সময়টা ১৯৮৬ সাল। জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাবা-মায়ের সাথে স্যান্টা ক্রুজ সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে আসে অ্যাডিলেড টমাস নামের ছোট্ট এক মেয়ে। বিচের পাশে গড়ে ওঠা মেলায় নানা ধরনের রাইড থেকে শুরু করে খেলা ও সার্কাসের আসর বসানো হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে মেলার বাহারি রঙের চোখ ধাঁধানো সাজসজ্জা আর নানা রকম মন ভোলানো আয়োজনে ছোট অ্যাডি সময়টাকে বেশ উপভোগ করছিল। তারপর ঘোরাঘুরির এক ফাঁকে মেয়েকে স্বামীর কাছে রেখে কিছুক্ষণের জন্য ওয়াশরুমে যান মিসেস টমাস।
আর এই সুযোগে বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মেলার জনবহুল এলাকা ছেড়ে ছেড়েছি সৈকতের পাড় ঘেঁষে একা একা হাঁটতে হাঁটতে সে এসে পড়ে নির্জন এক তাঁবুর সামনে। ‘ভিশন কোয়েস্ট ফাইন্ড ইয়োরসেলফ’ লেখা সেই তাঁবুর ভেতর অ্যাডি যখন পা রাখে, তার কানে আসে একটি পুরুষ কণ্ঠ। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছিল সেই কণ্ঠের ভাষণের মতো কথা।
যতই এগোতে থাকে, চারপাশটা দেখে অবাক হতে থাকে মেয়েটি। অতঃপর মেয়েটি নিজেকে আবিষ্কার করে চারিদিকে অসংখ্য আয়না ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এক অন্ধকার হল ঘরে। এতটুকুন মেয়ের জন্য এমন পরিবেশ সহ্য করে স্বাভাবিক থাকাটাই অসম্ভব হবার কথা। কিন্তু অ্যাডি যতটা না ভয়ের মধ্যে ছিল, তার চেয়েও বেশি কৌতূহলী ছিল। কিন্তু এরপর যা ঘটে, তা অ্যাডি কেন, যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী অথবা পুরুষকে ঘাবড়ে দিতে পারতো অবলীলায়।
অ্যাডি যে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়, তাতে ভেসে ওঠে ঠিক অ্যাডির মতো দেখতে আরেকটি মেয়ে। অ্যাডির দিকে পেছন ঘুরে দাঁড়ানো মেয়েটা যখন মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকায়, তখন ওর মুখ দিয়ে একটি চিৎকারের সাথে সিনেমার মূল অংশ শুরু হয়। কী ভাবছেন? আয়নাভর্তি একটি ঘরে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আঁতকে ওঠাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? আর আয়নার মেয়েটি মাথা ঘোরানোর পর অ্যাডি চিৎকারই দেওয়ার পরই বা তাহলে কী ঘটেছিল?
