের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আর ক’দিন চলবে? এমনকি তার ৩০তম জন্মদিনে স্যুটকেস উপহার দিয়ে ভদ্রভাবে মা-বাবা বোঝালেন, “ঘর থেকে বের হ।” তা-ও ক্যাসি নির্বিকার। তার জগতে আছে শুধু প্রতিশোধ। প্রতি সপ্তাহে বারে গিয়ে মদে মাতাল হওয়াটা আসলে অভিনয়। সে দেখতে চায়, কোন ছেলে সুবিধা নিতে আসে। তারপর অবলার ভান করে থাকে ছেলের ঘর পৌঁছানো অব্দি। এবং ছেলে যখনই ফায়দা লুটতে প্রস্তুত, তখনই ঝটকা দিয়ে ছুটে যায় ক্যাসির মাতলামি। তারপর ডায়েরিতে আরেকটা নাম।
ট্যালি বানানোর উদ্দেশ্যে আরেকটা দাগ। সিনেমার কিছু সময় পর এটুকু পরিষ্কার হয়, তার এই পকেট নোটবুকের নাম, ট্যালির বিষয়টা সংযুক্ত অতীতের কিছুর সাথে। জঘন্য কিছু। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন মেডিক্যাল স্কুলের বন্ধু রায়ানের সাথে তার দেখা হয়, ভাব হয়। কথায় কথায় রায়ান বলে, এল মনরোর কথা। বদলে যায় ক্যাসির চেহারা। আরেকটা নতুন মিশন এবার শুরু হয়। তার বান্ধবী নিনা সম্পর্কিত। নিনার কলেজ জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনায় দোষী সকলের নামটা সে নোটবুকে টুকে রেখেছিল। এবার শুধু ক্রস দেবার পালা। কী ঘটেছিল নিনার সাথে? আর ক্যাসিই বা সবটা কেন নিজের ঘাড়ে বয়ে টানছে?
‘প্রমিজিং ইয়ং ওম্যান’। তা কে এই প্রমিজিং ইয়ং ওম্যান? ক্যাসি? হ্যাঁ, ক্যাসিরও তো একটা প্রমিজিং ক্যারিয়ার ছিল মেডিক্যালে। কিন্তু বের হয়ে যাবার পর আর চালিয়ে যায়নি ঐ পেশা। প্রমিজিং ক্যারিয়ার তো ওই নিনারও ছিল। কিন্তু ঝরে গেল। নামটাকে আবার উল্টেও ব্যবহার করা যায়। সেটা অবশ্য সিনেমার ডার্ক হিউমারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে। ক্যাসি যে প্রতিশোধের নেশায় উন্মাতাল, সে ক্ষেত্রেও তার ক্যারিয়ার ‘প্রমিজিং’। চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক এমেরাল্ড ফেনেলের এই অভিষেক সিনেমা, রিভেঞ্জ থ্রিলারকে পিচ ব্ল্যাক কমেডিতে মিশিয়েছে, যাতে আছে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতি কড়া বিদ্রূপ এবং নারীবাদী বক্তব্য।
আলোচিত ‘মি-টু’ মুভমেন্টের সূত্র ধরে এ সিনেমা, যার প্রতিশোধের বিষয়টিতে অনুপ্রেরণা চলে আসে আবেল ফেরেরার ‘মিস. ৪৫’ (১৯৮১) সিনেমার। প্রমিজিং ইয়ং ওম্যান, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোর মধ্য দিয়েও কীভাবে বৈষম্যবাদী এবং বিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ পায়, তা দেখিয়েছে। অনেক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। সিনেমা দর্শকের কাছে জানতে চেয়েছে, একটা মেয়ে মদ খেয়ে মাতাল হলেই কি তার ফায়দা নেওয়ার সার্টিফিকেট পাওয়া হয়ে যায়? মাতাল বলেই কি তার সাথে অশোভন আচরণ করলে সেটা শোভন হয়ে যায়? শুধুমাত্র মদ খেয়েছে বলেই কি তার সাথে ঘটা অন্যায়গুলোর বিচার সে চাইলে, তাকে সাসপেনশন অভ ডিসবিলিফের খাতায় রেখে দিতে হবে?
