বিস্তীর্ণ প্রান্তর, যতদূর চোখ রাখা যায়। তবে প্রাণশূন্য নয় ফ্রেমটা। বরঞ্চ গোটা ফ্রেমে প্রভাব বিস্তার করছে দূরের ওই দু’জন ঘোড়সওয়ারি। এক্সট্রিম লং শটে তাদের আকৃতি এবং উপস্থিতি ইতোমধ্যেই ফ্রেমটাকে শক্তিশালী করে তুলেছে। এবং তারা যে সিনেমার প্রভাবশালী চরিত্র, সেকথা দর্শককে বুঝিয়ে দিতে এই এক্সট্রিম লং শটটি নেওয়া হয়েছে লো-অ্যাঙ্গেল থেকে। একদম প্রারম্ভিক এই দৃশ্যটি ওয়েস্টার্ন আবহকে পুরোপুরি ধারণ যেমন করেছে, তেমনি এই সিনেমার পরিচালক অ্যান্থনি মানের সিগনেচার স্টাইলের প্রকাশও ঘটিয়েছে। তার ওয়েস্টার্ন সিনেমার হিরোদের এভাবে লং শটেই তিনি পরিচয় করিয়ে দেন, ল্যান্ডস্কেপে হিরোদের আশপাশের জগত সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি।
নামের ক্রেডিট শেষ হবার পরপরই পর্দায় ভেসে উঠে সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য। ‘উইনচেস্টার’ মূলত একটি রাইফেলের নাম। আর এই রাইফেলের ১৮৭৩ সালের মডেলটি, সেকালে গোটা পশ্চিম জিতে নিয়েছিল। একটা উইনচেস্টার ‘৭৩ পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। রেড ইন্ডিয়ানরা তো এই রাইফেল কেনার জন্য নিজের আত্মাও বিক্রি করতে পারত। পর্দায় টাইটেল কার্ডের মতো ভেসে ওঠা এ তথ্যের পরপরই ইনসার্ট শটে দেখানো হয় উইনচেস্টার রাইফেল বাট। তারপর ফুল ফ্রেমে রাইফেলটিকে দেখানো হয়। গোটা সিনেমায় এই রাইফেল কী করে আধিপত্য বিস্তার করতে যাচ্ছে, সেটুকু রাইফেল বাটের ইন্সার্ট শটটাতেই পরিষ্কার করা হয় দর্শকের কাছে।
কাঁচের বাক্সে শোভা পেতে দেখা যায় উইনচেস্টার ‘৭৩ রাইফেলটিকে। উৎসুক জনতা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখছে রাইফেলটিকে। আর কথা চালাচালি করছে রাইফেলের জৌলুস নিয়ে। রাইফেলটি উন্মুক্ত প্রদর্শনের অবশ্য বিশেষ কারণ আছে। এক শ্যুটিং প্রতিযোগিতার পুরস্কার হতে চলেছে রাইফেলটি। জুলাইয়ের ৪ তারিখ, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। দিনটিকে উদযাপন করতেই এ আয়োজন। ওদিকে একদম মোক্ষম দিনেই ডজ নামক শহরটিতে পা দিয়েছে সিনেমার একদম শুরুর দৃশ্যে ঘোড়ায় চড়তে দেখা সেই দু’জনকে। শহরে পা দিয়েই শেরিফের নির্দেশে তাদের অস্ত্র গচ্ছিত রাখতে হলো। কারণ, ডজ সিটিতে বন্দুক বহন সংরক্ষিত।
সরাইখানায় প্রবেশ করতেই থমকে দাঁড়াল শহরে আসা এই দুই অতিথি, উল্টোদিকে দাঁড়ানো লোকটির দিকে তাকিয়ে। দু’জনের চোখে চোখে সেকেন্ডেই যে আগুনের বিনিময় হলো, তা বলে দিল- দু’জন পূর্বপরিচিত তো বটে, কিন্তু তা সুখকরের কাছাকাছিই নয়। বন্দুক সাথে থাকলে মুহূর্ত শেষের আগেই চলত গুলিবর্ষণ। জমা দিয়েছে বলেই হয়তো রক্ষা! কিন্তু ওই আগুন তো নিভবে না। অগত্যা দু’জনে অংশ নিলো প্রতিযোগিতায়। দু’জনের বন্দুকের নিশানা দেখে মনে হলো, এ নেহাতই খেলনা তাদের কাছে। প্রত্যাশিতভাবেই ফাইনালে দু’জন মুখোমুখি আবার।