উপরের অনুচ্ছেদে ২০১৯ সালের অন্যতম সেরা সাইকোলজিক্যাল হরর-থ্রিলার জনরার সিনেমা ‘আস’ এর প্রারম্ভের দৃশ্যটা তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া ও ৯০তম অস্কারে ‘বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে’ পুরস্কার জিতে নেওয়া ‘গেট আউট’ সিনেমাটির কথা মনে আছে? আমেরিকান অভিনেতা ও কমেডিয়ান জর্ডান পিলে সিনেমা নির্মাতা হিসেবে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ‘গেট আউট’ এর মধ্য দিয়ে।
আর প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত। তৃতীয় কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে অস্কারে শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে মনোনয়ন তো পেয়েছিলেনই, তাছাড়া প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে অর্জন করে নেন শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিত্রনাট্যের পুরস্কার জেতার গৌরব। ‘কি অ্যান্ড পিল’ নামের আমেরিকান কমেডি সিরিজের মাধ্যমে স্কেচ কমেডিকে বিশ্বজুড়ে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন পিলে। শুধু কমেডিয়ান ও নির্মাতা রূপে এমন প্রতিভার আলো ছড়িয়েই ক্ষান্ত হননি কিন্তু তিনি।
১৯৫৯ সালের বিখ্যাত টিভি সিরিজ ‘দ্য টোয়াইলাইট জোন’ এর আপডেটেড ভার্সন এ বছরে মুক্তি পেয়েছে। সেই শো দর্শক মহলে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও ন্যারেটর হিসেবে দারুণ পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন জর্ডান পিল। আর ‘আস’ সিনেমাটি হলো জর্ডান পিলের সাফল্যের মুকুটে সংযোজিত হওয়া নতুন এক রত্ন। একাধারে সিনেমার পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও সহ-প্রযোজক হিসেবে ছিলেন তিনি।
‘আস’ সিনেমাটির প্লট গড়ে উঠেছে উইলসন পরিবার ও তাদের সাথে ঘটে যাওয়া এক নিকষ কালো এক রাতের বিভীষিকাময় গল্পকে ঘিরে। মিস্টার ও মিসেস উইলসন তাদের দুই সন্তান জোরা ও জেসনকে নিয়ে প্রতি বছরের মতো সেবারও গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে নিজেদের সামার হাউজে গিয়ে উঠেন। স্যান্টা ক্রুজ বিচের কাছাকাছি অবস্থিত এ সামার হাউজে তাদের গাড়ি পৌঁছানোর মধ্যদিয়ে সিনেমার মূল পর্ব শুরু হয়।
আরো কিছু দৃশ্যের পর দর্শক জানতে পারবেন যে, মিসেস উইলসনই হচ্ছে ছোট্ট সেই অ্যাডি। ছোটকালে তার সাথে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ ঘটনার পর থেকে নিজের আগের সত্ত্বা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন অ্যাডিলেড উইলসন। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য বাবা-মায়ের চোখের আড়াল হয়ে যাওয়া অ্যাডি ঐ ঘটনার পর কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তারের পরামর্শে অন্য কোনো মাধ্যমে নিজেকে মেলে ধরার প্রয়াসে নাচের ভুবনে পা দিয়ে নতুনভাবে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল সে। তারপর একসময় অতীতের দুঃস্বপ্ন ধীরে ধীরে পেছনে ঝেড়ে ফেলে ভবিষ্যৎ সাজাতে শুরু করে অ্যাডি। গ্যাব উইলসন নামের এক ভদ্র, নম্র ও প্রাণবন্ত পুরুষের প্রেমে পড়ে তাকে জীবনসঙ্গী করে নেয়। জোরা ও জেসনের মতো দু’টো ফুটফুটে সন্তানের মা হয়।
