বাংলাদেশের মানুষ কেন মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, এ প্রশ্নের স্বাভাবিক ও অনিবার্য উত্তর হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য। দীর্ঘ ২৩ বছরের অবিরাম শোষণ, বঞ্চনা আর নিগ্রহের জমাটবাঁধা ক্ষোভ এদেশের মানুষ উগরে দিয়েছিল ১৯৭১ সালে। দেশমাতৃকা যখন শকুনের থাবায় রক্তাক্ত, তখন তাকে রক্ষা করার জন্য, তার হারানো সম্ভ্রম ও পবিত্রতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাঙালিরা স্বাধীনতার সম্মুখসমরে নিজেদের সঁপে দিয়েছিল।
কিন্তু শুধু কি দেশপ্রেমের তাগিদেই এদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিল? অথবা কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শিক অবস্থান থেকে মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিন্তু এমনটা মানতে নারাজ।
তিনি মনে করতেন, এদেশের মানুষ শুধু দেশপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে, কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গণআদর্শের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেনি, বরং স্রেফ বাঁচার জন্য কতকটা বাধ্য হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ তো তেমন সংগঠিত কিছু ছিল না। তাছাড়া এর নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যও ছিল না। সাধারণ মানুষ বা কৃষকেরা যে যুদ্ধ করেছিল, তা কোনো আদর্শ থেকে করেনি। করেছে তার কারণ, না করলে তারা মারা পড়ত।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উঁচুমানের সাহিত্যচর্চা বাংলা সাহিত্যে খুব একটা বেশি হয়নি। এর বাইরে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে রচিত সাহিত্যের সংখ্যাটি তো আরও কম।
কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি এনেছেন তার সাতটি গল্পে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশ যেভাবে বেড়ে ওঠার কথা ছিল, তা কিন্তু হয়নি। কারণ, সমাজটি তখন লোভী মানুষের রাক্ষুসে গ্রাসের করালদন্তে আটকে গিয়েছিল।
যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের অনাচারের সময়টুকুকে ইলিয়াস বলেছেন ‘স্বপ্নভঙ্গের কাল’। কারণ, যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেশের জনগণ দেখতে পায়নি। ইলিয়াসের ভাষায়,
মুক্তিযুদ্ধ খুব ইতিবাচকভাবে আসেনি। আসলে মুক্তিযুদ্ধের পরে সময়টা তো চরম হতাশার। মুক্তি নিয়ে আমাদের দারুণ স্বপ্ন ছিল। সে কী সীমাহীন স্বপ্ন! এত স্বপ্ন দেখার তো মানে হয় না। …আর মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়টা তো চরম স্বপ্নভঙ্গের কাল।
স্বপ্নভঙ্গের বাংলাদেশ
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দিকে দিকে তখন ক্ষমতাশালীদের জয়জয়কার। ‘সিক্সটিন ডিভিশন’-এর দাপটে তখন আসল মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর ঢাকা শহরে ও সারা দেশে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল, যারা আদতে কস্মিনকালেও যুদ্ধক্ষেত্রের ধারেকাছে যায়নি। এই জালিয়াত ‘মুক্তিযোদ্ধারাই’ সিক্সটিন ডিভিশন নামে পরিচিত।
আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধফেরত-জোশে বলিয়ান হয়ে, স্বাধীনতার সুখকে তার অবিসংবাদিত দাবি হিসেবে ভেবে নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো ভোগদখলের রাজত্ব গড়ে তুলেছে। যত্রতত্র মানিক ভাই (খোঁয়ারি), মজনু ভাইদের (মিলির হাতে স্টেনগান) মতো গ্যাং লিডারদের দাপট।
