প্রত্যেক রূপকথায় যেমন মানানসই একটি রাক্ষস থাকা চাই, তেমনি প্রত্যেকটি ভালো চলচ্চিত্রের জন্যে প্রয়োজন একজন শক্তিশালী খলনায়ক। এদেরকে আপনি না পারবেন যুক্তি দিয়ে বোঝাতে, না পারবেন অর্থের লোভ দেখিয়ে থামিয়ে রাখতে। তারা ধ্বংসের অভিপ্রায় নিয়েই ধ্বংস করে, আর জেনেশুনে করা খারাপ কাজের মাঝেই খুঁজে পায় পরিতৃপ্তি। কিন্তু একটু অতীত ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন যে, শুরু থেকেই তারা খারাপ ছিল না। প্রাথমিক দৃষ্টিতে দর্শকদের চোখে ভিলেন হিসেবে আসলেও তাদের পরিণতির পেছনের কারণগুলো একটু চিন্তা করে দেখলেই বোঝা যাবে কেন কিংবা কার জন্যে তারা আজ ভিলেন!
সিনেমা এবং কমিকস বইয়ের এমনই কিছু খলনায়কদের অতীত তুলে ধরা হবে আজ আপনাদের সামনে। আর বুঝতেই পারছেন ভিলেনের ভিলেন হওয়ার কাহিনী নিয়ে যেহেতু আলোচনা, সামনে অবশ্যই স্পয়লার থাকবে। এখনও দেখা হয়নি এমন সিনেমার কোনো চরিত্র আসলে সেই অনুচ্ছেদটি বাদ দিয়ে যাওয়াটাই মঙ্গল হবে।
খান নূনিয়েন সিং (স্টার ট্রেক)
‘খান’ সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত স্বৈরশাসকদের মধ্যে একজন এবং স্টার ট্রেক ইউনিভার্সের সবচেয়ে ভয়ংকর ভিলেন। ইউজেনিক যুদ্ধের সময় নিজেদের শক্তির পাল্লা ভারী করতে ‘স্টারফ্লিট কমান্ড’ বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে জেনেটিক্যালি উন্নত কিছু সুপার-হিউম্যান তৈরি করে। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ফলে সুপার-হিউম্যান আর্মির আর প্রয়োজন পড়ে না, সম্পূর্ণ আর্মিকে অচেতন অবস্থায় ‘বাতিল’ হিসেবে একটি গ্রহে ফেলে দেয়া হয়। খান ছিল সেই আর্মিরই দলনেতা।
২০০ বছর পর ‘সাসপেন্ডেড এনিমেশন’-এ জেগে উঠলে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে খান তার বাহিনী নিয়ে এন্টারপ্রাইজে হামলা চালায়। কিন্তু ক্যাপ্টেন কার্ক তাদেরকে প্রতিহত করে আবার অন্য একটি গ্রহে নির্বাসিত করে। গ্রহের স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলাকালীন সময় দুর্ঘটনায় খানের স্ত্রী আর বেশ কিছু সদস্য মারা যায়। তাদের মৃত্যুর জন্যে কার্ককেই দায়ী করে খান এবং প্রতিশোধের নেশায় এন্টারপ্রাইজ ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা করে। করবে না-ই বা কেন? তাকে যারা বানিয়েছে তারাই যখন তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়; পরে মেরেও ফেলতে চায়, তখন তার নিয়তি নিজের হাতে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে?