গ্যাব ও সন্তানদের নিয়ে বেশ সুখেই ঘরকন্যা সামলাচ্ছিলো সে। কিন্তু এবার সামার হাউজে এসে কেন জানি তার মনে অস্থিরতা কাজ করছিল। সৈকতে ঘুরতে যাওয়া, পরিচিত বন্ধুদের সাথে আড্ডা, এমনকি নিজের পরিবারের সাথে আনন্দে মেতে উঠতে মন মানছিল না তার। কেমন অজানা এক আশঙ্কা গ্রাস করে রেখেছিল তাকে। অনেকদিন পর তার মনে হচ্ছিল, ছোটকালের সেই আয়নার মেয়েটি তার জীবনের দিকে পুনরায় অগ্রসর হচ্ছে। আর এভাবেই সিনেমার সবচেয়ে চমকপ্রদ পর্বের সূচনা ঘটে।
একদিন সমুদ্র সৈকত থেকে ঘুরে এসে রাতের বেলা বিছানায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল উইলসন পরিবার। জেসন ও জোরাকে বিছানায় দিয়ে গ্যাব ও অ্যাডি নিজেদের রুমে কথা বলছিল। এতগুলো বছরেও গ্যাবকে কখনোই সেই আয়নার মেয়েটির কথা না বলে থাকলেও সেদিন যেন কী মনে করে বলে ফেললো অ্যাডি। ওদের কথা চলা অবস্থাতেই হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গিয়ে পুরো বাসা অন্ধকার করে দিলো।
পুরো পরিবার এসে লিভিং রুমে জড়ো হতে না হতেই ওরা আবিষ্কার করল যে, ওদের বাড়ির আঙিনায় অন্য একটি পরিবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটাতে অ্যাডি ও তার সন্তানেরা আঁতকে উঠলেও প্রথমে তেমন একটা ঘাবড়ে যায়নি গ্যাব। সে পরিবারের কর্তা হিসেবে বিষয়টা মীমাংসা করতে বাইরে গিয়ে ভালো মুখে ওই পরিবারকে তাদের বাড়ির সীমানা ছেড়ে যেতে বলে।
কিন্তু ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে শুরু করে। অ্যাডি ‘৯১১’ এ কল করলেও পুলিশের আসতে তখনো বহু দেরি বলে জানতে পারে। অন্যদিকে, এতক্ষণ যাবত একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ও মুখ দিয়ে টুঁ শব্দ না করা সেই পরিবার এবার হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক। লাল পোশাক পরিহিত চার অচেনা আগন্তুক বাড়ির চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে পিলে চমকিয়ে দেয় বাড়ির ভেতরে থাকা চারজনের। তারপর যা ঘটে, তার জন্য উইলসন পরিবার মোটেও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। তাদের সাথে দর্শকও তখন প্রবেশ করবেন শ্বাসরুদ্ধকর এক অভিযানে। নানা রহস্যের উন্মোচন, রক্তারক্তি খেলা আর জীবন-মরণ লড়াইয়ে অভিশপ্ত হয়ে ওঠে সে রাত।
‘আস’ সিনেমার অভিনয়শিল্পীদের কথা বলতে গেলে প্রধান অভিনেত্রী লুপিতা নিয়োঙ্গোর নিখুঁত অভিনয়শৈলীর তারিফ না করে থাকা দায়। অ্যাডিলেড উইলসন চরিত্রে তার অভিনয় তো অসাধারণ ছিলই, রেড চরিত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়া। সিনেমার প্রতিটা দৃশ্যে তার কথা বলার ধরন, গলার স্বর, চলনভঙ্গি, মুখভঙ্গি ছিল অমায়িক। একজন মানুষ দু’টো বিপরীতধর্মী চরিত্রকে একইসাথে যে ভিন্নধর্মী উপস্থাপনের মাধ্যমে দর্শকদের সামনে দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে পারে, তিনি তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন।
তিনি তার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে একশো ভাগ সফল। এছাড়া গ্যাব ও আব্রাহাম চরিত্রে উইনস্টন ডিউকও নিজের দু’টো চরিত্রতেই ছিলেন সাবলীল। শাহাদি রাইট জোসেফকে জোরা চরিত্রে তো দুর্দান্ত অভিনয় করেছেই, আম্ব্রে চরিত্রে তার চোখেমুখের শয়তানি হাসি দেখে এতটাই জীবন্ত লাগছিল যে, মনে হচ্ছিল এই না পর্দা চিড়ে বেরিয়ে আসে! ইভান অ্যালেক্স এটুকু বয়সে প্লুটো ও জেসন হিসেবে যা করে দেখিয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
