ড্রাগন একটি মিথ, ড্রাগন একটি লিজেন্ড। লেখকেরা কল্পনার পাখায় রঙ চড়িয়ে যুগে যুগে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন বৈচিত্র্যময় নানা ড্রাগন চরিত্র। আধুনিক যুগে এসে সেই চরিত্রগুলো বিশালকায় ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে বড় এবং ছোট পর্দায়, মুগ্ধ করছে লাখো দর্শককে। সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিন ফ্র্যাঞ্চাইজির ড্রাগনগুলোর ক্ষমতা নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
হাঙ্গেরিয়ান হর্নটেইল
ঐতিহ্যবাহী ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্ট এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে হগওয়ার্টসে। গবলেটে নাম ওঠার পর হ্যারি পটার পড়লো বিপদে। টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। প্রথম টাস্কেই তাকে মুখোমুখি হতে হবে ড্রাগনের, উদ্ধার করে আনতে হবে গোল্ডেন এগ। ওয়েলশ গ্রিন, চাইনিজ ফায়ারবল কিংবা সুইডিশ শর্ট স্নাউট হলে তা-ও কথা ছিল। কপালদোষে হ্যারির ভাগে পড়লো কুখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান হর্নটেইল। হ্যাগরিডের ভাষায় যারা “Right nasty piece of work“।
লেজের ওপর তীক্ষ্ণ কাঁটা বসানো বলেই ড্রাগনটির এরকম নাম। কালো রঙের বিশালদেহী এই ড্রাগন আগাগোড়াই একটা মারণাস্ত্র। হলুদ চোখের মণিটা দিয়ে শিকারকে সম্মোহন করে সহজেই। নিজের শ্বাসের আঁচেই পাথর লাল করে দেবার ক্ষমতা রাখে সে। কানফাটানো গর্জন আর আগুন ছুঁড়ে মারা তো সব ড্রাগনেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তারপরেও হর্নটেইলকে সবচেয়ে হিংস্র ড্রাগন বিবেচনা করে সবাই, সেটাই এর ভয়ানক ক্ষমতার বড় প্রমাণ। সবচেয়ে বড় কথা, ৫০ ফুটের এই ড্রাগনের গতিও দুর্দান্ত। হ্যারির দ্রুতগামী ফায়ারবোল্ট ব্রুমস্টিকের গতির সাথেও সমানভাবে পাল্লা দিয়েছিল সে।
স্মগ
সেলুলয়েডের ড্রাগনদের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ড্রাগন হলো স্মগ। সম্ভবত বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচের ভয়েস ওভার এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। হবিট ট্রিলজির ভিলেন এই ড্রাগনটির ব্যাকস্টোরিটাও বেশ সমৃদ্ধ। সে ছিল থার্ড এজের ফায়ার ড্রেক। রাজা থররের শাসনামলে সে ডোয়ার্ভদের রাজ্য আক্রমণ করে হীরা-মাণিকের লোভে, দখল করে নেয় লোনলি মাউন্টেন।
তার পুরো শরীর ছিল লোহার বর্মের মতো, তবে তারপরেও একটা দুর্বলতা ছিল তার পেটের কাছে। মণিমাণিক্যের স্তূপে গড়াগড়ি খেয়ে সেখানটায় পাথর আটকিয়ে নিয়েছিল সে। তার কাছে থাকা ধনসম্পদের সেরা রত্নটির নাম ছিল আরকেনস্টোন। রাজা থররের সিংহাসনের অংশ ছিল এটি। আরকেনস্টোনকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে অ্যাডভেঞ্চার শুরু করে বিলবো ব্যাগিন্সসহ হবিটদের একটি দল। পাহাড়ের ভেতরের গুপ্তপথ দিয়ে বিলবো ঢুকে পড়ে স্মগের আস্তানায়। স্মগের বিশালাকার রূপ দেখে পিলে চমকিয়ে গেলেও বিলবো কিন্তু ঠিকই তার দুর্বলতাটি জেনে আসে। এদিকে বিলবোকে দেখে রাগে ফেটে পড়ার বদলে কিছুটা যেন মজাই পায় স্মগ, শুরু করে তার লম্বা মনোলগ।
বিলবো এবং তার দলবল যে রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে, এটা বুঝতে দেরি হয় না তার। নিজের আস্তানা থেকে বেরিয়ে সে লেক টাউনে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো শুরু করে, আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়িয়ে দেয় সবকিছু।
And, most of all, have you not heard that I am the true King under the Mountain? Have you not heard of my fearsome glory?