হার্লি কুইন (ডিসি ইউনিভার্স)
হারলিন কুইঞ্জেল ছিল আরখাম মানসিক হাসপাতালের এক শিক্ষানবীশ ডাক্তার। তার নামের সাথে ইতালির নামকরা ভাঁড় হার্লেকুইনের নামের মিল থাকায় সে জোকারের সুনজরে আসে। আর এদিকে জোকারের উদ্ভট কাজকর্মে তার উপর কৌতূহল জন্মায় হারলিনেরও। নিজ থেকেই জোকারের থেরাপি সেশনের দায়িত্ব নেয় সে। তাদের বিভিন্ন সেশনে জোকারের কাছ থেকে তার বিষাদময় অতীত এবং পাষণ্ড বাবার হাতে নির্যাতিত হবার বিভিন্ন গল্প শুনতে শুনতে তার জন্য সহানুভূতির পাশাপাশি ভালোবাসা জেগে উঠে হারলিনের মধ্যে।
কিছুদিন পর জোকার আরখাম থেকে পালিয়ে গেলে ব্যাটম্যান তাকে পিটিয়ে আধমরা করে আরখামে ফেরত নিয়ে আসে। জোকারের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে হারলিন মানসিকভাবে খুব কষ্ট পায়। রাগে-দুঃখে সেদিনই হার্লেকুইনের কস্টিউম জোগাড় করে ছদ্মবেশে জোকারকে নিয়ে আরখাম থেকে পালিয়ে যায়। হারলিন কুইঞ্জেল থেকে জন্ম হয় হার্লি কুইনের।
ড্যানিয়েল প্লেইনভিউ (দেয়ার উইল বি ব্লাড)
‘দেয়ার উইল বি ব্লাড‘ চলচ্চিত্র যারা দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কার কথা বলছি। আর বাকিদের জন্যে ‘স্পয়লার অ্যালার্ট’!
এই চলচ্চিত্র নিয়ে বেশিরভাগ আলোচনায় ড্যানিয়েল প্লেইনভিউকে আখ্যায়িত করা হয়েছে সিনেমার ভিলেন হিসেবে। কিন্তু আসলেই কি সে খুব বেশী খারাপ লোক ছিল? একজন পরিপূর্ণ ভিলেনের চরিত্রগত কিছু বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল বটে, কিন্তু তা-ও প্লেইনভিউকে বড়জোর এন্টি-হিরো বলা যায়, ভিলেন নয়। কারণ সবকিছুর পরেও তাকে কখনও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কারো কোনো ক্ষতি করতে দেখা যায়নি।
সিনেমার এক পর্যায়ে সে সকলের সামনে তার ভাই হেনরি এবং সেখানকার ধর্মীয় গুরু সানডের আসল রূপ উন্মোচন করে দেয়, যারা এতদিন ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। এই দুজনকে থামাতে তাদেরকে মেরে ফেলাই ছিল সবচেয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ। আর শুধুমাত্র এই কারণে প্লেইনভিউকে ভিলেন বলাটা ভুল হবে। সে নিছকই একজন সাধারণ মানুষ যে জগতের মুখোশধারী ভালো মানুষদের অবিচার আর মুখ বুজে সহ্য করতে পারছিলো না।
লকি লাউফিসান (মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স)
হঠাৎ একদিন জানতে পারলেন যে, ছোটবেলা থেকে যাদেরকে বাবা-মা আর ভাই বলে জেনে এসেছেন, তারা আসলে আপনার আপন কেউ না, তখন স্বাভাবিকভাবে সবারই পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার মতো অবস্থা হবে। ঠিক এমনটাই ঘটেছে মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের অন্যতম ভিলেন লকির জীবনে।