অবস্থার মারপ্যাঁচে পড়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও বিপথে পা বাড়াচ্ছে। আবার তোরা মানুষ হ সিনেমার কথা এখানে প্রাসঙ্গিক। এই সিনেমায় একাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নীতি ও আদর্শিক ভিতকে টলে যেতে দেখানো হয়েছে। এরকম যুদ্ধোত্তর ‘জোর যার মুল্লুক তার’ বাংলাদেশের চিত্রপটে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার হতাশা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে পুঞ্জীভূত করেছেন নিজের কলমের অগ্রভাগে।
ছোটগল্প ‘খোঁয়ারি’তে দেখিয়েছেন, কীভাবে অসহায় সংখ্যালঘু তার ভিটেবাড়ি হারাচ্ছে, প্রতিবাদ করার অবকাশটুকুও পাচ্ছে না। মিলির হাতে স্টেনগান-এ অঙ্কিত করেছেন যুদ্ধের পর অস্ত্রশক্তিতে বলিয়ান স্খলিতনীতি মুক্তিযোদ্ধা ও সেই নীতিস্খলনের বিরুদ্ধে মেটাফোরিক প্রতিবাদ।
মিলির হাতে স্টেনগান গল্পটির প্রেক্ষাপট বাহাত্তর বা তিয়াত্তর সালের ঢাকা শহর। মা, বাবা, দুই ভাই ও এক বোন নিয়ে মিলিদের পরিবার। বড় ছেলে রানা একজন মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র জমা দেয়নি সে, নিজের কাছেই লুকিয়ে রেখেছে তার স্টেনগানটি।
না, দীর্ঘ নয় মাসের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দোদুল্যমান প্রতিটি মুহূর্তের বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে অস্ত্রটির প্রতি একান্ত ভালবাসা থেকে স্টেনগানটি রেখে দেয়নি রানা, বরং এই অস্ত্রটিকেই বর্তমানে টিকে থাকার অবলম্বন হিসেবে এখনো সযতনে আগলে রেখেছে সে।
অবশ্য শুধু টিকে থাকার ব্যাপারে সাহায্য করাই যে স্টেনগানটির মূল লক্ষ্য, তা কিন্তু নয়। বরং মাঝেমধ্যে আনকোরা নতুন টিভি সেট বা অন্য কোনো গৃহসজ্জার উপকরণ হস্তগত করার কাজেও যে অস্ত্রটি এখনো সফল পার্শ্বচর হিসেবে রানার সাথে সাথে অবস্থান করে, গল্পটি পড়ে তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
কিন্তু যত সমস্যা বাঁধাচ্ছে আব্বাস পাগলা। এই ‘থরোব্রেড বাস্টার্ড’টা নির্লজ্জের মতো রানার কাছে তার সাধের স্টেনগানটা চেয়ে বসে। আব্বাস পাগলার ভাষ্যমতে, চাঁদের মধ্যে নাকি দখলদার বাহিনী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। সেই হানাদারদের গুষ্টির পিণ্ডি চটকানোর জন্য রানার স্টেনগানটাই যথেষ্ট আব্বাস পাগলার জন্য।
‘একটা স্টেনগান থাকলে হু বদারস ফর দি ফাইনাল মেসেজ?” তাহলেই সে চাঁদের মাটি থেকে ওই শয়তানদের দূর দূর করে তাড়াতে পারবে। কারণ, চাঁদটাকে তারা শেষ করে দিচ্ছে,
‘এন্টায়ার স্কাইস্কেপ হ্যাজ বিন রেপড মিজারেবলি!’
আব্বাস পাগলার এহেন কর্মকাণ্ড সবাই পাগলামি হিসেবেই জানে। কিন্তু শুধু মিলিই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে আব্বাস তাকে।
আব্বাস পাগলার কথাগুলো মিলি বুঝতে চেষ্টা করে। রাতের আকাশে ফকফকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে শত্রু খোঁজে। কিন্তু আব্বাস পাগলার মতো দৃষ্টি তার নেই, তাই হলুদ গোলকে কালো দাগ পড়া চাকতি ছাড়া আর কিছুই দেখে না সে।
বন্দুকের নল যখন ক্ষমতার উৎস
আমাদের রানা হচ্ছে সেসব ‘বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধা’র প্রতিনিধি, যারা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকে নিজেদের অধিকৃত রাজ্য ভেবে সে রাজ্যের রাজা বনে বসেছিল। অবশ্য তাদের এই মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার কিছু যৌক্তিক কারণও আছে। কিছু মানুষ প্রচুর আশা নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল।
অনেকে যুদ্ধে গিয়ে নিজের সর্বস্ব, আক্ষরিক অর্থেই সর্বস্ব হারিয়েছিল। ফলে যুদ্ধের পর দেশ যখন স্বাধীন হলো, তখন তারা সীমাহীন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে সমৃদ্ধ জীবনযাপনের আশায় তারা দেশে ফিরেছিল, কিন্তু তাদের সে আশা দুরাশায় পরিণত হয়ে গেল, যখন দেখল লুম্পেন বুর্জোয়ারা দেশের শীর্ষস্থান অধিকার করে বসেছে, আর দেশে তখন পুরোদস্তুর মাৎসন্যায় চলছে।
