সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র- গল্প বলার, সত্য জানানোর, সামাজিক প্রেক্ষাপট স্পষ্ট করে মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরার অনন্য দুটি মাধ্যম। সাংবাদিকতা সত্য ঘটনা, ঘটনার প্রেক্ষাপট, কার্যকরণ প্রমাণ সহ জনসম্মুখে তুলে আনে। সমাজের যেকোনো ক্ষেত্রের ঘটনাই হোক না কেন সেটা। এর ভিত্তিতেই অনেক সময় বাস্তবে কোনো ঘটনার মোড় উল্টে যায়, উন্মোচিত হয় লুকিয়ে থাকা তথ্য। চলচ্চিত্র এমন এক ধরনের মাধ্যম যা প্রধানত বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হলেও তুলে ধরতে পারে সমাজ, রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতি, বলতে পারে সত্যের গল্প, জনমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে শক্তিশালী কোনো বার্তা।
সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিনোদনধর্মী সাংবাদিকতার একটি বিশাল অংশ যেমন রয়েছে চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে, তেমনিভাবে সাংবাদিকতাকে ঘিরেও আবর্তিত হয় বিশ্বের নানা দেশের চলচ্চিত্রের গল্প। কখনও তা হয় গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে, কিংবা কখনো মূল ঘটনার সহায়ক গল্প হিসেবে।
এমন কিছু চলচ্চিত্র নিয়েই আজকের লেখা।
দিল সে
তামিল ইন্ডাস্ট্রির বিখ্যাত পরিচালক মনি রত্নমের পরিচালিত এবং প্রযোজিত চলচ্চিত্র ‘দিল সে’ নব্বইয়ের দশকের অন্যতম সাড়াজাগানো একটি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি রোমান্টিক-থ্রিলার ঘরানার।
মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান ও মনীষা কৈরালা। চলচ্চিত্রটির কাহিনী আবর্তিত হয় ভারতের রাজনৈতিক জটিলতা, সরকারী নানা আগ্রাসনের প্রভাবে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদী দল ও এর কার্যক্রম, সন্ত্রাসবাদী দলের সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া এক সাংবাদিক এবং তার সাথেই সেই দলের এক নারী সদস্যের ভালোবাসার গল্প নিয়ে। একজন সংবাদকর্মীর ঝুঁকির মুখে তথ্য সংগ্রহ, নানা সীমাবদ্ধতা, বিশেষ ক্ষেত্রে আবেগ ও অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারার ফলাফল এবং স্বাধীনতাকামী কিন্তু সন্ত্রাসবাদী চরিত্রের নানা ঘটনার মিশেলে এগিয়েছে দিল সে সিনেমার গল্প। এই চলচ্চিত্রের চিত্রায়ন, দৃশ্যায়ন বাস্তবতার নিরিখে গড়ে ওঠা প্রেক্ষাপটই একে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি
২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া আজিজ মির্জা পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি কমেডি-ড্রামা ঘরানার। মূল চরিত্রে ছিলেন শাহরুখ খান, জুহি চাওলা এবং পরেশ রাওয়াল। শাহরুখ খান এবং জুহি চাওলা দুজনই এতে অজয় বখশী ও রিয়া ব্যানার্জী নামক দুজন সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেন। শুধুমাত্র প্রচার-প্রসারের লোভে সাংবাদিক অজয়ের একটি ভুল এবং সেই ভুলের সূত্র ধরে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো গল্প নিয়ে এগোয় চলচ্চিত্রটির কাহিনী।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার নানা সমস্যা, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগ ও মুখ বন্ধ করে রাখা এবং যত বড় সমস্যাই হোক না কেন, পর্যাপ্ত অনুসন্ধান ও সদিচ্ছার মাধ্যমে প্রতিবাদ ও সমস্যা নির্মূলে গণমাধ্যম কতটা কার্যকরী ফল রাখতে পারে, চলচ্চিত্রটি তা দেখিয়ে দিয়েছে।
পেজ থ্রি
মধুর ভাণ্ডারকরের পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি ২০০৫ সালে মুক্তি পায়। বিনোদন জগতের নানা দেখা-অদেখা দিক, বিনোদন জগতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নানা মহলের রাজনীতি, বিনোদন সাংবাদিকতা নিয়েই এই চলচ্চিত্রের গল্প। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এক নারী সাংবাদিকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়েছে নানা ঘটনা। কঙ্কনা শেন শর্মার সহজাত অভিনয়ের গুণে এর চিত্রায়ন ও দৃশ্যায়ন প্রাঞ্জলতা পেয়েছে।
কাবুল এক্সপ্রেস
