বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’-এর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন শ্যাম বেনেগাল। ভারতে প্যারালাল সিনেমার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। ভারতীয় চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যেতেও রেখেছেন অবিস্মরণীয় অবদান। হিন্দিতে সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তো তিনি পেয়েছেনই, সেই সঙ্গে ভূষিত হয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারেও।
অসম্ভব গুণী এই পরিচালক অবশ্য নিজের সফল চলচ্চিত্র-নির্মাতা হয়ে ওঠার পেছনে কৃতিত্ব দেন সত্যজিৎ রায়কে। তার মতে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে দ্বিখণ্ডিত করা যেতে পারে সত্যজিৎ রায়ের আগে-পরের হিসেবে। ২০২১ সালের নভেম্বরে ভারতীয় ম্যাগাজিন ফ্রন্টলাইনে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেন শুধুই সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন জিয়া উস সালাম।
আপনি সত্যজিৎ রায়ের উপর একটি চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন। তথ্যচিত্রটি নির্মাণের সময় আপনাকে সাহায্য করতে তিনি কতটা আন্তরিক ছিলেন? সাধারণত, তিনি তো পরিচিত ছিলেন অনেক ধীরস্থির স্বভাবের মানুষ হিসেবে, এমনকি খানিকটা স্বল্পভাষীও।
বছর কয়েক আগে আমি তাকে নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি তার চলচ্চিত্রগুলোর প্রসঙ্গ আনি, ভারতীয় সিনেমাকে বিভক্ত করি প্রাক-সত্যজিৎ ও উত্তর-সত্যজিৎ যুগে। নয়া দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে আমি তাকে নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন দিই। আমি তাকে নিয়ে চলচ্চিত্রও বানিয়েছি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তাকে স্বল্পভাষী বললে ভুল হবে। তিনি কথাবার্তায় একটু সংযত ছিলেন বটে, কিন্তু তাই বলে লাজুক বা চাপা স্বভাবের মোটেই নয়। নিজের চিন্তাভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশে তিনি সদা সচেষ্ট থাকতেন, কিন্তু এর বাইরে তিনি ছিলেন খুবই সংযত। কোনো একটি প্রশ্ন করলেই সেটির ব্যাপারে নিজের মতামত জানাবেন, এমনটা তিনি ছিলেন না। অবশ্য ডকুমেন্টারির জন্য আমি তাকে যা যা প্রশ্ন করেছিলাম, সবগুলোরই উত্তর দিয়েছিলেন।
আপনার প্রথম ছবি ‘অঙ্কুর’-কে তিনি কতটা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন?
তিনিই প্রথম ব্যক্তি যাকে আমি আমার ছবিটি দেখিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন এমন একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা, যার মতামতকে আমি ভীষণ রকমের শ্রদ্ধা করতাম, এবং চাইতাম তিনি যেন আমার ছবিটি দেখেন।
এবং এরপর থেকে আপনি তাকে আপনার প্রতিটি ছবিই দেখাতে থাকেন, তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে শুরু করার আগপর্যন্ত…
হ্যাঁ, আমি তা-ই করেছিলাম, যতদিন না তার পক্ষে ছবিগুলো দেখা দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল (শারীরিক কারণে)। আমি নিশ্চিতভাবেই তাকে আমার বানানো প্রথম সাতটি ছবির মধ্যে ছয়টি দেখিয়েছিলাম।
তিনি কি মাঝেমধ্যে ছবিগুলোর সমালোচনা করতেন, নাকি কেবলই প্রশংসায় ভাসাতেন?
হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে তিনি খুব কঠিন সমালোচনা করতেন। এই পুরো আইডিয়াটাই [তাকে ছবি দেখানোর] ছিল এজন্য যে আমি একটি বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিক্রিয়া আশা করছিলাম, একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতার প্রতিক্রিয়া, এমন একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা যিনি তার নৈর্ব্যক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আমাকে জানাবেন। এবং তিনিই [সত্যজিৎ রায়] ছিলেন সেরকম একজন মানুষ, যাকে আমি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারতাম। তাকে আমার ছবিগুলো দেখাতে পারা ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি ব্যাপার। কোনো কোনো বন্ধু আছে যারা মুখের উপর শুধু ভালো ভালো কথাই বলত। কিন্তু তার কাছ থেকে আমি সৎ মূল্যায়ন পেতাম।
তিনি সবসময় আপনাকে একজন ছাত্র বা শিষ্য বলে মনে করতেন?