এর সাথে ছিল সিক্সটিন ডিভিশনের দৌরাত্ম্য। ফলে বঞ্চিত হতে হতে বিতৃষ্ণ যোদ্ধারা পুনরায় তাদের অস্ত্র তুলে নিল। বন্দুক বড় ভয়ংকর জিনিস, একবার হাতে উঠলে আর নামতে চায় না। সেই বন্দুকের বদৌলতে তারা যখন তাদের আকাঙ্ক্ষিত সুখের নাগাল পেতে লাগল, তখন ধীরে ধীরে তারা অনেকটা নিজের অজান্তেই অপরাধের পাঁকে ডুবে যেতে থাকল।
ঐ পাঁক ভেঙে আর ওঠার শক্তি তাদের রইল না। কিছু যুদ্ধফেরত তরুণ চাইছিল, খুব করে চাইছিল, বিধ্বস্ত দেশটাকে নতুন করে গড়ে তুলবে। এ কাজে সরকারের সাহায্য প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোমন্দ চিন্তা না করে মুক্তিফৌজ ভেঙে দিল। তাদেরকে অস্ত্র জমা দিতে বলে ৫০ টাকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো।
রাষ্ট্রের এ ধরনের বিমাতাসুলভ আচরণে স্বভাবতই অনেক মুক্তিযোদ্ধা ক্ষুব্ধ হন। এদেরই একটা অংশ পরে নিজেদের সামরিক শক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করেন। আমাদের রানাও সেরকম একজন মুক্তিযোদ্ধা, যে কি না নিজের পেশিশক্তিকেই কাজে লাগাচ্ছে একটু সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য।
মাও সে তুং বলেছিলেন, বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এই মতবাদের চর্চা উৎকর্ষে পৌঁছায়। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলি কেন, দেশবিরোধী দেশীয় চক্রগুলোও মুক্তিযুদ্ধের পরে বেশ সক্রিয় ছিল। স্বাধীনতাবিরোধী যে শক্তির কথা আমরা আজকাল অহরহ শুনি, আদতে আমাদের স্বাধীনতার শুরু থেকেই এ শক্তির জন্ম।
১৬ ডিসেম্বরের পর থেকেই ঢাকায় অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াতে থাকে সিক্সটিন ডিভিশনের জাল ‘মুক্তিযোদ্ধা’রা। এরা শহরজুড়ে সুযোগমতো লুটপাট চালায়, এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ‘খোঁয়াড়ি’ গল্পে যে মানিক ভাই ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা সংখ্যালঘু সমরজিতের বাড়ির নিচতলা দখল করার পায়তারা করে, তারা আদতে সিক্সটিন ডিভিশনের মতোই স্বার্থান্বেষী দুষ্টচক্র।
প্রতিবাদের প্রথাবিরোধী কন্ঠস্বর আব্বাস পাগলা
ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল তার অন লিবার্টি (১৮৫৯) গ্রন্থে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, একটি সমাজে কখনো কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠের মতবাদের চাপে প্রথাবিরোধী (Eccentric) কোনো তত্ত্ব, ধারণা বা বিশ্বাস মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।
সংখ্যাগরিষ্ঠ আদর্শগত এই একপেশে অবস্থানকে তিনি ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের যথেচ্ছাচারিতা’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ, এই প্রক্রিয়ায় সমাজের বেশিরভাগ মানুষই বিদ্যমান স্থিতাবস্থাকে সঠিক বলে মেনে চলে। তারা প্রতিষ্ঠিত ধারণার বাইরে আর কোনো ধারণাকে গ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু ওই সমাজের বিদ্যমান ত্রুটিগুলো সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সমাজে অবস্থিত প্রথাবিরোধী চিন্তাধারার, স্রোতের বিরুদ্ধগামী মানুষগুলো।