লকি বেড়ে উঠে আসগার্ডিয়ান রাজ-পরিবারে, তাদের আপন সন্তান থরের ভাই হিসেবে। থর আর লকি বড় হওয়ার পর তাদের পিতা অডিন, আপন ছেলে থরকে আনুষ্ঠানিকভাবে আসগার্ডের নতুন রাজা ঘোষণা করার বন্দোবস্ত করেন। এর কিছুদিন পরেই ঘটনাক্রমে লকি সে জানতে পারে যে, এতদিন যাদের ঘরে বেড়ে উঠেছে তারা তার আপন কেউ নয়, সে আসলে আসগার্ডিয়ান চিরশত্রু ফ্রস্ট জায়ান্টদের নেতা লৌফির সন্তান। সে মনে করতে শুরু করে, তাকে এই ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে যুদ্ধ জয়ের পুরষ্কার হিসেবে। সেদিন থেকেই ভাই আর বাবার প্রতি সে ভেতরে ভেতরে ঘৃণা আর রাগ পুষতে শুরু করে। নিজের অস্তিত্ব আর ক্ষমতা জাহির করার জন্য বিভিন্ন কার্যকলাপ শুরু করে। তার চাওয়া বেশি কিছু ছিলো না, সে চেয়েছিল বাবার ভালোবাসা, ভাইয়ের সমান অধিকার এবং মুছতে চেয়েছিল তার স্বজাতি ফ্রস্ট জায়ান্টদের কলঙ্ক। কিন্তু সকল চেষ্টা ভেস্তে যায়। বারবার ব্যর্থতার ফলে জন্ম হয় এক সুপার-ভিলেনের।
অসওয়াল্ড কবলপট (ডিসি ইউনিভার্স)
পুরো নাম অসওয়াল্ড চেস্টারফিল্ড কবলপট, অবশ্য অদ্ভুত দৈহিক গঠনের কারণে তাকে অনেকটা বেটে পাখির মতো দেখায় বলে সে পেঙ্গুইন নামেই বহুল পরিচিত। তার শৈশব আর কৈশোর ছিল খুবই বেদনাদায়ক। তার মা ছাড়া সবাই তার দিকে তাকাতো ঘৃণা আর বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে। পাড়ার সবাই তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকারা করতো, এমনকি আপন বাবা আর ভাই তার সাথে করতো কুকুরের মতো আচরণ । স্কুলের সহপাঠীরা প্রায়ই তার চার হাত-পা ছড়িয়ে বানরের খাঁচায় বেঁধে রাখতো যাতে তাকে পাখির মতো দেখায়।
ভাই আর সহপাঠীদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ অসওয়াল্ড বনের পশু-পাখিদের সাথে শখ্যতা গড়ে তুলে। নিজের হাতে পাখিদের জন্য একটি ঘর তৈরি করে, এর ভেতরে ডিম পাড়ার জন্যে ছোট ছোট খুপরি বানিয়ে দেয়। কিন্তু তা-ও শান্তি বুঝি তার কপালে নেই। একদিন ভাই তার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এসে অসওয়াল্ডের পক্ষীশালায় আক্রমণ করে সবগুলো পাখির বাসা ভাঙ্গা শুরু করে। ডিমগুলোর মাটিতে পরে ভাঙার দৃশ্য দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকে সে।
এভাবে দিনের পর দিন শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার সইতে না পেরে অসওয়াল্ড নিজেকে সমাজচ্যুত ভাবতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যায় এবং অপরাধের অন্ধকার জগতে পা বাঁড়ায়। একসময় সে হয়ে উঠে গোথাম সিটির কুখ্যাত ভিলেনদের মধ্যে একজন।
মি. ফ্রিজ (ডিসি ইউনিভার্স)
ডিসি ইউনিভার্সের আরেক বিপজ্জনক ভিলেন মি. ফ্রিজ। ভিলেনের খাতায় নাম লেখানোর আগে সে ছিল প্রতিভাবান একজন বিজ্ঞানী, নাম ভিক্টর ফ্রাইস। তার স্ত্রী নোরা দুরারোগ্য এক ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিল আর রোগের নিরাময় করতে প্রয়োজন সমৃদ্ধশালী নিজস্ব একটি গবেষণাগার। সেজন্যে ভিক্টর বড় একটি কর্পোরেট কোম্পানির গবেষণাগারে চাকরি নেয়। এদিকে স্ত্রীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে শুরু করলে কোনো উপায় বের করতে না পেরে তাকে ক্রায়োস্লিপে সাস্পেন্ডেড অ্যানিমেশনে রেখে গবেষণার কাজ চালিয়ে যায় ভিক্টর।