ড্রোগোন
ড্রাগনমাতার অন্য দুই সন্তান ভিসেরিয়ন আর রেগালের চেয়ে একটু বেশিই মনোযোগ কাড়ে ড্রোগোন। লাল কালোয় মেশানো ড্রাগনস্কেল আর বিশাল বড় ডানার কারণে অন্য দুই ভাই থেকে আলাদা করা যায় তাকে সহজেই। সে ছিল রানী ডেনেরিস টারগারিয়েনের ব্যক্তিগত রাইড। গেম অফ থ্রোন্সের সেরা ড্রাগন মুহূর্তগুলোর মধ্যে বেশিরভাগেই তাই ড্রোগোনকে চোখে পড়ে। ছোটবেলাতেই হাউজ অফ আনডাইংয়ের ওয়ারলকের কাছ থেকে ডেনেরিসকে বেঁচে ফিরতে সাহায্য করেছিল ড্রোগোন। আস্টাপরের স্লেভ মাস্টার ক্রাহনিসের কাছে আনসালিড সৈন্যদের কেনার বিনিময়ে প্রথমে তাকে বেঁচে দেবার ভান করেছিলেন ডেনেরিস। পরে তার বিখ্যাত ভ্যালেরিয়ান বুলি ‘ড্র্যাকেরিস’ এর সাহায্যে সহজেই স্লেভ মাস্টারকে ড্রোগোনের আগুনে পুড়িয়ে মিরিন দখল করে নেন ডেনেরিস।
পরবর্তীতে অবশ্য নির্বিচারে পশুহত্যার কারণে শৃঙ্খলার বেড়াজালে আবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয় তিন ড্রাগনকেই। এ নিয়ে মায়ের সাথে মনোমালিন্য হলেও সন অফ হার্পিদের হামলার সময়ে ঠিকই ব্ল্যাক ক্লিফের পেছন থেকে উড়ে এসে তাকে বাঁচায় ড্রোগোন। এরপর বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সে। ল্যানিস্টার-টার্লি বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণের সময়ে স্করপিয়নের বর্শায় আহত হলেও জেইমি ল্যানিস্টারের হাত থেকে ঠিকই মাকে বাঁচায় সে। নাইট কিংয়ের উইট দলকে আগুনে পুড়িয়ে জন স্নো এবং তার দলকে রক্ষা করে সে। এরপরের ভয়ানক ব্যাটল অফ উইন্টারফেলে আইস ড্রাগন ভিসেরিয়ন আর উইট আর্মির সাথে ভয়ানক লড়াই করে সে। জীবনের সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ সে চালায় ব্যাটল অফ কিংস ল্যান্ডিংয়ের সময়। ডেনেরিসের নেতৃত্বে কিংস ল্যান্ডিং নিরীহ মানুষ কিংবা ল্যানিস্টার সৈন্যদল- সবাইকে নির্বিচারে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় সে, সাজানো গোছানো শহরটি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।
ক্ষমতার লড়াই
এই তিন বিখ্যাত ড্রাগনের মধ্যে কোনটি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী? তাদের সব ভিডিও ফুটেজ নিয়ে গবেষণায় নেমেছেন ইউসিএলএর একজন ফিজিসিস্ট জাস্টিন ক্রিস্টেনসেন। একে অপরকে চ্যালেঞ্জে নামিয়ে দেখেছেন, কোন ফ্র্যাঞ্চাইজের ড্রাগনটি এর মধ্যে সর্বসেরা।
হবিটন থেকে মাউন্ট ডুমের দূরত্ব ১,০৩০ মাইল। সেখানে আসতে ড্রাগনগুলোর কত সময় লাগবে, তার ওপর নির্ভর করে তাদের গতি নির্ধারণ করা যাবে। তারপর তাদের মুখ দিয়ে ছোঁড়া আগুন দিয়ে ৩০ ফুট পুরু, ৭০০ ফুট উঁচু ৩০০ মাইল লম্বা একটা দেয়াল গলতে কত সময় লাগে, তা দিয়ে তাদের ক্ষমতা যাচাই করা হবে।
‘দ্য হবিট: ব্যাটল অফ দ্য ফাইভ আর্মিজ’ মুভিতে লেকটাউন আক্রমণের সময়ে দুরন্ত বেগে ধেয়ে আসা স্মগের গতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তার দেয়ালে পৌঁছাতে সময় লাগবে ৪ ঘন্টা। ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অফ ফায়ার’ মুভিতে হ্যারিকে তাড়া করার দৃশ্যটি নিয়ে গবেষণা করে দেখা যায়, হাঙ্গেরিয়ান হর্নটেইলের লাগবে ১৬ ঘন্টা। ‘দ্য স্পয়েলস অফ ওয়ার‘ এপিসোডে ল্যানিস্টারদের আক্রমণ করার দৃশ্য বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, ড্রোগোনের সময় লাগবে ৬ ঘন্টা।