প্রশ্নগুলো শুনে যদি মনে হয় এই সিনেমা নারীর মদ খাওয়া, মাতাল হওয়াকে ‘গ্লোরিফাই’ করছে; তবে মনে হওয়াটা সম্পূর্ণরূপেই ভুল। কোনো পক্ষের মাতাল হওয়ার ক্ষেত্রেই গ্লোরিফাই করছে না। বিষয়টা মদ কিংবা মাতলামির নয়, বিষয়টা দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার। যেকোনো পরিস্থিতিতেই নারীর দুর্বলতাকে পুঁজি করে তাকে শিকার বানানোর, তার ফায়দা ওঠানো নিয়েই প্রশ্ন করা হয়েছে। মাতাল হোক কিংবা না হোক, সুযোগ নিতে চাইবে কেন? নারীকে সে অবস্থায় বিব্রত হতে হবে কেন? এবং এ সকল পরিস্থিতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক আচরণটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, প্রমিজিং ইয়ং ওম্যান। সিনেমার বক্তব্যটা খুবই ইউনিভার্সাল। ভিক্টিম নারী হলে উল্টো তাকেই দোষারোপ করার ঘটনা তো সর্বত্রই চলে এবং চলছে। এদেশের দর্শকরা তো খুব সহজেই এর সাথে মেলাতে পারবে। কারণ, কোনো মেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরলেই তার চরিত্রে দোষ দেওয়া তো বহু জনতার রোজকার চর্চা।
এমেরাল্ড ফেনেলের নিগূঢ় হাস্যরসে পূর্ণ ক্ষুব্ধ, সাভার্সিভ আর ন্যায় চাওয়া চিত্রনাট্যটি কিছু কিছু সিদ্ধান্ত এবং বক্তব্য একটু স্থূল আকারে রাখলেও, সেটা সিনেমার ক্ষোভের জায়গাটি থেকেই এসেছে। তার লেখা সুপরিচিত ‘কিলিভ ইভ’ সিরিজের ফেমিনিস্ট টোনটার ছায়াই এ সিনেমায় রেখেছেন। ক্যাসি চরিত্রের দুঃসহ অতীত, যন্ত্রণাদায়ক বর্তমান, এবং পোয়েটিক জাস্টিস দিতে নামা মিশন; সবকিছুকেই আলাদা আলাদা লেয়ারে প্রকাশ করেছে ফেনেলের চিত্রনাট্য। দুই বিপরীত লিঙ্গের এই যুদ্ধে অধিকার, শরীর সবকিছুরই প্রকাশ একেকটা অস্ত্র হিসেবে হয়েছে।
চিত্রনাট্য এবং পরিচালনা দুই জায়গাতেই ফেনেল পূর্ণমাত্রার ‘স্যাভেজ’রূপে কাজ করে গেছেন। পর্দার সামনে বসে তা অবলোকন করার কাজটা দর্শককেও বানিয়েছে ‘স্যাভেজ’! পর্দার সেই ক্ষোভ আর প্রতিশোধের নেশাটা দর্শক প্রতি ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করতে পারছিল, ক্যাসি চরিত্রে ক্যারি মুলিগানের অদম্য অভিনয়ের কারণে। চোখের পলকে প্রতিবারই তার ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠাটা ৪৪০ ভোল্টের ঝটকাই দেয়। চরিত্রটাকে যে একেবারে আত্মস্থ করে নিয়েছেন মুলিগান। তার বেদনায় মুখ ছেয়ে যায় অন্ধকারে, আর হিংস্রতায় জ্বলে উঠে আগুনে। তার স্মোকি ভয়েসটায় হতাশা, দুঃখ, আক্রোশ সবটাই ধরা দেয়। চরিত্রটির একমাত্রিক হওয়ার প্রশ্নটা তখনই উবে যায়।
সিনেমার মুড শিফটিং, হয় নারী চরিত্রটির মুড শিফটিং ধরে ধরে। আর সেই শিফটিং বোঝাতে মাস্টারফুল সঙ্গীতায়োজন করা হয়েছে। ব্রিটনি স্পিয়ারের ‘টক্সিক’ দিয়ে ক্রোধ প্রকাশ করেছে, তো ‘এঞ্জেল অভ দ্য মর্নিং’ দিয়ে বিজয়। সেইসাথে কালার প্যালেটগুলোয় ব্যবহার করা নিয়ন গোলাপি, ক্ষোভকে তুলে ধরতে ব্যবহার করা এক্সট্রিম ক্লোজআপ, শূন্যতাকে তুলে ধরতে নেওয়া ব্লিক ওয়াইড শট; সবকিছুই সিনেমার নাটকীয়তার সাথে সাযুজ্য স্থাপন করার মতো একটা যথাযথ ভিজ্যুয়াল ভাষা দাঁড় করিয়েছে।
এমেরাল্ড ফেনেল দর্শকের প্রত্যাশার পারদকে এদিক-ওদিক উঠিয়ে-নামিয়ে শুরু থেকেই যে কাজটি করছিলেন, তা স্যাভেজারির গোটা গ্যামেটটা ছাড়িয়ে যায় অন্তিম দৃশ্যে এসে। অস্বস্তিদায়ক অভিজ্ঞতা তো দিয়েছেনই, শেষে এসে তা বদলে যায় ক্রূর হাসিতে। পাঁচ নাম্বার দাগ কেটে ট্যালির চ্যাপ্টার অবশেষে পূর্ণ। তিক্ততার মাঝেও একটা সুমিষ্ট ভাব ভারি করে তোলে শেষ ফ্রেমটিকে।