ঠিক একজন শিষ্য বা ছাত্র নয়। আমি তো তার ছাত্র ছিলাম না। আমি তার সঙ্গে কাজও করিনি। আমি তাকে একজন সিনিয়র চলচ্চিত্র-নির্মাতা ভাবতাম, যিনি জানতেন যে তার দৃষ্টিভঙ্গি আমি বুঝতে পারব। নিজের অবস্থানের কারণে তিনি সবসময় সবার ব্যাপারে মতামত দিতেন না। তিনি জানতেন, তার মতামত অনেক তরুণ চলচ্চিত্র-নির্মাতার ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। খুবই পরিমিতভাবে তিনি নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন।
প্রথমবার ‘নায়ক’ ছবির শ্যুটিং চলাকালীন আপনি তার সঙ্গে দেখা করেন, এবং তারপর তার কাজের উপর একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করতে শুরু করেন?
যখন তিনি ‘নায়ক’ বানাচ্ছিলেন, তখনই আমি তাকে নিয়ে ফিল্ম করি। যখন তিনি ‘নায়ক’-এর শ্যুটিং করছিলেন, তখন আমি তার উপর একটি ছবি বানাচ্ছিলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন তার শ্যুটিং চলাকালীন ডকুমেন্টারির শ্যুটিং করার।
ক্যামেরার শব্দের কারণে তার সমস্যা হতো না?
না, না। তিনি জানতেন আমি তাকে বিরক্ত করব না, কিংবা তার কাজের মধ্যে বাগড়া দেবো না।
ডকুমেন্টারিটি শেষ করতে আপনার কতদিন লেগেছিল?
অনেক দীর্ঘ সময় লেগেছিল। ঠিক কত সময় লেগেছিল তা অবশ্য আমার মনে নেই। সরকারের সঙ্গে জোট বেধে কোনো চলচ্চিত্র বানাতে গেলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। অর্থনৈতিক নানা ঝক্কি-ঝামেলা ছিল। শুরুতে কথা ছিল আমি মাত্র ২০ মিনিটের একটি ছবি বানাবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি যে ছবিটি বানাই, সেটি ছিল প্রায় আড়াই ঘণ্টা লম্বা। তো স্বাভাবিকভাবেই টাকাপয়সা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আমাকে নিজের পকেট থেকেও টাকা ব্যয় করতে হয়। সরকার রাজি ছিল না আরো বেশি টাকা খরচ করার ব্যাপারে।
ডকুমেন্টারিটির ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভালসহ অন্য আরো কিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যখন এটি দেখানো হয়, সবাই খুব প্রশংসা করে। এটি দেখানো হয় ইতালি, ফ্রান্স, শিকাগো, স্যান ফ্রান্সিসকো ইত্যাদি জায়গায়। সবখানেই এটি ভালো রিভিউ পায়। এর পথচলা ছিল উৎসবমুখর।
সত্যজিৎ রায় নিজে কি ডকুমেন্টারিটি নিয়ে খুশি ছিলেন? তার কি মনে হয়নি এটি অনেক বেশি ব্যক্তিত্ব-কেন্দ্রিক?
