“প্রেয়সীর পাশে বসে থাকা এক ঘণ্টা মনে হয় এক সেকেন্ড আর জলন্ত অঙ্গারে বসে থাকা এক সেকেন্ড যেন এক ঘণ্টা, এর নামই আপেক্ষিকতা”
খুব সাধারণ এই কথাগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে হাতে-কলমে যিনি প্রমাণ করেছিলেন, সেই আইনস্টাইনের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। কল্পনা করার এক অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন এই বিজ্ঞানী। আর এই ক্ষমতাই তাকে করে তোলে অন্য সবার থেকে আলাদা। আইনস্টাইনের জীবনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তৈরি করেছে তাদের সিরিজ Genius এর প্রথম সিজন।
দশ পর্বের এই সিরিজে আইনস্টাইনের জীবনের নানা অদেখা দিক, তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাদার জীবনের নানা অজানা তথ্য সামনে চলে আসে দর্শকের। আইনস্টাইন তার কলেজ জীবন বার্লিনে শুরু করলেও সেখানে শেষ করা হয়নি। শিক্ষকদের কাছে তিনি ছিলেন অবাধ্য, উদ্ধত ছাত্র। কারণ? তিনি প্রশ্ন করতে ভালবাসতেন। তিনি ছিলেন অজানাকে জানার জন্য উন্মুখ। তার কল্পনার জগতে একের পর এক তিনি মুখোমুখী হতেন নানা প্রশ্নের। যার জবাব চাইতে গেলে পড়তে হতো শিক্ষকদের রোষানলে। তারা ভাবতেন, তাদের নাস্তানাবুদ করতেই বুঝি এসব প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন আইনস্টাইন।
আইনস্টাইনের বাবা শুধু চাইতেন ছেলে একটা ডিগ্রি হাসিল করুক। তাই তাকে বার্লিন রেখেই তিনি চলে আসেন ইতালি। কিন্তু জার্মান শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নাখোশ আইনস্টাইন বাবার আদেশ অমান্য করেই লেখাপড়া অপূর্ণ রেখে চলে আসেন ইতালি। শুরু করেন জুরিখ পলিটেকনিক কলেজে ভর্তির জন্য চেষ্টা। নতুন দেশ, নতুন ভাষা, তার উপরে ফ্রেঞ্চ, সাহিত্য, দর্শনে তার নেই কোনো মনোযোগ। গণিত, পদার্থবিজ্ঞানে তার নাম্বার দেখে অভিভূত হয়ে তাকে আবার সুযোগ দেন। পরের বছর ফ্রেঞ্চ, সাহিত্য আর দর্শনে কোনোরকমে পাস করে জুরিখ পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হন আইনস্টাইন।
ক্লাসের প্রথমদিনেই তার দেখা হয় মেলিভা মেরিকের সাথে। ক্লাসের একমাত্র নারী শিক্ষার্থী, যিনি কিনা ভর্তি পরীক্ষায় গণিতে তার চেয়ে বেশি নাম্বার পেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। সে যুগে মেয়েদের লেখাপড়াকে এতটা উৎসাহিত করা হত না। বিজ্ঞানে তাই মেয়েদের এতদূর লেখাপড়া করাটা ছিল তাই দুরূহ ব্যাপার। প্রথমদিনেই তার জ্ঞানের প্রতি মুগ্ধ হন আইনস্টাইন। সেই মুগ্ধতা ধীরে ধীরে রূপ নেয় ভালবাসায়। পরবর্তীতে এই মেলিভা মেরিকই হন তার জীবনসঙ্গিনী। এই দুজন জ্ঞানপিপাসু মানুষের ভালবাসার কথোপকথন আর দিনগুলো সুন্দরভাবে চিত্রায়িত হয়েছে প্রথমদিকের পর্বগুলোতে।
আইনস্টাইন ভেবেছিলেন, ইতালিতে পরীক্ষার ফলাফলের কারণে শিক্ষক সহযোগী হয়ে যোগদান করাটা সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু তার অতি উৎসাহী ধর্ম সব সময়েই ছিল শিক্ষকদের অসন্তুষ্টির কারণ। বিভিন্ন কারণে একটা চাকরি ছিল তার জন্য খুবই জরুরি। তাই বন্ধুর পরামর্শে পেটেন্ট অফিসের ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু তার মনে সব সময়ই ছিল বড় কিছু করার আকাঙ্ক্ষা। পেটেন্ট অফিসে দিনে কাজ করে, রাতের পর রাত জেগে লিখতে থাকেন নতুন নতুন পেপার। কিন্তু একজন পেটেন্ট ক্লার্কের কথার মূল্য কেন দেবে বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা? তাই নজর কাড়তে সমর্থ হয় না আইনস্টাইনের ফোটনের তাৎপর্য নিয়ে লেখা পেপারটি। অথচ পরবর্তীতে এই ফোটন আবিষ্কারের জন্যই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন এই বিজ্ঞানী।