নিউ ইয়র্ক, এক থা টাইগার কিংবা বজরঙ্গি ভাইজানের মতো অধিক পরিচিত চলচ্চিত্রগুলোর পরিচালক কবির খানের পরিচালনা করা প্রথম চলচ্চচিত্র ‘কাবুল এক্সপ্রেস’ এর কথা হয়তো অনেকেই জানেন না। চলচ্চিত্রটি গল্প নাইন ইলেভেন পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানের মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে।
এই চলচ্চিত্রের আগে আফগানিস্তান নিয়ে কবির খান বেশ কিছু ডকুমেন্টরিও বানিয়েছেন। এই চলচ্চিত্রটি ডকুমেন্ট না হলেও ডকুমেন্ট ঘেঁষা ধরনের বলা যায়, প্রত্যক্ষদর্শী ও তথ্যসংগ্রহকারীর চোখে আফগানিস্তান যেমন, সেভাবেই এর চিত্রায়ন করা হয়েছে। এটিই প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র যা আফগানিস্তানের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। জন আব্রাহাম, লিন্ডা আর্সেনিও এবং আরশাদ ওয়ারসি এতে সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেন।
পিপলি লাইভ
আনুশা রিজভির পরিচালনায় প্রান্তিক কৃষকদের কৃষকদের জীবনভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ২০১০ সালে। গ্রামের এক সাধারণ কৃষকের দুর্দশাময় জীবন, আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ইত্যাদি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমের প্রভাব নিয়েই চলচ্চিত্রটির কাহিনী এগিয়েছে।
আনুশা রিজভী ব্যক্তিগত জীবনে সাংবাদিক ছিলেন। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা খুব ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি কাহিনীতে। সমাজের নানা ঘটনাকে রাজনীতিবিদরা এবং কিছু গণমাধ্যম যেভাবে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে- রিজভি সেটির বিদ্রুপাত্মক এবং কিছুটা হাস্যরসাত্মক চিত্রায়ন করেছেন। ভারতের কিছু প্রদেশে কৃষকদের গণ আত্মহত্যার সত্য কাহিনীর উপরে নির্মিত চলচ্চিত্রটি। ওমাকার দাস মানিকপুরি, রাঘুবীর যাদব, মালাইকা শেনয়, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী এতে অভিনয় করেন। এছাড়াও অভিনয় করেন মধ্যপ্রদেশের অনেক আদিবাসী। শ্রেণীসংঘাত, রাজনৈতিক আগ্রাসন, গণমাধ্যম এবং একইসাথে সুবিধাবাদী ও নিবেদিতপ্রাণ চিত্র- সবকিছুর মিশেলের অনন্য একটি জীবনধর্মী চলচ্চিত্র ‘পিপলি লাইভ’।
রান
রাম গোপাল ভার্মা পরিচালিত ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটি রাজনৈতিক থ্রিলার ঘরানার। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, নানা ষড়যন্ত্রে গণমাধ্যমের সংযুক্ততা ও তার প্রভাব এবং অন্যদিকে স্বচ্ছ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সত্যকে তুলে ধরার কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে আবর্তিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রটি। বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে চলচ্চিত্রটি। অমিতাভ বচ্চন, রিতেশ দেশমুখ, মহেশ রাওয়াল প্রমুখ অভিনয় করেছেন প্রধান চরিত্রগুলোতে।
নো ওয়ান কিলড জেসিকা
রাজ কুমার গুপ্তর পরিচালিত থ্রিলার ঘরানার চলচ্চিত্রটি ২০১১ সালে মুক্তি পায়। দিল্লিতে জেসিকা লাল নামক এক মডেল ও রেস্টুরেন্ট কর্মী হত্যার ঘটনাকে ঘিরে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি।
হরিয়ানা রাজ্যের তৎকালীন প্রভাবশালীন নেতা বিনোদ শর্মার ছেলে মানু শর্মা রেস্টুরেন্টের ভেতরে গুলি করে হত্যা করে জেসিকা লালকে। বিদ্যা বালান এতে জেসিকার বড় বোন সাবরিনার চরিত্রে অভিনয় করেন। রানী মুখার্জী অভিনয় করেন এক সাংবাদিকের চরিত্রে, যার সাহায্যেই সাবরিনা শেষ পর্যন্ত তার বোন হত্যার বিচার পান। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে কোনো অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলে এবং আপাতদৃষ্টিতে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই এমন মনে হলেও সঠিক অনুসন্ধান, অপরাধের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের সোচ্চার হওয়া, জনমত গড়ে তুলতে প্রচারণা চালানো ইত্যাদির মাধ্যমে ন্যায্য বিচার পাওয়া সম্ভব- এই কথাগুলোই যেন বলতে চেয়েছে চলচ্চিত্রটি।
Feature Image: dbs.ie