ড্রাগনগুলোর মুখ থেকে ছোঁড়া আগুনের রঙ দেখেই সেগুলোর উত্তাপ নির্ধারণ করা সম্ভব। আগুনের রঙ যত লালচে হবে, সেগুলোর উত্তাপ তত কম হবে। আগুনের রঙ যখন নীলচে সাদা হতে থাকবে, তার উত্তাপও তত বাড়তে থাকবে। হিসাব করে দেখা গেল, ড্রোগোনের আগুনের আঁচ ৭৫০০ ফারেনহাইট, স্মগের ১১০০০ ফারেনহাইট, আর হর্নটেইলের ৭০০০ ফারেনহাইট।
তবে উত্তাপ দিয়ে সবসময়ে সবকিছু নির্ধারিত হয় না। কী হারে এনার্জি নির্গত হলো, সেটাই মূল কথা। ড্রাগনদের এই আগুনের সাথে ওয়েল্ডিং ব্লোটর্চের তুলনা করা যেতে পারে। ধরে নিলাম, তিনটা ড্রাগনই একই জ্বালানি দিয়ে চলে। তাহলে ফুয়েলের ভলিউম দিয়ে এনার্জি নির্গমনের হার হিসাব করা যাবে। তারপর তাদেরকে আবারো তুলনায় আনা সম্ভব।
যেসব বস্তুর আকার আমরা জানি, সেগুলো ড্রাগনগুলো কত দ্রুত গলিয়ে দিতে পারছে, সেই হিসাব বের করলেই চলে। আসল আইস ওয়ালকে পুরোপুরি গলাতে তিন ড্রাগনেরই হাজার হাজার বছর লেগে যাবে। তাই আপাতত আইস ওয়ালকে ৩০ ফুট পুরু, ৩০ মাইল লম্বা, ১০ ফুট উঁচু ধরে নেয়া হলো। হিসাব করে দেখা গেল, এটা গলাতে স্মগের সময় লাগবে ৫.৭ ঘন্টা, ড্রোগনের লাগবে ১০ ঘন্টা আর হর্নটেইলের লাগবে ৫৬ ঘন্টা।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এই তিন ড্রাগনের মাঝে স্মগ সবচেয়ে বেশি শক্তিধর, সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে ধনীও বটে। কে জানে, ওয়েস্টেরসে থাকলে স্মগ হয়তো স্বর্ণের লোভে ল্যানিস্টারদেরই পক্ষ নিতো। কূটকৌশলের দিক থেকেও ল্যানিস্টারদের সাথে ভালো মিলত তার। মিডল আর্থের অন্য ড্রাগনদের তুলনায় অবশ্য স্মগের আকার সবচেয়ে ছোট, ফার্স্ট এজের অ্যানকালাগন দ্য ব্ল্যাককে বড় পর্দায় দেখার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।
আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, ড্রোগনের ভাই ভিসেরিয়নের মুখ থেকে আসা আগুনের উত্তাপ অনেক নক্ষত্রের তাপমাত্রাকেও হার মানিয়ে দেয়। তাই সে যখন আইস ওয়াল গলানোর জন্য মুখ খুললো, তখন সেই নীল আগুনের আঁচে গোটা নর্থ বাষ্প হয়ে যাওয়ার কথা! হয়তো কোনো জাদুবিদ্যা কাজ করেছে এখানে, সেকারণেই তেমন কিছু ঘটেনি।
তুলনায় কম-বেশি হলেও তিন ফ্র্যাঞ্চাইজের এই তিন ড্রাগন একদিক থেকে একই বিন্দুতে মিলে যায়। ফ্যান্টাসিপ্রেমী দর্শকদের রূপকথার রাজ্যের স্বাদ দিতে এদের কেউই কারো চেয়ে কম যায় না। এগুলো ছাড়াও ‘হাউ টু ট্রেইন ইওর ড্রাগন সিরিজ’, ‘পিট’স ড্রাগন’, ‘ইরেগন’ কিংবা ‘স্কাইরিম’ গেম; পছন্দের ড্রাগন চরিত্রগুলোর নাম বলতে গেলে তালিকা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। আমাদের দারুণ সৌভাগ্য যে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বইয়ের পাতার এই কল্পিত ড্রাগনগুলোকে আমরা পর্দায় উড়ে বেড়াতে দেখছি।