অদম্য ইচ্ছার জোরে একই বছর প্রকাশ করেন আরো তিনটি পেপার, যার মধ্যে একটি ছিল স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি নিয়ে। এই পেপার গণ্যমান্য বিজ্ঞানীদের নজর কাড়তে বাধ্য হয়। এসকল পেপারে সহযোগী ছিলেন তার সহধর্মিণী মেলিভা মেরিক। আইনস্টাইনের জীবনে তার প্রাপ্তির অর্ধেক দাবিদার আসলে তার এই স্ত্রী। সিরিজের বিভিন্ন পর্বে তা স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে।
থিওরি অফ রিলেটিভিটির পেপারটি আইনস্টাইনকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে এনে দেয় কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি। অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ইউনিভার্সিটি অফ বার্নে। তার পেশাদার জীবনে উত্তরোত্তর উন্নতি হতে থাকলেও অবনতি হতে থাকে স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের। ততদিনে তিনি দুই ছেলের পিতা হয়েছেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেশায় তিনি অবহেলা করেছেন তার পরিবারকে। এককালের প্রেয়সী, কাজের সহকর্মীর সাথে এই দ্বন্দ্ব একপর্যায়ে রূপ নেয় বিচ্ছেদে। কেননা আইনস্টাইন তখন বুঁদ হয়েছেন তার মায়ের দিকের সম্পর্কিত এক বোনের প্রেমে।
মেলিভা মেরিকের সাথে দাম্পত্য জীবন শেষ হয়েছিল বেশ তিক্তভাবে। এককালের প্রেয়সী ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছিলেন জীবনের কাঁটায়। সম্পর্কের শেষদিকে তাকে সহ্য করতে হয়েছে আইনস্টাইনের দুর্ব্যবহার, অবহেলা আর উদ্ভট সব বিধিনিষেধ। আইনস্টাইনের পেশাদার জীবন যতটা আলোচিত, তার ব্যক্তিগত জীবনও তাই। জীবনে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন বেশ কিছু নারীর। সিরিজটিতে সেই অজানা তথ্যগুলো উন্মোচিত হয়েছে দর্শকদের সামনে। তার দ্বিতীয় স্ত্রী এলসা ছিলেন বেশ বুদ্ধিমতী ও চৌকস। আলাভোলা আইনস্টাইনকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত আগলে রেখেছেন পরম যত্নে।
আইনস্টাইনের চলার পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। শুরুর দিকে সংগ্রাম করেছেন আলোচনায় আসার জন্য, পরবর্তীতে আলোচনার শীর্ষবিন্দু হয়েও সংগ্রাম করতে হয়েছে নোবেল পুরস্কারের জন্য। বার বার তার মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। কারণ তিনি ছিলেন ইহুদি। তার বিরোধিতা করেছেন বড় বড় অনেক বিজ্ঞানী। ধর্মের এই টানাপোড়েন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ- এ সবকিছুই অল্প অল্প করে উঠে এসেছে সিরিজটিতে। পরিশেষে যদিও নোবেল এসেছে তার ঘরে, কিন্তু তা তার অবিস্মরণীয় উদ্ভাবনটির জন্য নয়। কারণ প্রতি পদে আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে হতে হয়েছে সমালোচনার সম্মুখীন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে ইহুদিদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। হিটলারের দায়িত্বগ্রহণের পর