কী বার্তা দেয় ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’?

– মাম্মা!
– হ্যাঁ বাবা।
– দীপ্তি ম্যাম না আমাকে অনেক বকেছে। তারপর ক্লাসের এক কোণায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
– কেন?
– কারণ আমি আঁকার ক্লাসে আকাশের রঙ গোলাপি দিয়েছিলাম। মাম্মা, আকাশের রঙ কি গোলাপি হয় না?
– দীপ্তি ম্যাম একদম ভুল! তোমার আকাশের রঙ তুমি সেটাই দিতে পারো, যেটা তুমি দিতে চাও।
– আমার সব বন্ধুরাও আমাকে বুদ্ধু বলেছে। ওরা বলেছে আকাশের রঙ নাকি নীল হয়।
– এখন কান্না বন্ধ করে মাম্মার কথা শোনো, ঠিক আছে?
– দীপ্তি ম্যাম…
– কোনো দরকার নেই অন্য কারো কথায় তোমার আকাশের রঙ পাল্টানোর। কখনোই না। ঠিক আছে? সবার একটা করে নিজের আকাশ থাকে। বুঝেছ? আমার কাছে আমার আকাশের রঙ যেটা মনে হয়েছে, আমি সেটাই দিয়েছি। তোমার যদি মনে হয় তোমার আকাশের রঙ গোলাপি হবে, তাহলে তোমার আকাশ গোলাপিই হবে। ব্যস!

ঠু২০১৯ সালে বলিউডের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ছিল ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’; Image Source: Hollywood Reporter

২০১৯ সালে যতগুলো ছবি দেখেছি, তার মধ্যে ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’ সবসময়ই মনের মাঝে একটি বিশেষ জায়গা দখল করে থাকবে। তারচেয়েও বেশি করে স্মরণে থাকবে উপরোল্লিখিত এই দৃশ্যটি।

এমন একটি মেয়েকে কেন্দ্র করে ছবিটি, যে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, এবং ছবির শুরুতেই বলে দেওয়া হচ্ছে, মেয়েটি একসময় মারা যাবে। অর্থাৎ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টানটান, শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার কোনো ব্যাপার নেই ছবিটিতে। দর্শক শুরু থেকেই জানে, মেয়েটি মারা যাবে। তার মানে, মেয়েটি শেষ পর্যন্ত বাঁচল কি মারা গেল, সেটি কখনোই এই ছবির মুখ্য বিষয় নয়।

দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত আয়েশাকে কেন্দ্র করে ছবির কাহিনী; Image Source: RSVP Movies

তাহলে ছবিটির মুখ্য বিষয় কী? কেনইবা ছবিটির নাম ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’? সেসব ব্যাখ্যা নিহিত আছে উপরের এই একটি দৃশ্যের মাঝেই। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ভারতের বক্স অফিসে ছবিটি তো মুখ থুবড়ে পড়েছেই, এমনকি নেটফ্লিক্সের কল্যাণে ছবিটি বিশাল সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছে গেলেও, এবং ভবিষ্যতে ছবিটির একটি কাল্ট ক্ল্যাসিকে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, এখন পর্যন্ত খুব কম দর্শকই ছবিটির মূল বক্তব্যটা ধরতে সক্ষম হয়েছে।

বেশিরভাগ মানুষের কাছে ছবিটি কেবলই একটি মেয়ের মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া, এবং তার পরিবার, বিশেষত তার মায়ের, তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার, কিংবা তার মৃত্যুর আগমনের কালকে প্রলম্বিত করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার কাহিনী। কিন্তু আসলে কি তা-ই? মোটেই না। এই ছবির মূলবক্তব্য আরো অনেক গভীর, আরো অনেক ব্যাপক।

খেয়াল করলে দেখবেন, মেয়েটির মা যতটা না চেয়েছে তার মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখতে, তারচেয়েও বেশি করে চেয়েছে যে ক’টা দিন মেয়েটি বেঁচে আছে, সেই সীমিত দিনগুলো যেন অন্তত মেয়েটির জন্য আনন্দময় হয়। এবং একই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মেয়েটির নিজেরও। তাই সে-ও চেয়েছে, মৃত্যু অবধারিত জেনেও জীবনকে সর্বোচ্চভাবে উপভোগ করতে। সে চেয়েছে অন্যান্য টিনেজ মেয়েদের মতো সে-ও একটা সাধারণ স্কুলে যাবে, নিজের ক্রাশকে প্রেমিক হিসেবে পাবে, এবং আর সবকিছুই করবে, যা তার বয়সী মেয়েরা করে থাকে।

ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় ছিল প্রিয়াঙ্কার, যথাযথ সমর্থন যুগিয়েছেন ফারহানও; Image Source: Hindustan Times

অর্থাৎ ঘুরেফিরে নিজের আকাশকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী রঙ করার বিষয়টিই চলে আসে। মেয়েটি চাইলে মৃত্যু অত্যাসন্ন জেনে সবসময় বিষণ্ণ হয়ে থাকতে পারত, নিজেকে সবার সামনে দুঃখী প্রমাণ করে সহানুভূতি আদায় করে নিতে পারত, এবং যে ক’টা দিন সে পৃথিবীতে ছিল, ওই দিনগুলোও সে তার নিজের ও পরিবারের সবার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারত। কিন্তু মেয়েটি তা করেনি। সে-ও তার মায়ের মতোই জানত, নিজের আকাশের সে রঙই হবে, যে রঙটি সে ব্যবহার করবে। ফলে একা একা গুমরে মরে নয়, ১৮ বছরের জীবনকে সে পুরোপুরি উপভোগ করে যেতে চেয়েছে। তার মা-ও তাকে সেক্ষেত্রে সবধরনের সহযোগিতা করে গিয়েছে।

