“কর্নুকোপিয়ার বাকি জনগণ যতটুকু জানে, তাতে মার্শল্যান্ডসের স্মরণীয় জিনিস একটাই আছে। আর তা হচ্ছে ইকাবগের কিংবদন্তী!”
কিংবদন্তি কখন সত্য হয়ে দাঁড়ায়? লোককাহিনির খোলস থেকে কল্পনার নির্যাসটুকু সরিয়ে নিলে সন্ধান মেলে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের। তখন ইতিহাস আমাদের বাস্তবতার গল্প শোনায়। নিখাদ সেই গল্পের প্রত্যেকটা বাঁকে এসে মিশে যায় পূর্বসূরীদের গাঁথা। জড়িয়ে থাকে আমাদের প্রাচীন জীবনের আখ্যান। ইকাবগের কিংবদন্তি মূলত কর্নুকোপিয়ার পুরনো অতীত সম্পর্কে জোরালো একটা ধারণা দেয়। যেখানে ভয়ঙ্কর এক দানবের উদ্ভব ঘটে। হিংস্রতার জানান দেয়। দানবের নাম ইকাবগ। মার্শল্যান্ডসের কুয়াশাচ্ছন্ন জলাভূমিতে তার নিবাস।
কর্নুকোপিয়া রাজ্যের খ্যাতি রয়েছে সুস্বাদু খাবারের জন্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাজ্যের প্রত্যেক শহরই বিশেষ বিশেষ খাবারের জন্য বিখ্যাত। রাজধানী শোক্সভিলের ‘হোপস-অব-হেভেন’ পেস্ট্রির মিষ্টতা চোখ দিয়ে রীতিমতো তৃপ্তির জল ঝরায়। এমনকি চমৎকার এই পেস্ট্রির বিনিময়ে প্লুরিটানিয়ার রাজা নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতেও রাজি হয়ে যায়! অন্যদিকে কার্ডসবার্গ শহরে প্রস্তুত হয় মখমলের মতো পনির। ব্যারনস্টাউনের মসলাদার সসেজ কিংবা পাইয়ের স্বাদও কম না। আবার জেরোবোমের রাস্তায় রাস্তায় মাদকতা। ওয়াইন উৎপাদনে দারুণ পারদর্শী এই শহরের মানুষ।
তবে জেরোবোম থেকে কিছুটা উত্তরে গেলে দেখা পাওয়া যায় এক অদ্ভুত শহরের। মার্শল্যান্ডস। জঘন্য ধরনের মাশরুম চাষ করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত এখানকার ভূমি। প্রকৃতপক্ষে মার্শল্যান্ডাররা কর্নুকোপিয়ার অন্যান্য শহরের অধিবাসীদের ন্যায় সুখী জীবনযাপনে অভ্যস্ত নয়। ট্যালটেলে ঝোল খেয়ে কোনোরকমে দিন কাটায় তারা। অথচ রাজ্যবাসী তাদের সরলতার দাম দেয় না। উদ্ভট আখ্যা দেয়, বিদ্রুপ করে।
দৈন্যে নুয়ে পড়া মার্শল্যান্ডসের আদতে গৌরব করার মতো কিছু নেই। যা আছে, তা এক গৌরবহীন দানবের কিংবদন্তি। ইকাবগের কিংবদন্তি। কিন্তু যখন এই কিংবদন্তি চরম সত্য হয়ে আঘাত হানবে কর্নুকোপিয়ার বুকে, কী হবে তখন? ফিরে আসবে কি হারানো গৌরব?