এ সিনেমাটির প্রাণকেন্দ্র যে সিনেমার প্লট, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ কেউই পোষণ করবেন না। কিন্তু আনুষঙ্গিক উপাদানগুলো নিয়ে কথা না বললেই নয়। যেকোনো হরর জনরার সিনেমাকে দর্শকদের স্নায়ু নিয়ে খেলতে যেসব উপাদান ভূমিকা রাখে, তার মধ্যে প্রধান হলো সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। অনেক সময় প্রোডাকশন হাউজ পর্দায় যতই থমথমে ও শরীরের রক্ত হিম করে দেওয়া পরিবেশই সৃষ্টি করুক না কেন, দুর্বল বিজিএমের জন্য অনেক দৃশ্যের বেহাল দশা হয়। এ সিনেমার সেক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে বলতে হবে।
সিনেমার শুরু থেকে শেষ অবধি দারুণ সব বিজিএম দিয়ে পরিবেশকে মাতিয়ে রেখেছেন সিনেমার মিউজিক কম্পোজার মাইকেল অ্যাবেলস। বিশেষ করে, সিনেমার ইন্ট্রোর বিজিএমটা দর্শকদের গায়ের লোম খাড়া করে দেওয়ার মতোই শীতল ও ধারালো।
তাছাড়া সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফিতে নন্দিত কাজ করে দেখিয়েছেন মাইক গুইয়োলাকিস। আয়নাভর্তি সেই হলঘরের দৃশ্য, অ্যাডিলেড ও রেডের নাচের দৃশ্য, রাতের অন্ধকারে রেড ও তার পরিবারের হানা দেওয়ার দৃশ্য ইত্যাদি সিনেমার পর্দায় এতটা প্রাণবন্তভাবে চিত্রায়িত করার জন্য তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। ‘আস’ সিনেমাটিকে জর্ডান পিলের পূর্বের সিনেমা ‘গেট আউট’ এর সাথে একই পাল্লায় না মাপলেই ভালো বলে মনে করি। তবে যেহেতু একই নির্মাতার কারিগরি হাত দুটো সিনেমা সৃষ্টির পেছনেই আছে, তুলনা আসাটা অতি স্বাভাবিক বিষয়। তাই অনেক দর্শকই গেট আউটকে এগিয়ে রেখেছেন। তবে তাই বলে ‘আস’ কোনোক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, এমন কিন্তু নয়।
সিনেমাটি তার নিজস্ব ধারায় অনন্যসাধারণ। পিল নিজের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এ সিনেমায় এমন এমন কিছু উপাদান ঢেলে দিয়েছেন যে, সিনেমাটির প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি মুহূর্ত অনেক ছোট ছোট বার্তা, তথ্য ও সংকেতের সমন্বয়ে গঠিত। প্রচুর পরিমাণে ইস্টার এগ থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক ঘটনা, মিথোলজির প্রয়োগ ও ধর্মীয় গ্রন্থের রেফারেন্স ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসে সিনেমার অন্তর্জালে। সিনেমাটি পুরোটা দেখে ওঠার পর দর্শকের মনে নানান ধরনের প্রশ্ন উঁকি দেবে। সিনেমাটি নানান ধরনের মতবাদ, বিশ্লেষণ ও উপসংহার টানা হচ্ছে। তবে পিলে যেহেতু এখনো স্পষ্টত কোনো ব্যাখ্যা দেননি, তাই ‘আস’ এর পরবর্তী সিক্যুয়েল ‘দেম’ এর জন্য অপেক্ষা করাটাই সমীচীন।
‘দ্য হলিউড রিপোর্টার’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারে জর্ডান পিল বলেছেন,
যখন প্রশ্নেরা রয়ে যায় নিরুত্তর, কিন্তু গল্পের হয়নি শেষ, তখন কল্পনা তো বাঁধনহারা হবেই।
আইএমডিবিতে ৯১৭৩০ ভোটে ৭.১/১০ রেটিং প্রাপ্ত হয়েছে সিনেমাটি। এছাড়া রটেন টমেটোসে ৪৫৮ রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯৪% রেটিং ও মেটাক্রিটিকে ৫৫ রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৮০% রেটিং লাভ করেছে। তাছাড়া সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবেও সাফল্যের মুখ দেখেছে।