আব্বাস কিয়ারোস্তামির‘ফাইভ’ আর আন্দ্রে তারকোভস্কির‘দ্য মিরর’ যদি দেখে থাকেন তবে জোনাকির ভিজুয়্যাল ট্রিটমেন্ট বুঝতে তেমন দুঃসাধ্য মনে হবার কথা না। বরং ফাইভের স্থির ক্যামেরা দেখে যেমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতে হয় আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের জোনাকিতেও ঠিক তা-ই হয়। কদাচিৎ এর ক্যামেরা মুভমেন্ট। যেন স্মৃতিতেও বয়সের ভারে স্থিরতা হানা দিয়েছে। ‘দ্য মিরর’-এর মতো জোনাকিও নস্টালজিয়ার গল্প বলে। তবে সেই গল্প বলায় নির্মাতা যে ন্যারেটিভ স্টাইল বাছাই করেছেন, তা ছবিটিকে নিঃসন্দেহে বিশ্ব সিনেমায় স্বকীয়তার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য।
জোনাকি খুব অনায়াস আস্বাদনের চলচ্চিত্র নয়; এর স্বাদ আহরণের জন্য দর্শককে একটু যত্ন সহকারে চলচ্চিত্রটি দেখতে হবে। কী গভীর ভাষা এ ফিল্মের! যেন একাত্ম না হয়ে পড়তে যাওয়াটাই বৃথা। আর একাত্মতা আনয়নে নির্মাতার একাগ্র প্রচেষ্টা যে পুরো ফিল্মে দৃশ্যমান তা বলাই বাহুল্য।
২০১৮ সালের এ ছবিতে আদিত্য একজন বৃদ্ধাকে আশ্রয় করে তার ভিজুয়্যাল পোয়েট্রি সেলুলয়েডে বলতে চেয়েছেন, যিনি কোমায় থেকে জীবনের ফেলে আসা সময়ের স্মৃতিচারণ করছেন। তার প্রেমময় দিনের রোমান্টিক মুহূর্ত, বিচ্ছেদ, জোরপূর্বক নিজের অমতে অন্য কারো সাথে বিয়ে… ইত্যাদি। স্মৃতিতে ভেসে আসা সেসব ভাবনার দৃশ্যায়ন দেখিয়েছেন পরিচালক। আর সেজন্য ব্যবহার করেছেন পরাবাস্তব উপমা। অলংকারিক ছোঁয়ায় একেকটি ফ্রেম যেন একেকটি জ্যান্ত ছবি হয়ে উঠছে। সেই ছবিকে আরও জ্যান্ত করে তুলেছে আলেক্সান্ডার জেকির সুর-মূর্ছনা। পুরো ছবি জুড়ে তার সুরে মেলে স্মৃতি হাতড়ানোর ব্যকুলতা, যাতে নস্টালজিয়ার অতলে হারাতে হয় বার বার। বিশেষ করে প্রথম আবহের বেলায় যে সুরঝংকার শোনায় তাতে জোনাকির সাথে একাত্ম হবার বেশ খানিকটা রসদ পাওয়া হয়ে যায়। সত্যি বলতে, এমন একটি ফিল্মের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে দর্শককে বিশেষভাবে তৈরি করে নেয়ার আসলেই খুব দরকার ছিল।
প্রস্তুতিপর্বের এই দুর্দান্ত ভাব বজায় থেকেছে সমগ্র সিনেমায়। এবং তা বিস্তৃত হয়েছে অন্যান্য সকল ডিপার্টমেন্টেও। স্ক্রিপ্ট, অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি, এডিটিং, আর্ট ডিরেকশন, মেকাপ-কস্টিউম, এবং সর্বোপরি প্রোডাকশন ডিজাইন। সবক্ষেত্রেই দারুণ যত্নের ছাপ। এ যেন চিত্রভাষাকে শিল্পে রূপ দেয়ার প্রাণান্তকর সমন্বিত প্রয়াস। আদিত্য এবং মাহেন্দ্র শেঠী দুজন ভাগ করে নিয়েছেন চিত্রগ্রহণের গুরুদায়িত্ব। ফিল্মটি দেখার পর সে দায়িত্বে তাদের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন করার দুঃসাহস কার! যার কিনা প্রতিটি ফ্রেমই মেটাফোর হিসেবে ধরা দিতে চায়। লংটেকের এসব শট দেখতে কী ভীষণ চমৎকার!