হ্যাঁ, ইকাবগের কিংবদন্তি একসময় সত্য হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু একটু অন্যভাবে। কর্নুকোপিয়ার প্রধান উপদেষ্টা, লর্ড স্পিটলওর্থ ইকাবগকে নিয়ে মিথ্যে রটায় রাজ্য জুড়ে। ফলস্বরূপ ইকাবগের ভয়াবহতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয় রাজ্যবাসী। ভীত জনগণের বোকামির সুযোগটা লুফে নেয় প্রধান উপদেষ্টা। সঙ্গী হয় লর্ড ফ্ল্যাপুন, মেজর রোচ, মা গ্রান্টার, অটো স্ক্রাম্বল, বেয়ারা ক্যানকারবিসহ আরও অনেকেই। আবিষ্কৃত হয় জনগণের কাছ থেকে কর আদায়ের নতুন নতুন ফন্দি। প্রতিবাদ? প্রতিবাদ করতে গেলে ভাগ্যে জোটে কঠোর শাস্তি। মৃত্যু, নয়তো তলকুঠুরির চিরকালীন বন্দিত্ব।
আর কর্নুকোপিয়ার রাজা ফ্রেড। প্রধান উপদেষ্টার মিথ্যে আশ্বাসের শিকার হয়ে বিভিন্ন ধরনের অহেতুক কাজে ব্যস্ত থাকত রাজা। এদিকে রাজ্যের আসল খবর তার নাগালের বাইরে থেকে যেত। কিন্তু মিথ্যা এমন এক জিনিস, যা একবার বলা শুরু করলে আর থামা যায় না। বাহ্যিক স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ হয়তো সেটা মেটায়, অন্যদিকে ভেতরটা হয়ে ওঠে অন্তঃসারশূন্য। সামান্য জিনিস জড়ো করতে গিয়ে স্বর্ণের চেয়েও দামি কিছু একটা হারিয়ে যায়, অথচ টের পাওয়া যায় না।
একদিকে স্পিটলওর্থের পকেট ভারি হয়। অন্যদিকে জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা হয় কঠিন থেকে কঠিনতর। কর্নুকোপিয়ার মতো সমৃদ্ধ রাজ্যে জেঁকে বসে ক্ষুধার জ্বালা। আহা! খেতে না পারার কী ভীষণ কষ্ট!
কিন্তু এতসব হাহাকারের মধ্যেও দুয়েকটা মন ভালো করার মতো গল্প খুঁজে নিতে হয়। দুর্দিনে টিকে থাকার ইচ্ছেটা জিইয়ে রাখতেও যে এক মুঠো আশা চাই। রোলিংয়ের ইকাবগে হাঁপ ছেড়ে বাঁচার মতো আনন্দদায়ক যে গল্প, তার মূলে রয়েছে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব। ডেইজি আর বার্ট একদম ছোটবেলার বন্ধু। পরবর্তী সময়ে নানা রকমের ঘাত-প্রতিঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে এদের সঙ্গী হয় আরও দুজন- মার্থা আর রোডারিক। কাহিনির একপর্যায়ে এসে এই চারজন ছোট গড়নের মানুষ যে ধরনের কাজ করে দেখায়, বড়রা তেমন কিছু করার কথা ভাবতেও পারবে না!
তারা মার্শল্যান্ডসে গিয়ে ইকাবগের খোঁজ পায়। সত্যিকারের ইকাবগ! একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে তারপর। যাকে নিয়ে এতসব কিংবদন্তী প্রচলিত, সেই ইকাবগ কিনা এক গৌরবহীন দানব! কিন্তু কেমন হবে, যদি কর্নুকোপিয়ার হারানো সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনে ইকাবগের মতো এক গৌরবহীন দানব? গৌরব করার মতো কিছুই নেই যার কাছে, সেই সবার আগে কর্নুকোপিয়ার গৌরব পুনরুদ্ধার করতে চায়।
‘দি ইকাবগ’ বইয়ের জনরা মোটাদাগে রূপকথা। পাঠক মূলত ছোটরা। কিন্তু বড়দের পড়ার জন্যও অনেক খোরাক আছে এ বইয়ে। ইকাবগে আছে এমন এক রূপকথার রাজ্য, যার পরতে পরতে বাস্তবতার ঘ্রাণ। খোলসটা মূলত ছোটদের জন্য। তারা নতুন গন্ধ, নতুন স্বাদ নেবে। কিন্তু খোলসের আড়ালে যা রয়ে গেল, সেটা মূল্যায়নের জন্য প্রাপ্তমনস্ক হওয়া জরুরি।
রূপকথার খোলসটা পেরিয়ে গেলেই বইয়ের প্রকৃত স্বরূপটা জানা যায়। হিউমারের চমৎকার প্রয়োগ ঘটেছে এখানে। লোককাহিনির বিশুদ্ধতা, উপকথার কল্পনাশক্তি, ফ্যান্টাসির জাদুকরী সাম্রাজ্যের সাথে মিলেমিশে এক হয়ে যায় রাজনীতির হিসেবনিকেশ। আর পুরোটা জুড়ে দিলে যা হাতের নাগালে আসে, তাকে নিছক রূপকথার গল্প বললে খুব ভুল হয়ে যাবে।