কোম্পানির মালিক ফেরিস বয়েল ছিল খুবই দুষ্ট প্রজাতির লোক। ভিক্টর যে নিজের স্ত্রীর রোগ নিরাময়ের জন্যে ল্যাবের উপকরণ ব্যবহার করছে সেটা বয়েল টের পেয়ে যায়, পোষা গুণ্ডাপাণ্ডা নিয়ে ল্যাবে হামলা চালায়। দুর্ঘটনাক্রমে ভিক্টর লিকুইড নাইট্রোজেন সল্যুশনে পড়ে যায় আর নাইট্রোজেনের ক্রিয়া তার শরীরের সাধারণ অবস্থার অসংগতি ঘটায়। মারা না গেলেও তাকে চলাফেরা করতে হয় এক ধরণের বিশেষ থার্মাল স্যুট পরে। আর সেটা সচল রাখতে প্রয়োজন হীরা, জন্ম হয় মি. ফ্রিজের।
হীরা চুরি করতে যেয়ে তার সাথে ব্যাটম্যানের শত্রুতার শুরু হয়। ব্যাটম্যানের অন্য ভিলেনদের সাথে ফ্রিজের পার্থক্য হলো তার ভিলেন-দশার পেছনে কাজ করছে, নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে স্ত্রীর রোগ নিরাময়ের উপায় খুঁজে বের করার প্রেরণা।
ম্যাগনিটো (এক্স-মেন ইউনিভার্স)
মারভেলের এক্স-মেন ইউনিভার্স মূলত বিশেষরূপে অভিযোজিত এক ধরনের সুপার-হিউম্যানদের নিয়ে গঠিত, যাদেরকে সামষ্টিকভাবে বলা হয় ‘মিউট্যান্টস‘। মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম যেমন ‘হোমো সেপিয়েন্স’, তেমনি মিউট্যান্টদের হচ্ছে ‘হোমো সুপিরিয়র’। ম্যাগনিটো নামে পরিচিত ম্যাক্স আইসেনহার্টও হোমো সুপিরিয়ের গোত্রের অন্তর্গত এবং সবচেয়ে শক্তিশালী মিউট্যান্টদের মধ্যে একজন। তার ক্ষমতা হচ্ছে ‘ম্যাগনেটিজম ম্যানিপুলেশন’ এবং অন্তর শক্তি দিয়ে বস্তু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্থাৎ যেকোনো ধাতব বস্তু সে তার চিন্তাশক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
একসময় ‘প্রফেসর এক্স‘ নামের এক মিউট্যান্ট এই ম্যাগনিটোর সহায়তায় অন্য মিউট্যান্টদের নিয়ে ‘এক্স-মেন‘ নামের একটি দল গঠন করেন। শুরুর দিকে ম্যাগনিটো আর প্রফেসর এক্সের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তবতা পরবর্তীতে দুজনের রাস্তা আলাদা করে দেয়। প্রফেসর এক্স মনে করতেন চেষ্টা করলেই মানুষ আর মিউট্যান্টরা একসাথে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের নিষ্ঠুরতা দেখে বেড়ে উঠা ম্যাগনিটোর চোখে মানুষ আর মিউট্যান্টদের একসাথে থাকা অসম্ভব ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল মানুষ মিউট্যান্টদের ক্ষমতা এবং জটিলতা সহজভাবে নিবে না। কারণ মানুষের ধর্ম হলো তারা যা বোঝে না সেটাকে মেনে নিতেও পারে না। এতে করে মিউট্যান্ট আর মানুষের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকবে।
সে পরিকল্পনা করে মিউট্যান্টদের নিয়ে আলাদা কোথাও বসবাস শুরু করার। মানুষ যাতে সেখানে তাদেরকে বিরক্ত করতে না আসে তাই ভয় দেখানোর জন্য মিউট্যান্টদের নিয়ে এমন কিছু কাজ শুরু করে যার ফলে মানুষেরা তাদেরকে ভয়ের পাশাপাশি ঘৃণা করতে শুরু করে। ফলাফল হয় উল্টো, মানুষেরাও পরিকল্পনা করে মিউট্যান্টদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার। শুরু হয় মিউট্যান্ট আর মানুষের মধ্যে যুদ্ধ।
শুধুমাত্র তার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা দেখে তাকে ভিলেন বলাটা ভুলই হবে। প্রফেসর এক্স লড়ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে আর ম্যাগনিটো শুধুমাত্র মিউট্যান্টদের পক্ষে; এজন্যে প্রায়শই এদের দুজনকে রূপকার্থে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং ম্যালকম এক্স-এর সাথে তুলনা করা হয়।