কিন্তু পিছু হটছে না কেউই। শূন্যে পয়সা উড়িয়ে দিলে তাতেও নিখুঁত নিশানায় গুলি ছুঁড়ল দু’জনে। তবে এই শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলো অবশেষে লিন ম্যাকঅ্যাডাম, সেই ঘোড়সওয়ারি। মুহূর্তেই এই রাইফেল হয়ে উঠল তার সম্মানের প্রতীক, বীরত্বের প্রতীক। হাতে নিলেই সম্মানের ভারটা নির্বোধ ছাড়া বুঝে আসবে যে কারো। কিন্তু লিনের সেই পুরনো শত্রু, নাম তার ডাচ হেনরি, চুরি করলো রাইফেলটি। সম্মানটায় হাত দিলে গর্জে উঠবে যে কেউ। আর সে যদি হয় লিনের মতো এমন ‘পৌরুষে ভারি ব্যক্তি’, তবে তো কী ঘটবে, বলাই বাহুল্য। ডাচ হেনরির সাথে একে তো লিনের অব্যক্ত শত্রুতা, যার প্রকাশ ঘটে সিনেমার সমাপ্তি অংশে, তার উপর বীরত্বের প্রতীকটাও ছিনিয়ে নেওয়া, এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস।
লিন, তার সহযোগীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘোড়ায় চড়ে। শুরু হলো উইনচেস্টার ‘৭৩ ফের জেতার যাত্রা। তবে এ যাত্রা জটিল। ক্রমাগত হাতবদল হতে থাকল রাইফেলটি। লিনের যাত্রাপথেও যোগ হতে থাকল কিছু গৌণ চরিত্র, যাদের ধরে গল্প পেতে থাকে কিছু নতুন মোড়। সেসব নিয়েই এগিয়ে যেতে থাকলো ধোঁকা আর প্রতিশোধের গল্পের, ধুলোয় মোড়া এই রুক্ষ ওয়েস্টার্ন।
ওয়েস্টার্ন জনরাটিকে অলংকরণের প্রসঙ্গ আসলে, অবধারিতভাবেই এসে যাবে মাস্টার ফিল্মমেকার ‘জন ফোর্ড’-এর নাম। ৩০ দশকের শেষদিকে ‘স্টেজকোচ’ (১৯৩৯) সিনেমাটি দিয়ে তিনি আসন্ন দশকের জন্য এই গোটা জনরার একটা আর্কিটাইপ দাঁড় করিয়ে দেন। গোটা ৪০ দশকেই অনেক ক্লাসিক ওয়েস্টার্ন সিনেমা পাওয়া গেছে। তবে এই জনরার সোনালি দশক ধরা হয় ৫০’কে। আর সেই ৫০ দশকের ওয়েস্টার্নকে একটি নতুন ধাঁচে নিয়ে আসার পেছনে ভূমিকা রেখেছে আজকের আলোচ্য এই উইনচেস্টার ‘৭৩।
৫০ দশকে ওয়েস্টার্ন জনরার পুনরুত্থানে যে সিনেমাগুলো চালকের ভূমিকা পালন করছে, তাদের মধ্যে অ্যান্থনি মানের এই সিনেমা, একটি। ওয়েস্টার্নের ন্যারেটিভে ভিন্নতা তো এনেছেই, পাশাপাশি ওয়েস্টার্ন জনরার যে অলংকারগুলোকে আজ চেনাজানা, গড়পড়তা বা ক্লিশে বলে সম্বোধন করা হয়; সেসব অলংকারকে জনপ্রিয় করেছে এই সিনেমা। অলংকারগুলোর কথা বললে শুরুতেই আসবে সেই চিরচেনা ভালোমন্দের বিরোধ। ওই বিরোধ দেখা যায় এ সিনেমায়ও। প্রধান দু’জন খলনায়কের একজন পুরোদস্তুর খলনায়ক, মায়াদয়াহীন। আরেকজন ডাচ হেনরি, তুলনামূলক ধূসর রেখায় বাস করে। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত। অপেক্ষাকৃত নিগূঢ় এবং গভীরতাসম্পন্ন চরিত্র।