জোনাকির নস্টালজিয়াতে তার অতীত উঠে আসে। সে অতীতে আমরা অন্যান্য চরিত্রকে তাদের নিজেদের যথাযথ বয়সে দেখতে পেলেও বৃদ্ধা জোনাকির বয়স যেন ধ্রুব। চিত্রনাট্যে আদিত্য টাইমফ্রেমে সবাইকে বাঁধলেও একইভাবে জোনাকিকে হয়ত বাঁধতে চাননি। এজন্যে, এই ট্রিটমেন্টটি লেগেছে সত্যিকার অর্থেই অভিনব। করিডোরে কিশোরী যখন ট্যানজেরিন (ছোট কমলালেবু) কুড়োয়, সেই শটে দু’পাশের উন্মুক্ত দরজা থেকে ট্যানজেরিন ছুড়ে দেয়া হচ্ছে করিডোরের হেঁটে যাওয়ার পথে! টেকটির সাথে মিল রেখে হাসপাতালে অনুরূপ আরেক করিডোরে নার্সরা ক্রমানুসারে একে একে প্রান্তবদল করছেন চিকিৎসা সেবা দিতে। যেখানে কোমায় শয্যাশায়ী হয়ে আছেন বৃদ্ধা জোনাকি। নস্টালজিয়ায় ভাসছে সেদিনের কথা যেদিন প্রেমিক তাকে সযত্নে ট্যানজেরিন খাইয়ে দিয়েছিল। জরাজীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা শ্যাডোগ্রাফির সেই প্রেমিককে অবশ্য সে হারিয়েছে পরে। সেই হারানোর দৃশ্য বোধগম্যতা পায় থিয়েটার হলে। যে হলে বাবার সাথে ছবি দেখতে গিয়ে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। সাদা শার্ট, খাকি প্যান্ট আর সাথে সাসপেন্ডার বেল্ট পরা ঐ প্রেমিকের সাথে হয় দৃষ্টিবিনিময়। সেই একই পোশাকে প্রেমিক ফিরে আসে জোনাকির অন্তিমে। প্রেমের নিদর্শনস্বরূপ সাথে করে নিয়ে আসে প্রেমিকার জন্য ব্যাগভর্তি ট্যানজেরিন। এমন সব বাহারী অলংকরণে মশারির ভেতর-বাহিরে আবদ্ধ নিগূঢ় চিত্রনাট্যের জন্য হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা।
ক্ষয়িষ্ণু পুরাতন দেয়াল, শূন্য বাথটাব, পুরনো বাড়ির মরচে পড়া জিনিসপত্র কিংবা ধুলো জমে থাকা তালা! জোনাকির শিল্প নির্দেশনা এবং প্রোডাকশন ডিজাইন যেন এরূপেই এর শৈল্পিকতায় যথার্থতার প্রমাণ দেয়। বেশ সময় নিয়ে করা সচেতন সব আয়োজন। দুই মেরুর দুই বাসিন্দা হিসেবে এক বাড়িতে থেকেও সম্পর্কের বাঁধনে জড়াতে না পারায় স্বামীর সাথে সম্পর্ক ছেদের সেই দৃশ্য ভুলবার নয়। এ দৃশ্যটি চিত্রায়ন করতে জোনাকির মুখ কেকের ভিতরে গুঁজে দিয়ে যেন শূন্যে মিলিয়ে গেলেন তার সে অনাকাঙ্ক্ষিত স্বামী। যা আদিত্যের চিত্রসম্পাদনাকে সহায়ক শক্তি হিসেবে আরও অর্থবহ করে তোলে! বৈপরীত্যে, প্রেমিকের সাথে মিলনের সিকুয়েন্সের শৈল্পিকতা যেন পূর্বের দেখানো সব রূপককে ছাড়িয়ে যেতে চায়। সে দৃশ্যে যুদ্ধরত সোলজারদের যুদ্ধ শেষে গর্ভে আসে প্রণয়ের ফসল। চিত্রশিল্পী আদিত্য যে পরাবাস্তবতা বা স্যুররিয়ালিজমকে তার কর্মে গভীরভাবে করতে ধারণ পেরেছেন- এ দৃশ্য দেখার পর সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
কোমায় শয্যাশায়ী বৃদ্ধা জোনাকির ভূমিকায় ললিতা চ্যাটার্জি কেমন পারফর্ম করলেন তা পরিমাপ করা কার সাধ্যি? শুধু এতটুকু বলা যায়- এমন চরিত্রে অভিনয় করতে পারাটাই যেকোনো শিল্পীর জন্য সৌভাগ্য। আর এমন সৌভাগ্যবান শিল্পী হতে পেরে তার মুখিয়ে থাকা শিল্পসত্তাকে উদাত্ত আহবানে জাগিয়েছেন তিনি। বয়োজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধা তার প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, ও দক্ষতার সমন্বয়ে জোনাকির আবেগ অনুভূতি নস্টালজিয়াকে আদিত্যের দেয়া নিথর দেহে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন। নাম ভূমিকায় তার অনবদ্য অভিনয় ছাপিয়ে গেছে বয়সের সব ব্যারিকেড।
জোনাকি এ চলচ্চিত্রে আবির্ভূত হয়েছে নানা রূপে, নানা প্রতীকি ভঙ্গিমায়। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা বাচ্চাদের চোখের মধ্য দিয়ে যেমন জোনাকি উড়ে বেড়িয়েছে, তেমনি জোনাকির আলো দেখা গেছে শেষ শটের ফেইড আউটেও। কখনো আবার ন্যারেটিভ স্টাইলও হয়ে উঠতে চেয়েছে জোনাকির প্রতিভূ।
আদিত্যের ভাষায় বলতে হয়, “A firefly will light up here, go off, and then you don’t know where it will light up again. It’s like a signal going through different parts of the brain and lighting up a different memory”. সত্যিই, বিস্ময়ে ঘোর লাগানো অন্তিমের স্মৃতিকাতরতার এ ফিল্ম স্মৃতিতে অমলিন থাকবে অনেকটা দিন।