লেক্স লুথোর (ডিসি ইউনিভার্স)
লেক্স লুথোরেকে বলা হয় ডিসি ইউনিভার্সের সবচেয়ে স্মার্ট এবং প্রতিভাবান ব্যক্তি। তার জন্ম মেট্রোপলিসের এক ধনী পরিবারে। বেড়ে ওঠার পর সে মেট্রোপলিসে ‘লেক্সকর্প‘ নামে একটি কারিগরি কোম্পানি নির্মাণ করে। ধীরে ধীরে তার কোম্পানি অনেক বিস্তৃতি লাভ করে এবং শহরের অধিকাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় সেখানেই। আর্থিক সাফল্যের সাথে সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ফলে একসময় সে হয়ে ওঠে মহানগরের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি।
এরপর একদিন এলো যখন মানুষ লুথোরের আকাশচুম্বী ইমারত ছাড়িয়েও চোখ মেলে খুঁজতে লাগলো আরও দূর আকাশে, বিশেষ একজনকে। সেই বিশেষ একজন ছিল সুপারম্যান। তার আগমন সেদিন লুথোরের দুনিয়া ওলটপালট করে দিয়েছিল। দিনের পর দিন যার নিঃস্বার্থভাবে মেট্রোপলিসের মানুষকে সাহায্য করা লেক্সের অস্তিত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলে। অথচ সুপারম্যান আসার আগে সেই ছিল মেট্রোপলিসের সবচেয়ে জনদরদী ব্যক্তি। সুপারম্যানকে সে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে শুরু করে আর তাকে ধ্বংস করার জন্য বিপজ্জনক সব পরিকল্পনা করতে শুরু করে। বারবার ব্যর্থ হয়েও সুপারম্যানকে মারার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। এককালে সদাশয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত লেক্স লুথোর পরবর্তীতে পরিণত হন শহরের বিপজ্জনক একজন খলনায়কে।
রেইশ আল গুল (ডিসি ইউনিভার্স)
রেইশ আল গুলের জন্ম আজ থেকে প্রায় সাতশো বছর আগে, এক আরব রাজ্যের মরুভূমিতে বসবাসকারী যাযাবর গোষ্ঠীতে। অল্প বয়সেই বিজ্ঞানশাস্ত্রের প্রতি তার আকর্ষণ জন্মায়। কিন্তু তার যাযাবর গোষ্ঠীর কারণে সে এক জায়গায় বেশিদিন পড়াশোনা করতে পারতো না। তাই সে তার গোত্র থেকে আলাদা হয়ে শহরে চলে যায় পড়াশোনা করার জন্যে। পড়াশোনা শেষ করে সে চিকিৎসক হয় আর তার প্রেমিকা ‘সরা’কে বিয়ে করে। এর পরপরই এক গুহার ভেতরে মরণাপন্ন মানুষকে পুনর্জীবিত করার ‘ল্যাজারাস পিট’ আবিষ্কার করে রেইশ।
সেই রাজ্যের রাজা একদিন তার অসুস্থ ছেলেকে চিকিৎসার জন্যে রেইশের কাছে নিয়ে আসেন। রাজকুমারের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, রেইশ বাধ্য হয়ে তাকে ল্যাজারাস পিটে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ পর রাজকুমার বদ্ধ উন্মাদ হয়ে ল্যাজারাস পিট থেকে বেরিয়ে আসে। বের হয়েই সে রেইশের স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা করে। ছেলের এই অবস্থার জন্যে রাজা রেইশকে দোষী সাব্যস্ত করে একটি খাঁচায় তার মৃত স্ত্রীর সাথে বন্দী করে রাখেন। অবশেষে একদিন এক ছেলে তার বৃদ্ধা মাকে বাঁচানোর জন্যে রেইশকে সেই খাঁচা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও বৃদ্ধা মহিলাকে বাঁচাতে না পারলে মহিলার ছেলেকে সাথে নিয়ে তার পুরনো গোত্রের কাছে ফিরে যায় সে।