একপ্রকার বাধ্য হয়ে এই বিজ্ঞানীকে পাড়ি জমাতে হয় আমেরিকায়। কিন্তু তারপরও ইহুদিদের সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে কাজ করে গেছেন। নির্যাতিত, নিপীড়িত, জ্ঞানপিপাসু মানুষদের জন্য তার দরজা ছিল সবসময় খোলা। অথচ এই মানুষটিই কীভাবে নিজের সন্তানদের অবহেলা করেছেন তা সিরিজটি না দেখলে হয়তো বোঝা যেত না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই শান্তিপ্রিয় মানুষটিই মার্কিন সরকারকে সাহায্য করেন পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারে। তার উদ্দেশ্য জার্মানের হিটলারকে পরাজিত করা হলেও তাতে আক্রান্ত হয় জাপানের লাখ লাখ নাগরিক। মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই অপরাধবোধ তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে।
আইনস্টাইন ছিলেন তার যুগের সেরা বিজ্ঞানী। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলেন। তার ছিল লাখো ভক্ত আর শুভানুধ্যায়ী। কিন্তু ধর্ম আর তার স্বভাব আচরণের জন্য সমালোচক, এমনকি শত্রু পর্যন্ত জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। শিকার হয়েছেন নানা চক্রান্তের। যা বিশ্বাস করতেন তা প্রমাণের জন্য পাহাড় ওল্টানোর মনোবল রাখতেন তিনি। ছিলেন একজন চমকপ্রদ বক্তা। সিরিজটিতে তার এসব দিক খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সামনে এসেছে তার পরিবারের সাথে সম্পর্কের বিভিন্ন দিক। তৎকালীন বিজ্ঞানীদের অবস্থান, বিজ্ঞানচর্চার উপর যুদ্ধের প্রভাব এ সকল বিষয়।
জিনিয়াস সিরিজটি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রথম লিখিত ড্রামা সিরিজ। সিরিজটির আইএমডিবি রেটিং ৮.৪। সিরিজটি পরিচালনা করেছেন একাডেমি অ্যাওয়ার্ড খ্যাত পরিচালক রন হাওয়ার্ড। যুবক আইনস্টাইনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জনি ফ্লিন এবং বৃদ্ধ আইনস্টাইনের ভূমিকায় ছিলেন জেফরি রাশ। এই দুজন অভিনেতা আইনস্টাইন চরিত্রটিতে প্রাণ নিয়ে এসেছেন। এছাড়া অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চমকপ্রদ এবং সাবলীল অভিনয়ও ছিল উল্লেখযোগ্য। সিরিজে ব্যবহৃত হয়েছে ‘Assassin Creed’ খ্যাত লর্ন ব্যালফের সৃষ্ট মনোমুগ্ধকর মিউজিক কম্পোজিশন। আর টাইটেল মিউজিক ছিল হ্যান্স জিমারের, যিনি কিনা ক্রিস্টোফার নোলানের বিভিন্ন মুভির মিউজিক কম্পোজিশনের জন্যও বিখ্যাত।
একজন সাধারণ মানুষ কী করে তার কল্পনাশক্তি আর উৎসাহী স্বভাবের জন্য অসাধারণ হয়ে উঠতে পারেন তা চিত্রায়িত হয়েছে এই সিরিজে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে অনেকের পরিচিতি থাকলেও ব্যক্তিজীবনের আইনস্টাইন হয়তো ছিলেন অনেকের আড়ালে। সিরিজটি দেখলে ব্যক্তি আইনস্টাইন সম্পর্কে অনেকটাই ধারণা পাওয়া যায়। পরিচয় হয় আইনস্টাইনের ছায়ায় ঢেকে যাওয়া এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ত্ব মেলিভা মেরিকের সাথে। সিরিজটি দেখে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্যে ক্ষণে ক্ষণে জন্ম নেয়া বিভিন্ন অনুভূতি শেষ র্যন্ত পরিণত হয় শ্রদ্ধায়। সর্বোপরি, বিভিন্ন সত্য ঘটনা ও নাটকীয়তার সংমিশ্রণে তৈরি এই সিরিজটি সকল দর্শকের মনে প্রেরণা যোগায়, উৎসাহী করে তোলে বিজ্ঞানের প্রতি।
ফিচার ইমেজ: seriesDetail.com