তবে মেয়েটির চেয়েও এই ছবিতে বড় ভূমিকা ছিল তার মায়ের। এবং তার দিক থেকেও বারবার একই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটেছে। মেয়েটির বাবা যেখানে বাস্তবতা থেকে বরাবরই পালিয়ে যেতে চেয়েছে, নিজের প্রথম মৃত মেয়ের কথা কখনো মনে করেনি, এবং দ্বিতীয় মেয়েটি মারা যাওয়ার পর তার স্মৃতিও ভুলে যেতে চেয়েছে, সেখানে মেয়েটির মা একদম ভিন্ন কাজ করেছে। সে শুরু থেকেই নিজের জীবনের সোনালি সময়গুলো অসুস্থ মেয়ের পেছনে ঢেলে তো দিয়েছেই, সেই সাথে মেয়ের জীবনের সকল প্রত্যাশা, সকল স্বপ্নকে পূরণ করার চেষ্টাও করে গেছে। এমনকি মেয়ে যাতে তার প্রেমিককে চুমু খেতে পারে এবং চাইলে আরো বেশি কিছুও করতে পারে, তা নিশ্চিত করতেও তাকে বিভিন্ন ‘ষড়যন্ত্র’ করতে দেখা গেছে!

এই ছোট ছোট বিষয়গুলোর মাঝেই আসলে গোটা ছবির কাহিনী ও নামকরণের সার্থকতা নিহিত। পরিচালক সোনালী বোস চাননি এমন কোনো ছবি নির্মাণ করতে, যা দেখে ঠুনকো আবেগে দর্শকের নাকের জলে চোখের জলে এক হবে। খেয়াল করে দেখবেন, এ ছবিতে দুঃখের মুহূর্তগুলোতে কোনো নেপথ্য সঙ্গীতও ব্যবহৃত হয়নি। তারপরও যে দর্শক কেঁদেছে, কারণ পর্দায় যা দেখানো হয়েছে তা ছিল পুরোই ‘র ইমোশন’, আর্টিফিশিয়াল কিছু নয়। অর্থাৎ পরিচালকের ইচ্ছা ছিল, দর্শক নিজে থেকেই কাহিনীটি অনুভব করুক, এবং বাস্তবে হয়েছেও তা-ই। 

বাস্তবের আয়েশা চৌধুরী; Image Source: INKTalks

সোনালী বোস চেয়েছেন দর্শককে এই বার্তা দিতে যে, নিজের জীবনকে যেন কেউ অন্যের বানানো নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনা করার চেষ্টা না করে। নিজের জীবনটা যেন নিজের পছন্দ-অপছন্দ মেনেই চালানো হয়, এমনকি আপনার জীবনের মেয়াদ আপনার নিজের কাছে জানা থাকলেও। এবং কেন তিনি এই বার্তা দিতে চেয়েছেন, তার কারণও খুবই পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট। আয়েশা চৌধুরী নামের যে মেয়েটির জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে তিনি ছবিটি নির্মাণ করেছেন, সে মেয়েটির জীবনাদর্শও হুবহু এমনই ছিল, যার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন মঞ্চে তার বলা বক্তৃতাগুলো, কিংবা মৃত্যুর আগে তার লিখে যাওয়া বইটি থেকে।

মৃত্যু নিয়ে অনেক ছবিই দেখেছি এখন পর্যন্ত। কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে ঠিক এই ধরনের ‘টেক’ অন্তত বলিউডে আগে কোনো পরিচালককে নিতে দেখা যায়নি। মৃত্যুকেন্দ্রিক প্রায় সকল ছবিতেই তারা চেষ্টা করেছেন মৃত্যুকে অতিমাত্রায় মহিমান্বিত করতে, এমনভাবে কাহিনী বিন্যাস করতে যেন ছবির শেষ দৃশ্যে কান্নার রোল ওঠে, চোখ মুছতে মুছতে দর্শককে হল ছেড়ে বের হতে হয়। ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’ হলো সেই ছবি, যেখানে কাহিনীর দৃশ্যমান মূল উপাদান মৃত্যু হলেও, অদৃশ্যমান শক্তিটির নাম হলো জীবন।

জীবনের জয়গান গাওয়া ছবিই হলো ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’।

ছবির পরিচালক সোনালী বোস; Image Source: The Times of India

শেষ করার আগে একটি ছোট্ট ট্রিভিয়া: পরিচালক সোনালী বোসের কাছে ছবিটি অনেক বেশি ব্যক্তিগত আবেগ সমৃদ্ধ, কারণ তিনি নিজেও তার ছেলেকে হারিয়েছেন। এবং সেই থেকে তিনি চেষ্টা করে এসেছেন নিজের ছবিগুলোতে জীবনের মাহাত্ম্যকে ফুটিয়ে তুলতে। একই প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গিয়েছিল তার আগের ছবি ‘মারগারিটা উইথ আ স্ট্র’-তেও। এছাড়া মা-সন্তানের সম্পর্ক নিয়ে তার আরেকটি ছবি হলো ‘আমু’।

This is a bangla article. It is a review on the film 'The Sky is Pink'. This article describes the beneath philosophy and ideology.

All necessary sources have been hyperlinked inside the article.

Featured Image: India Today

Related Articles

Exit mobile version