মিলির হাতে স্টেনগান গল্পে আব্বাস পাগলা একজন প্রথাবিরোধী মানুষ। কারণ, সে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সমূহ বিপদগুলোকে প্রকাশ্যে চিহ্নিত করে বেড়াচ্ছে। তার এই প্রতিবাদটুকু গল্পে মেটাফোরিক। মেটাফোরিক হওয়ার কারণে গল্পের বাকি চরিত্রগুলো তার কথাগুলো বুঝতে পারছে না, বা বোঝার চেষ্টা করছে না। আবার ঠিক একইভাবে মেটাফোরিক হওয়ার কারণে বাস্তবের পাঠক আব্বাস পাগলার ভিন্নধর্মী প্রতিবাদটুকু ধরতে পারছেন।
একটা সমাজে যতটা নৈতিক অধঃপতন ঘটুক না কেন, সবসময়ই সব সমাজে কিছু না কিছু মানুষ থাকে, যারা প্রতিবাদ করতে জানে। নিদেনপক্ষে তারা প্রতিবাদ করতে চায়। হয়তো সংখ্যালঘু বলে তাদের কণ্ঠস্বর আমরা অনেক সময় শুনতে পাই না। নীরবতার কুণ্ডলীর ফাঁকে পড়ে তারা ধীরে ধীরে তাদের প্রতিবাদের ইচ্ছেটাকে অবদমিত করে ফেলে।
১৯৭১ সালের পরে যখন স্বাধীন বাংলাদেশ আরেকটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখনও আব্বাস পাগলার মতো এরকম প্রতিবাদী চরিত্রগুলো সমাজে ছিল, যারা সব বাধাবিঘ্ন সরিয়ে সমাজের নেতিবাচক স্থিতাবস্থাকে ভাঙতে চেয়েছিল। আব্বাস পাগলা তাদেরই প্রতিনিধি।
কিন্তু লেখক কেন একজন ‘পাগল’-এর মধ্য দিয়ে এই প্রতিবাদটুকুকে ধারণ করলেন? কারণ, স্বাভাবিক মানুষগুলো যখন সমাজটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তখন অপ্রকৃতিস্থ কোনো মানুষের পক্ষেই তার বিরুদ্ধে কথা বলা সম্ভব। পুরো গল্পজুড়েই আমরা দেখি, আব্বাস পাগলা তার মতো করে ভুলগুলো আওড়ে যাচ্ছে। চাঁদের নদীর প্রসঙ্গ উঠলে মিলি যখন সে নদীর নাম জানতে চায়, তখন আব্বাস পাগলা বলে,
নদীর আবার নাম কিয়ের? এই চুতমারানিরা গেছে, খানকির বাচ্চাগুলি অহন নাম দিব। নাম দিব, দাগ দিব, খতিয়ান করব, কবলা করব, দলিল করব, মিউটেশন করব। হালারা বাপ-দাদাগো সম্পত্তি পাইছে তো, বুঝলি না?
এটা কি স্রেফ আব্বাস পাগলার প্রলাপ? ১৯৭১-এর পরে বাংলাদেশে জায়গাজমি দখল করার এক মহোৎসব শুরু হয়। বিশেষত সংখ্যালঘুরা এর শিকার হয় মারাত্মকভাবে। রাজনৈতিক কারণেও অনেক মানুষ তাদের নায্য ভূমির অধিকার হারান।
একাত্তরে সব ছেড়েছুড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া অনেক মানুষ ফিরে এসে দেখতে পান, তাদের আদি ভিটা এখন অন্য কারও দখলে। নিজেদের অধিকারটুকু দাবি করারও কোনো পথ খোলা নেই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ভোগদখলের এই বিভীষিকা তার আরেকটি গল্প খোঁয়ারি-তেও তুলে ধরেছেন। সেখানে দেখানো হয়েছে, নব্য রাজনৈতিক শক্তির কাছে নিজেদের ভূমির অধিকার ছেড়ে দিতে হচ্ছে অসহায় মানুষকে।
আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাসের শিকার আব্বাস পাগলা
মার্ক্সপন্থী সমাজতাত্ত্বিক লুইস অ্যালথুজার আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস তত্ত্বের প্রণেতা। তবে একইসাথে তিনি রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস নামের আরেকটি পরিপূরক তত্ত্বও দিয়েছেন। সমাজের ক্ষমতাসীন বুর্জোয়ারা যখন দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিবাদী কন্ঠস্বরগুলোকে থামিয়ে দেয়, তখন তাকে বলা হয় রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপার্যাটাস।
অন্যদিকে, শোষক যখন শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাবু না করে বরং মানসিক ও আদর্শিকভাবে তাদেরকে পরাস্ত করে ফেলে, তখন তাকে বলা যায় আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস বা আইএসএ। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
হীরক রাজার দেশে (১৯৮০) সিনেমায় আমরা দেখেছি, রাজা তার শাসন নিয়ে প্রশ্ন তোলা সবাইকে যন্তরমন্তর ঘরে নিয়ে গিয়ে মগজ ধোলাই করে ছেড়ে দিচ্ছেন। প্রতিবাদকারী কৃষক, শ্রমিক সবাই তখন রাজার জয়গান করে বেড়াচ্ছে। এখানেই আইএসএ’র সাফল্য। কারণ, ঐ কৃষক বা শ্রমিক কিন্তু ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছে না, সে আসলে একটি নৈরাজ্যের অংশমাত্র, অথচ তারপরও সে সাদরে সেই নৈরাজ্যকে মেনে নিয়েছে।