জীবনে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনায় বিধ্বস্ত রেইশ রাজার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার পণ করে। রেইশের চাচা ছিল গোত্রের প্রধান, তার সাহায্যে রাজকুমারের কাছে রোগে সংক্রমিত কিছু কাপড় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সেই কাপড় পরার ফলে রাজকুমার অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজা আবার তাকে রেইশের কাছে নিয়ে আসে। প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে সে রাজা আর রাজকুমারকে খুন করে এবং নিজেকে ‘ডিমন্স হেড’ হিসেবে দাবী করে। গোত্রের বলিষ্ঠ কিছু যুবকদের নিয়ে সে ‘লিগ অফ অ্যাসাসিন্স’ নামের একটি দল গঠন করে।
যুগের পর যুগ মানুষে মানুষে যুদ্ধ, হানাহানি আর ভেতরের বর্বরতা দেখে একসময় রেইশ হয়ে উঠে একজন ইকো-টেরোরিস্ট এবং তার লিগ অফ অ্যাসাসিন্সকে ব্যবহার করে পৃথিবী থেকে সব অশুভ দূর করার জন্যে। কিন্তু তার ইচ্ছা হচ্ছে সমস্ত মানবতা ধ্বংস করে নতুন করে শুরু করার আর তখনই তার সাথে ফ্যাসাদ বাধে ব্যাটম্যান এবং জাস্টিস লিগের।
জেনারেল জড (ম্যান অফ স্টিল)
জড পরিবারে জন্ম নেয়া জেনারেল জডের আসল নাম ড্রু-জড। ক্রিপটনের ‘এল’ পরিবার নিয়োজিত ছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে। অন্যদিকে, জড পরিবার ছিল সেনাবাহিনীর প্রধান এবং জডদের পূর্বপুরুষরাই একসময় ক্রিপটন শাসন করতো। পরে ক্রিপটনের সায়েন্স কাউন্সিল ক্ষমতায় আসে; আর যেহেতু গ্রহের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখাই ছিল জডদের মূল লক্ষ্য, সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব তাদের উপরই বহাল থাকে।
ক্রিপটন ধ্বংসের বেশ কিছুদিন আগে বাল্যবন্ধু জর-এল তাকে ডেকে বলে, তাদের গ্রহের কোর (কেন্দ্রীয় দৃঢ় মজ্জা) নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর খুব শীঘ্রই ক্রিপটন চিরতরে ধ্বংস হতে চলেছে। তারা দুজন মিলে ব্যাপারটি ক্রিপটনের হাই-কাউন্সিলকে জানায়। কিন্তু তাদের কথা হাই-কাউন্সিলকে প্রভাবিত করার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। এমনকি এ ব্যাপারে আর কথা বলতেও তাদেরকে নিষেধ করা হয়। নিজেদের মধ্যে আলোচনার এক পর্যায়ে তারা দুজন ভিন্ন দুই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। জর-এল তার বিজ্ঞান আর কার্যকারণের উপরই বিশ্বাস রাখে। অপরদিকে জড ‘সোর্ড অব রাও’ নামে একটি পরিষদ গঠন করে এবং নতুন এক গ্রহ খুঁজে বের করে ক্রিপটনবাসীদের নিয়ে সেখানে নতুনভাবে জীবন শুরু করার পরিকল্পনা করে।
জড তার পরিকল্পনার কথা জর-এলকে জানায় এবং তার সহযোগিতা চায়। কিন্তু জর-এল এর বিরোধীতা করলে তাদের দুজনের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। এদিকে জড আসার আগে জর-এল তার সন্তানকে একটি ছোট মহাকাশযানে করে গ্রহের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছিল, জড আর জর-এল যখন মারামারিতে ব্যস্ত, তখন জর-এলের স্ত্রী লারা লর-ভান মহাকাশযানটি চালু করে গ্রহের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। মারামারির এক পর্যায়ে জড জর-এলকে খুন করে। ক্রিপটনের সেনাবাহিনীর একটি পুনর্গঠিত দল এসে জড আর তার সহচারীদের গ্রেফতার করে আইন পরিষদের সামনে দাঁড় করায়। জর-এলকে হত্যা এবং হাই-কাউন্সিলের বিরোধীতা করার জন্যে জড আর তার সহচারীদের ফ্যান্টম জোনে নির্বাসিত করা হয়। নির্বাসিত হওয়ার আগে জড লারা লর-ভানের দিকে তাকিয়ে বলে যেভাবেই হোক সে লারা এবং জর-এলের সন্তানকে খুঁজে বের করে খুন করবে।
