বছরের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসকে ধরলে খুব একটা ভুল হবে না মনে হয়। এ মাস লম্বায় ছোটখাট হলেও নিয়ে আসে অনেকগুলো আনন্দঘন দিবস, রঙিন মুহূর্ত। আবার ছড়িয়ে দেওয়া এই রঙগুলো ৬৮ বছর ধরে নিজের মধ্যে দাবিয়েও নিচ্ছে অনায়াসে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে। বলা যায়, ফেব্রুয়ারি মানেই রঙের দোলাচল। আর দোলাচলের কথা উঠলেই বলতে হয়, জহির রায়হানের লেখনীর কথা। তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে নিয়ে এসেছেন একটি ভিন্ন মাত্রা।
তিনি একমাত্র কথা সাহিত্যিক, যার সাহিত্যের মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে রয়েছে এই ফেব্রুয়ারি মাস, অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন। ড. হুমায়ুন আজাদ বলেন, “বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের কারণেই জহির রায়হানের কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।”
জহির রায়হানের অধিকাংশ সাহিত্যই একুশের গল্প নিয়ে, তাই আজ আলোচনার মূল বিষয়বস্তু লেখকের ছোটগল্প ‘একুশের গল্প’।
তপু
অতি হাস্যোজ্জ্বল একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী তপু। সবসময় আমোদ-ফূর্তিতে থাকতে পছন্দ করত সে। একবার যদি গল্পের ঝুড়িটা খুলে বসত, তবে আর কারো রক্ষা নেই; ‘ঠাকুমার ঝুলি’র গল্পও ফুরোয়, কিন্তু তপুর গল্পের কোনো শেষ নেই। তপু বয়সে তার তিন রুমমেটের চেয়ে ছোট হলেও তাদের মধ্যে সে-ই ছিল একমাত্র বিবাহিত। বিধবা মা ও স্ত্রী রেণুকে নিয়ে ছিলো তপুর সংসার। খুবই নিয়মানুবর্তী, বিবেকবান ও দুঃসাহসী এই ছেলেটি হলো গল্পের মূল চরিত্র।
রেণু
তপুর দূরসম্পর্কের আত্মীয়া, যার সাথে তপু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। দোহারা গড়ন, ছিপছিপে কটি, আপেল রঙের এই মেয়েটির সাথে কলেজে ওঠার কয়েক বছর পরে বিয়ে হয় তপুর। রেণু কখনই চাইত না, তপু মিছিলে যাক কিন্তু তপু তার দায়িত্ববোধ ও বিবেকের তাড়নায় স্ত্রীর মন রাখতে পারেনি। সে বিবেচনায়, রেণুকে কিছুটা স্বার্থপর ও আবেগী চরিত্র বলা যায়।
রাহাত
তপুর রুমমেট রাহাত একটি প্রতিবাদী চরিত্র। তপুর হারিয়ে যাওয়ার পেছনে রাহাত আংশিক দায়ী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তপুকে তার স্ত্রী মিছিলে যেতে বাধা দিলে তপুর সাথে রাহাতও রেণুর প্রতিবাদ করে। রাহাত একজন সৎ ও সাদা মনের মানুষ, যে কিনা সারাদিন ধরে ঘোরে, তপুর পরিবারকে তার ফিরে আসার খবরটা জানানোর জন্য।
সানু
তপুর আরেকটি রুমমেট। সানু অত্যন্ত বাস্তববাদী একটি চরিত্র।
গল্পকার
গল্পকার হচ্ছে তপুর তৃতীয় রুমমেট। আর সকলের মতো সেও তপুকে খুব মনে করে এবং তার ফিরে আসায় বেশ বিস্মিত হয়।
লেখক পরিচিতি
ভাষা আন্দোলন নিয়ে নাটক, সিনেমা, গল্প, উপন্যাসের কথা উঠলে প্রথমেই যে নামটি মুখে আসে, তা হচ্ছে, জহির রায়হান; যার পুরো নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ; ডাকনাম জাফর। স্কুল জীবন থেকেই জহির রায়হানের ছিল লেখালেখির প্রতি আগ্রহ এবং কৈশোরকালে রাজনীতির। কোনো আগ্রহই যে তিনি হেলাফেলা করেননি, তা তার জীবদ্দশা অবলোকন করলেই সুস্পষ্ট বোঝা যায়। লেখালেখির প্রতি প্রবল আগ্রহ মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাকে এনে দেয় মাসিক পত্রিকার ‘প্রবাহ’র সম্পাদক হওয়ার সম্মানটি। এছাড়াও তিনি ইংরেজি, বাংলা নানান পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
তবে লেখকের আগ্রহ শুধুমাত্র লেখালেখি ও রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছবি তোলা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণেও বেশ একাগ্রতা প্রকাশ করেন। তার চিত্রকার সত্ত্বা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের বর্বরতার নজির বিশ্ববাসীর সামনে ভিন্নভাবে তুলে ধরতে বেশ তৎপর ভূমিকা রাখে।
১৯৩৫ সালের ১৯শে আগস্ট ফেনীর মজুপুরে জন্মগ্রহণ করা জহির রায়হানের বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা তাকে মেডিকেল কলেজ, অর্থনীতি বিভাগ ত্যাগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক পাশ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
১৯৬৪ সালে প্রকাশিত জহির রায়হানের উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ লেখকের ঘরে এনে দেয় সেরা সাহিত্যিক পুরস্কার। তার প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’। উপন্যাসটি ১৯৬০ সালে ‘চৈতালি’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ জহির রায়হান আত্মপ্রকাশ করেন একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্রের নাম ‘কখনো আসেনি’। একে একে তিনি সকল দিকেই সমান পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হন।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ইন্ধন দেওয়ার জন্য পুলিশ যে দশজনকে গ্রেফতার করেন, ‘একুশের গল্প’র লেখক তার মধ্যে অন্যতম।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে জহির রায়হান তার চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অনুমোদন মেলেনি; বিধায় ১৯৭০ সালে পাকিস্তানীদের সহিংসতার বর্ণনা করে রূপক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ নির্মাণ করেন। এটাই তার শেষ চলচ্চিত্র।
১৯৭২ সালে ৩০শে জানুয়ারি মিরপুরে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি এই কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ছোট গল্পকার। ১৯৯৯ সালে জানা যায়, তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
৩৭ বছর জীবনকালে জহির রায়হান সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে তার বিস্তর অবদানের কারণে মোট ৭টি সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
লেখক তার লেখার শুরু থেকে পাঠকের মনোযোগ ধরে রেখে পাঠকের সাথে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। লেখার প্রতিটি লাইন বেশ ছোট ছোট ও প্রাঞ্জল। স্বল্প শব্দ ব্যবহারে কিভাবে কঠিন কথাগুলো বলা যায়, তা প্রকাশ পায় এই লেখকের লেখনীতে।
অনলাইনে জহির রায়হানের বই কিনতে ক্লিক করুন নিচের লিংকে