আইএসএ ঠিক এভাবেই কাজ করে। যখন শাসকগোষ্ঠী তাদের আদর্শকে সঠিক বলে জনগণকে বোঝাতে পারে এবং জনগণ সে আদর্শ বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়, তখনই আইএসএ হয়ে ওঠে নির্ঝঞ্ঝাট শোষণের অন্যতম সফল হাতিয়ার।
মিলির হাতে স্টেনগান গল্পের শেষদিকে আমরা দেখি, আব্বাস পাগলার ওপর বিরক্ত হয়ে রানা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয় চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসার পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায় আব্বাস। তখন আর সে চাঁদের দুঃখে কাঁদে না, রানার কাছ থেকে স্টেনগান চায় না। বরং সে রানার কাছে চাকরি চেয়ে বেড়ায়। স্টেনগানের বদলে চাকরি, একসেন্ট্রিসিটির বদলে কনফর্মিটি। প্রতিবাদের বদলে মেনে নেওয়া। মিলি যখন তাকে স্টেনগান দিতে চায়, তখন সে বলে,
মিলি, আমি না ভালো হইয়া গেছি। তুমি বোঝো না? আমার ব্যারাম ভালো হইয়া গেছে।
খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য আব্বাস পাগলাকেও তখন সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।
রানারে একটু বুঝাইয়া কইয়ো। রানারা কয় বন্ধু একটা ইন্ডেন্টিং ফার্ম করছে। রানা ইচ্ছা করলে আমারে প্রভাইড করতে পারে।
আব্বাস পাগলার এই ভালো হওয়াটা কি আসলেই ভালো হওয়া? সমাজটা ভালো হলো কই! আব্বাস পাগলা সেই ভঙ্গুর সমাজটার সাপেক্ষে নিজেকে ভালো বলে দাবি করছে। কিন্তু যে সমাজ নিজেই অসুস্থ, সেই সমাজে আব্বাস পাগলারা কী করে সুস্থ হয়?
মিলি: প্রতিবাদের রক্তবীজ
প্রতিবাদ কখনো থেমে থাকে না। যতদিন সমাজে শোষণ থাকবে, ততদিন প্রতিবাদও থাকবে। কারণ বঞ্চনা, হতাশা, অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষ চিরকালই প্রতিবাদে অংশ নেবে। হয়তো তার আকার, ব্যাপ্তি, ধরন বদলাবে। কিন্তু প্রতিবাদ নিঃশেষিত হবে না।
মিলির হাতে স্টেনগান গল্পেও মিইয়ে আসা প্রতিবাদ আবারও জেগে ওঠে। এবার প্রতিবাদের উৎস স্থানান্তরিত হয় আব্বাস পাগলা থেকে মিলিতে।
হাতের স্টেনগানের ইস্পাতে আঙুল বোলাতে বোলাতে পায়ের পাতায় চাপ দিয়ে মিলি আরো ওপরে দেখার চেষ্টা করে। …তবে কি না চাঁদের রেঞ্জ এখনো মেলা দূরে, ওকে তাই দাঁড়াতে হয় পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে। এতে হচ্ছে না। এবার একটা উড়াল দেওয়ার জন্য মিলি পা ঝাপটায়।
মিলি প্রতিবাদের ঝাণ্ডা বয়ে বেড়ানো এক আশার স্ফুলিঙ্গ। আমাদের প্রতিবাদী তরুণ প্রজন্ম মিলিদেরই উত্তরসূরী। কিন্তু এই প্রতিবাদটুকু কতটা সফল হচ্ছে? স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশের মানুষ কি আদৌ স্বাধীন হয়েছে?
আমরা দেখেছি, যে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা আনা হয়েছে, সে শত্রুর শেখানো মডেলের ওপর নির্ভর করা শাসনব্যবস্থাই অনেকবার আমাদের জনগণের ওপর চেপে বসেছে। যে আদর্শের ওপর ভর করে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির জন্য লড়াই করেছে, সে আদর্শ বর্তমানে কতজন মানুষ মনেপ্রাণে নিখাদভাবে ধারণ করছে? সোনার বাংলা তো এখনো অধরাই রয়ে গেল। চারপাশে যখন এই অন্যায়, দুর্নীতির অধঃপতন দেখি, তখন স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও আব্বাস পাগলার ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়,
খালি দালাল, খালি কুইসলিং।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বই ও সিনেমা’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/