তবে চেনা সীমারেখায় উইনচেস্টার ‘৭৩ ভিন্নতা টেনে দিয়েছে হিরো চরিত্রটিতে। পূর্বেকার ওয়েস্টার্ন সিনেমার অকপট বৈশিষ্ট্য এই কাউবয় চরিত্রটি ধারণ করলেও, জটিলতা আছে পরিষ্কারভাবেই। হিরো চরিত্র হিসেবে যথেষ্ট অন্ধকারাচ্ছন্ন চরিত্র এটি। তার আচরণে প্রকাশ পায় একধরনের আচ্ছন্নতা। অতীতের নানান ঘটনা হতে উদ্ভূত জটিলতা তার মনস্তত্ত্বে প্রভাব রাখে এবং সেই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাই তার নানান কাজেকর্মে প্রতিফলিত হয়। আর হিরো চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে ভোগার এই দিকটিই ভিন্নতা প্রদান করে গল্পের গোটা কাঠামোতে।
৫০ দশকে, পরবর্তীর ক্লাসিক ওয়েস্টার্ন সিনেমাগুলোও উইনচেস্টার ‘৭৩-এর ধারায় সাইকোলজিক্যাল ড্রামা হয়ে উঠেছিল এদিক হতে। সিরিয়াস হয়ে উঠেছিল আগের দশকের ওয়েস্টার্নগুলো থেকে। তবে ওয়েস্টার্ন মিথটাও আবার রক্ষা করেছে এই সিনেমা। হিরো লিনের চরিত্রটি যে ‘মোরাল কোড’ অনুসরণ করে, সেটিই এই ওয়েস্টার্ন মিথ। আবার নগ্ন ভায়োলেন্সই চরিত্রটিকে দিয়েছে একজন অন্ধকারাচ্ছন্ন, জটিলতাপূর্ণ হিরোর রূপরেখা। জেমস স্টুয়ার্টের অনবদ্য অভিনয়শৈলী চরিত্রটিতে দিয়েছে পূর্ণতা। জেমস স্টুয়ার্টের আগের চরিত্রগুলো হতে অনেক বেশি প্রলেপিত, ‘পুরুষালি’ চরিত্র এটি। তার কমনীয় ইমেজটা তিনি এই সিনেমায় ঝেড়ে ফেলেছেন অনেকখানি। পরিচালক অ্যান্থনি মানের সাথে আরো বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন জিমি স্টুয়ার্ট। এবং সবক’টিই ওয়েস্টার্ন। একটা ক্লাসিক ওয়েস্টার্ন সিরিজ বলা যেতে পারে। দু’জনে মিলে ওয়েস্টার্নে সাইকোলজিক্যাল ড্রামার এই কোণকে জনপ্রিয় করেছেন।
লিন ম্যাকঅ্যাডাম চরিত্রটির বেদনা বয়ে চলার দিকটি আবার পরিচালক অ্যান্থনি মানের স্বকীয় ধারার দিকটকে প্রতিফলিত করে। শুধু হিরো চরিত্রটিই নয়, তার সিনেমার বাকি মুখ্য চরিত্রগুলোও একটা চাপা বেদনা বহন করে। শেলি উইন্টার্স অভিনীত সিনেমার একমাত্র কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রটিও এক্ষেত্রে ভিন্ন নয়। নানান পুরুষের হাতে পড়তে হয় তাকে। অবশেষে সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার আর্কিটাইপ তো আছেই। তবে যন্ত্রণাভোগের পর্বটিও সুগঠিত।
সিনেমার পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং গাঢ় পৌরুষবোধে ভারি দিক দু’টিও অ্যান্থনি মানের স্বকীয়তাকে আরো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। তার বাকি সিনেমাতেও পাওয়া যায় এই বিষয়গুলো। উইনচেস্টার ‘৭৩-এ পৌরুষবোধের পরিচায়ক হয়ে ওঠে খোদ রাইফেলটি। যার হাতে থাকে, তার মাঝেই এক অদম্য সাহস জেগে উঠতে দেখা যায়। এভাবে করে রাইফেলটি নিজেই একটি চরিত্র হয়ে ওঠে সিনেমার। সিনেমার নামটিও সে ধারণাকে আরো জোরদার করে। তবে যে অলংকারগুলোকে সিনেমাটি চর্চিত