শুরু থেকেই তিনি খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরির ব্যাপারে। মূলত ভারত সরকারই আমাকে বলেছিল তাকে নিয়ে ছবি বানাতে, কেননা তিনি ইতোমধ্যেই পদ্মভূষণ পেয়ে গেছেন, এবং পরে তো ভারতরত্নও লাভ করেন [মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে]। কিন্তু আমার মনে হয় না ছবিটির ব্যাপারে তার এ ধরনের কোনো অভিযোগ ছিল।
এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, প্রথমবার ‘পথের পাঁচালী’ নাকি দেখেছিলেন কলকাতায় একটি সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে গিয়ে…
হ্যাঁ, এটা সত্যি কথা। আমি তখন কলকাতায় গিয়েছিলাম একজন সুইমার হিসেবে, কিন্তু সেবারই ডজনখানেকবার দেখে ফেলি ‘পথের পাঁচালী’। আমি প্রতিদিনের প্রথম ও শেষ শো দেখতাম।
অমন অভিজ্ঞতার পর, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে ডকুমেন্টারি বানানোটা নিশ্চয়ই একটি মস্ত বড় সাফল্য বলে মনে হয়েছিল আপনার কাছে?
তিনি ‘পথের পাঁচালী’ বানানোর অনেক পরে আমাকে ডকুমেন্টারিটি বানাতে বলা হয়। আমি ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছিলাম ১৯৫০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্তাব আসে এরও অনেক পরে। ততদিনে আমি নিজেও কয়েকটি চলচ্চিত্র তৈরি করে ফেলেছি।
আপনি যাকে আদর্শ বলে মনে করতেন, সেরকম একজন মানুষের উপর ছবি বানাতে গিয়ে কেমন অনুভূতি হয়েছিল?
আমি ব্যাপারটিকে অমন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি না। শুধু এটুকুই বলতে পারি, সত্যজিৎ রায় ছিলেন একজন অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ, বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব। তার ছিল নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান। জীবন সম্পর্কে তার একটি সমাজ-রাজনৈতিক দর্শন ছিল, যা আপনি তার চলচ্চিত্রেও দেখতে পাবেন। তিনি যে সংস্কৃতি থেকে এসেছেন, সেই সংস্কৃতিরও প্রতিফলন ঘটে তার ছবিগুলোতে।
ওই সংস্কৃতি, অর্থাৎ বাংলা সংস্কৃতিই কি, তাকে আরো বেশি হিন্দি ছবি করতে দেয়নি?
তিনি কেবল একটি [হিন্দি] ছবি বানিয়েছেন, ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’। তিনি বলতেন, তিনি নাকি ভাষাটির সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ পরিচিত নন যে একটি কাহিনির সকল খুঁটিনাটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হবেন। বাগধারা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না। সে তুলনায় বাংলায় ছবি বানানোর ব্যাপারে তিনি অনেক বেশি স্বস্তিবোধ করতেন। কোনো কিছুতেই তার ভুল হতো না। সকল নিয়ন্ত্রণ থাকত তার নিজের কব্জায়, এবং এক্ষেত্রে তাকে একটি ভাষা বা সংস্কৃতির ইন্টারপ্রিটেশনে অন্য কারো উপর নির্ভর করতে হতো না।
এটি বলা কি জুতসই হবে যে সত্যজিৎ রায় আপনার, বা আদুর গোপালকৃষ্ণন, গৌতম ঘোষ বা অন্যদের মতো একটি প্রজন্মের চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করেছেন?
হ্যাঁ, সেটি তিনি করেছেন, নিশ্চিতভাবেই করেছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ অনুপ্রেরণার উৎস। খেয়াল করে দেখবেন, তখনকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একটি নির্দিষ্ট ঘরানার ছবি দাবি করত, মূলত বিনোদন-নির্ভর, যেন সেটি বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পায়। বোম্বের (মুম্বাই) ছবি একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলার গণ্ডিতে ঘুরপাক খেত। সেগুলোতে কিছু চিরাচরিত ধারাবাহিকতা এবং অনুমেয় উপাদান রাখতে হতো। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সেই ঘেরাটোপ ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নিজস্বতা সৃষ্টি করেছিলেন, নিজস্ব নিয়মকানুন তৈরি করেছিলেন। [ভারতীয়] চলচ্চিত্রকে, যেমনটি আমি প্রায়ই বলি, দুই ভাগে ভাগ করা যায়, সত্যজিৎ রায়-পূর্ব যুগ এবং সত্যজিৎ রায়-পরবর্তী যুগ।