এর কিছুদিন পর ক্রিপটন ধ্বংস হয়ে গেলে জড ফ্যান্টম জোন থেকে ছাড়া পায় এবং খোঁজ পায় পৃথিবীর। পৃথিবীকে দ্বিতীয় ক্রিপটনে রূপান্তর করার পরিকল্পনা নিয়ে সে পৃথিবীতে আসে। সমস্যা ছিল একটাই, ক্রিপটনে রূপান্তর করতে গেলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ধ্বংস হয়ে যাবে, যার ফলে পৃথিবীতে বসবাসরত বাসিন্দারা সবাই মারা পরবে। ব্যাপারটা তার দিক থেকে বিচার করুন, আপনার গ্রহ ধ্বংস হয়ে গেছে, এখন আপনার কাছে এমন এক কারিগরি যন্ত্র রয়েছে যা দিয়ে চাইলেই আপনি আরেকটা গ্রহকে হুবহু আপনার গ্রহের অবস্থায় নিতে পারবেন; কিন্তু তাঁতে সেই গ্রহের অধিবাসীরা মারা যাবে। এখন আপনি কি সেই গ্রহের অধিবাসীর স্বার্থ দেখবেন নাকি আপনার স্বজাতির স্বার্থ দেখবেন? জড এখানে যা করেছে তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো তাই-ই করতো।
দ্য জোকার (দ্য কিলিং জোক)
এমনিতেই রুজি-রোজগার নেই, তার উপর ঘরে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী! এমতাবস্থায় কারো পক্ষেই স্বাভাবিক থাকা সম্ভব নয়। স্ত্রী জেনাইনের হাসপাতালের খরচ জোগাড়ে মরিয়া জ্যাকও শেষমেশ কিছু দুর্বৃত্তের সাথে হাত মিলিয়ে এক রাসায়নিক কারখানায় ডাকাতি করার পরিকল্পনা করে। কৌতুকাভিনেতার কর্মজীবন শুরুর আগে সে একসময় সেই কারখানার ইঞ্জিনিয়ার ছিল। ভেতরের সবকিছু ছিল তার নখদর্পণে। এজন্যে চালাকি করে তাকে দলনেতা হিসেবে ঠিক করে কুখ্যাত ‘রেড-হুড’ পরিয়ে দেয় সাথের অপরাধীগুলো।
ডাকাতি করতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে পুলিশ জ্যাককে ফোন করে জানায় যে, হাসপাতালে দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী এবং গর্ভের সন্তান দুজনই মারা গেছে। শোকে বিহ্বল জ্যাক প্রথমে পিছু হটতে চাইলেও তাকে জোর করে কারখানায় নিয়ে যায় সাথের দুজন।
কারখানায় পৌঁছে তারা দেখে সেখানকার নিরাপত্তা দ্বিগুণ করা হয়েছে। তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ক্রিমিনাল দুজন পুলিশের গুলিতে মারা পরে। আর রেড-হুডকে ধরতে হাজির হওয়া ব্যাটম্যানকে দেখে ভয়ে পিছু হঠতে যেয়ে পা ফসকে রাসায়নিক পদার্থে ভরা ফুটন্ত পাত্রে পড়ে যায় জ্যাক। ঘটনার বেশ কিছুক্ষণ পর পাত্রের সাথে যুক্ত এক জলপথ দিয়ে সে বাইরে এসে পরে। মাথায় পরে থাকা রেড-হুড খুলে দেখে, রাসায়নিক পদার্থের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় তার গায়ের চামড়া মড়ার মতো সাদা আর চুলের রং কেমন সবুজ হয়ে গেছে।
স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুশোক আর ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তার অবস্থার জন্যে সে দায়ী করে ব্যাটম্যানকে, জন্ম হয় সিনেমাটিক ইউনিভার্সের অন্যতম ভিলেন জোকারের! জোকারের অনেকগুলো উৎপত্তির মধ্যে এটি অন্যতম। তবে তার আসল অতীত আজও সকলের অজানা। কারণ তার ভাষ্যে “অতীত যদি থাকতেই হয়, আমি চাই বেছে নেবার মতো আমার একাধিক অতীত থাকুক”।