করেছে, তার মাঝে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়েছে রেড ইন্ডিয়ানদের চিত্রিত করার বিষয়টি। চিত্রনাট্যে যথেষ্ট একমাত্রিক এবং সংকীর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাদের। তবে সূক্ষ্ম রসবোধের দিকটি আবার অসচরাচর হয়ে ধরা দেয় এই সিনেমায়। দর্শকের চোখের আড়ালে যেন মাঝে মাঝে এই সিনেমা নিজেকে অতি সিরিয়াসভাবে না নিয়ে, হালকাচালেই চলেছে।
উইনচেস্টার ‘৭৩-এর চরিত্রায়ন এবং বিষয়াদি, অ্যান্থনি মান এবং জেমস স্টুয়ার্টের জুটির পরবর্তীকালের ‘বেন্ড অভ দ্য রিভার’ (১৯৫২), ‘দ্য নেকেড স্পার’ (১৯৫৩), ‘দ্য ফার কান্ট্রি’ (১৯৫৫) সিনেমাগুলোর মাধ্যমে সুপরিচিত এবং পরিচালক অ্যান্থনির সিগনেচার হয়ে উঠেছিল। ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের ক্ষেত্রেও অনেককিছু তিনি এ সিনেমাতেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। ৫০-এ ওয়েস্টার্ন জনরায় ভিড়বার আগে অ্যান্থনি ‘ফিল্ম-নোয়াহ্’ জনরায় কাজ করেছিলেন। একজন দক্ষ জনরা পরিচালক তো সেক্ষেত্রে হয়ে উঠেছিলেনই, সাথে মিশ্রণটাও আয়ত্ত করেছেন। তাই সে দিকটা থেকেই ওয়েস্টার্ন সেটিংয়ে তিনি ফিল্ম-নোয়াহ্’র আউটলুক এনে দিয়েছেন এ সিনেমায়।
প্রথমত, তিনি সিনেমাটি শ্যুট করেছেন একাডেমি রেশিওতে, যে রেশিওতেই ফিল্ম-নোয়াহ্ নির্মিত হতো। আর দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি হলো; তিনি লো-কি লাইটিং এবং সাদাকালো সিনেমাটোগ্রাফিই বেছে নিয়েছেন, যেটি ছিল ফিল্ম-নোয়াহ্’র স্বকীয় ভিজ্যুয়াল স্টাইল। একাডেমি রেশিও হওয়ায় অ্যান্থনি স্বভাবতই ল্যান্ডস্কেপগুলোতে ভার্টিক্যাল অ্যাঙ্গেল বেছে নিয়েছেন। বিস্তীর্ণ তৃণভূমির ভার্টিক্যাল ল্যান্ডস্কেপগুলো আক্ষরিক অর্থেই সুন্দর। তবে এই ভার্টিক্যাল সেটআপের সবচেয়ে চমৎকার ব্যবহার দেখা যায়, সিনেমার ফাইনাল শো-ডাউনে। এই সেটআপ লিন এবং ডাচ হেনরির মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক এবং শারীরিক দ্বন্দ্বকে যেমন তুলে ধরছিল, তেমনি হেনরির ধূর্ত এবং প্রভাব বিস্তারকারী স্বভাবের বিপরীতে বারবার শটের অ্যাঙ্গেল পরিবর্তন করে লিনের দৃঢ়তাকেও স্থান দিচ্ছিল।
শুধু সে কারণেই নয়, সিনেমার ফাইনাল শো-ডাউনটি স্মরণীয় হয়ে আছে ‘মিজ-অঁ-সেন’ ব্যবহারের জন্য। ভার্টিক্যাল ল্যান্ডস্কেপকে ব্যবহার করে একটি অ্যাকশন দৃশ্যে মিজ-অঁ-সেনের ব্যবহার সময় অনুযায়ী হঠকারিই ছিল এবং আজো আছে। প্রারম্ভিক দৃশ্য হতেই স্বকীয়তা বহন করা এই সিনেমার নানান অলংকার, স্টাইল পরিচালক অ্যান্থনি মানের পরবর্তীর ওয়েস্টার্ন সিনেমাগুলোয় তো বটেই, এমনকি ৫০ দশকের আরো সুপরিচিত ওয়েস্টার্নে প্রতিভাসিত হওয়ার মধ্য দিয়েই ক্লাসিকের স্থানে আসীন হয়েছে উইনচেস্টার ‘৭৩।