এ যেন একটু অন্যরকম রূপকথার মলাট। লেখক মূলত বড়দের বিচিত্র সব সমস্যাকে ছোটদের উপযোগী করে তুলে ধরেছেন বইয়ের পাতায়। গল্প বলার ছলে ছোটরা যেন জীবনের অন্ধকার দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট একটা ধারণা পেয়ে যায়, সেই লক্ষ্যেই ইকাবগের কিংবদন্তির অবতারণা।
কিন্তু অন্ধকারকে জানার কী এমন প্রয়োজন পড়ল ছোটদের? এই প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর দিতে পারবে আমাদের সাম্প্রতিক সময়।
বৈশ্বিক মহামারির ভয়াবহতা আমাদের প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু শেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। মৃত্যু এখানে স্রেফ একটা সংখ্যা। পৃথিবীতে কখন কার মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে, কেউ কি সেটা বলতে পারবে? তাইতো লকডাউন জীবনের কঠিন বাস্তবতার সাথে ছোটদেরও খাপ খাইয়ে নিতে হবে। আর এই প্রক্রিয়া ঠিকঠাক নিশ্চিতের লক্ষ্যে কার্যকর একটা পদক্ষেপের নাম, ‘দি ইকাবগ’।
হ্যারি পটারের বইগুলো লেখার সময় লেখক জে. কে. রোলিং একটু একটু করে ‘দি ইকাবগ’ লিখতেন। অসম্পূর্ণ ইকাবগের গল্পটা দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাক্সবন্দি হয়ে ছিল। অবশেষে করোনাকালে এলো সুবর্ণ সুযোগ। লকডাউনের একঘেয়ে জীবন রাঙিয়ে তুলতে তিনি ইকাবগকে উপহার দিলেন একটা সুন্দর সমাপ্তি। অনলাইনে বিনামূল্যে প্রকাশিত হলো কাঙ্ক্ষিত রূপকথার বই। পাতার ভাঁজে লুকিয়ে থাকা কল্পনার রাজ্যকে ক্যানভাসে নামিয়ে আনল ছোটরা। আঁকা হলো চমৎকার সব ছবি।
পরে কাগজে ছাপা হয় ইকাবগের কিংবদন্তি। ছোটদের আঁকা ছবিগুলোও জায়গা করে নেয় বইয়ের পাতায়। কাঁচা হাতের ইলাস্ট্রেশনগুলো নিখুঁত নয়, তবে মর্মস্পর্শী।
কর্নুকোপিয়ার ওয়ার্ল্ড বিল্ডিংয়ের ব্যাপারটা বইয়ের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক। শোক্সভিল থেকে শুরু করে মার্শল্যান্ডস- যত্নের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে প্রত্যেকটা শহরের সমাজব্যবস্থা। তথ্যগুলো এত নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে, যার কারণে মনশ্চক্ষে দেখার কাজটাও অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। পুরো কৃতিত্বই লেখকের। অনুবাদকের ভূমিকাও কম নয়। ধরে ধরে প্রতিটি লাইনের ভাষান্তর করেছেন সালেহ আহমেদ মুবিন। অপ্রচলিত অথচ সুন্দর কিছু শব্দের ব্যবহার মূল বইয়ের গাম্ভীর্য রক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর বলে মনে হয়েছে।
দুর্নীতি গ্রস্ত শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি একটা সমৃদ্ধ রাজ্যকে কোন ভয়াবহতার দিকে ঠেলে দেয়, সেটার খানিকটা ধারণা পেতে চাইলে বেছে নিতে পারেন ‘দি ইকাবগ’। গৌরবহীন দানবের এই গল্পটা এমনিতেও যথেষ্ট উপভোগ্য। এই দানব কিন্তু বনে থাকে না, থাকে আমাদের মনে। লোভের বশবর্তী হয়ে এই আমরাই পরিণত হই দানবে। সেসময় গৌরব করার মতো আমাদেরও কিছু থাকে না। ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো খুঁজে পাওয়ার জন্য ঘুরে আসতে পারেন ইকাবগের পাতায় পাতায়।
বই: দি ইকাবগ
লেখক: জে. কে. রোলিং
অনুবাদক: সালেহ আহমেদ মুবিন
ধরন: রূপকথা
প্রকাশক: অঙ্কুর প্রকাশনী