ডার্থ ভ্যাডার (স্টার ওয়ার্স)
ফিকশনাল জগতের ইতিহাসে কোনো চরিত্রই ডার্থ ভ্যাডারের মতো ‘ব্যাডঅ্যাস’ হতে পারবে না, এমনকি ব্যাটম্যানও নয়। স্টার ওয়ার্স তো বটেই, গোটা সিনেমাটিক ইউনিভার্সের সবচেয়ে প্রতাপশালী ভিলেনদের মধ্যে একজন সে। তার অতীত ছিল খুব দুঃখজনক। ‘ডার্থ ভ্যাডার’ হওয়ার আগে তার নাম ছিল ‘অ্যানাকিন স্কাইওয়াকার’। শিশু অ্যানাকিন তার মাকে নিয়ে বাস করতো ট্যাটুইন নামের এক গ্রহে। সেখানকার এক টয়দারিয়ান জাঙ্ক ডিলার ওয়াটোর ক্রীতদাস ছিল সে আর তার মা।
হঠাৎ একদিন ট্যাটুইনে হাজির হয় জেডাই মাস্টার কুই-গন জিন, প্যাডমে, সি-থ্রিপিও, আরটূ-ডিটু এবং জার জার বিঙ্কস। প্রথমবারেই প্যাডমেকে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয় অ্যানাকিন। আর এদিকে তাকে দেখে মাস্টার জিন বুঝতে পারে এই ছেলের মধ্যে বিশেষ কিছু একটা আছে যা ‘ফোর্স’ আর ‘মিডিক্লোরিয়ান কাউন্টে’র সাথে সম্পৃক্ত এবং সে চাইলে ইউনিভার্সের সবচেয়ে শক্তিশালী জেডাই নাইট হতে পারবে। মাস্টার জিন তাকে তার ক্রীতদাসের জীবন থেকে মুক্ত করে ‘জেডাই হাই কাউন্সিল’-এ নিয়ে আসে। এক দুর্ঘটনায় কুই-গন মারা গেলে অ্যানাকিনের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় অবি-ওয়ান কেনোবির উপর।
জেডাই অর্ডারে নিয়ম ছিল কোনোভাবেই প্রেম-ভালোবাসায় জড়ানো যাবে না। কিন্তু সেই ভুলটিই করে বসে অ্যানাকিন, ভালোবেসে ফেলে ‘নাবু’ গ্রহের রাজকন্যা প্যাডমে অ্যামিডালাকে। বহু কষ্টে জেডাই কাউন্সিলের কাছে ব্যাপারটি গোপন রাখে সে।
পরে এক সময় প্যাডমেকে নিয়ে ভয়ানক বিপদে পড়লে বাধ্য হয়ে জেডাইদের চিরশত্রু সিথলর্ড ‘ডার্থ সিডিয়াসের’ শরণাপন্ন হয় অ্যানাকিন। কিন্তু শেষ রক্ষা বুঝি আর হয় না! দুর্ঘটনায় হারাতে হয় ভালোবাসার মানুষটিকে। আর অ্যানাকিনের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে ডার্থ সিডিয়াস তাকে রূপান্তর করে সিথ লর্ড ‘ডার্থ ভেডারে’। যে জেডাই নাইটের সিথদের ধ্বংস করার কথা, সে নিজেই হয়ে যায় সিথ লর্ডদের একজন।
ভালোবাসার মানুষটির জন্যে অ্যানাকিন যা করেছে তার জায়গায় অন্য কেউ হলে এমনটাই করবে। যার খেসারত দিতে তাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে তার নীতি, তার শিক্ষা। প্রিয়জন হারানোর ব্যথায়, রাগে-দুঃখে সে হেঁটে চলে গিয়েছে অপরাধের অন্ধকার সম্রাজ্যে, যেখান থেকে ফেরত আসার কোনো উপায় ছিলোনা।
এরকম আরও অনেক ভিলেন রয়েছে, যাদেরকে দেখে প্রথমে খারাপ মনে হলেও, তাদের অতীত যাচাই করে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আপাতদৃষ্টিতে তাদেরকে হয়তো ততটা খারাপ মনে না-ও হতে পারে। অপরাধ-জগতের অন্ধকার পথ বেছে নেয়ার পিছনে তাদের রয়েছে তিক্ততায় পরিপূর্ণ এক অতীত। কেউ বা সে পথে পা বাড়িয়েছে নিজের ভালোবাসাকে রক্ষা করতে, কেউ নিজের স্বজাতি টিকিয়ে রাখতে, কেউ আবার নিজের অনুসারীদের জন্যে। আবার কেউ বৃহত্তর স্বার্থে সাধারণের চোখে খলনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।