প্রখ্যাত জাপানী থ্রিলার সাহিত্যিক কিয়েগো হিগাশিনো রচিত ‘দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স’ অনবদ্য একটি থ্রিলার গ্রন্থের নাম। বইটিতে লেখক থ্রিল, সাসপেন্স আর রহস্যের সাথে অত্যন্ত সচেতনতার যুক্ত করেছেন গভীর জীবনবোধকে। জীবনে বেঁচে থাকতে কোন জিনিসটি অনুপ্রেরণা যোগায়, কোন বিষয়টি কাউকে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার যোগ্য করে, তা নিয়ে প্রশ্ন করে পাঠককে লেখক মানুষের জটিল মনঃস্তত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছেন।
‘দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স’ এর কাহিনীর শুরু হয় খুবই সাদামাটাভাবে। হাইস্কুলের গণিতের শিক্ষক ইশিগামি এবং তার প্রতিবেশি ইয়োসুকো হানাওকার বৈচিত্র্যহীন জীবনের আরেকটি দিন শুরুর বর্ণনা দিয়ে। দৃশ্যপটে ইয়েসুকোর অত্যাচারী প্রাক্তন স্বামী টোগাশির আবির্ভাবে দ্রুতই গল্পে গতি আসতে শুরু করে। টোগাশি আবারও এসে বাগড়া দিতে শুরু করল মেয়েকে নিয়ে ইয়েসুকোর শান্তিপূর্ণ জীবনে। হুমকি দিল টোগাশি, টাকা না দিলে কিছুতেই মা-মেয়েকে ছাড়বে না সে। টোগাশির এই বাড়াবাড়ি সহ্য করতে পারল না তারা। ফলে অবস্থা আরো খারাপের দিকে মোড় নিল। রেগে আক্রমণ করতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই তারা খুন করে ফেলল টোগাশিকে। এখন কী হবে? কী করবে তারা?
ইয়েসুকোকে ভালো লাগে তার পাশের বাসার গণিতের শিক্ষক এবং জীবনের গভীর পর্যবেক্ষক ইশিগামির। গণিতের শিক্ষকতা করে অতিবাহিত হওয়া তার ছন্নছাড়া জীবন যেন একটু রঙিন হয়ে উঠেছিল ইয়েসুকোর সাথে পরিচয়ের ফলে। ইয়েসুকোর বাসা থেকে আসা আওয়াজ থেকে হানওকাদের খুনের ঘটনাটা জেনে যায় ইশিগামি। মা ও মেয়ের প্রতি গভীর মমতা থেকে সে তাদেরকে উদ্ধার করতে আসে। লাশ নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে ডিটেক্টিভ কুসানাগী পৌছে গেলেন ইয়েসুকোর কাছে। ইয়েসুকো যে অ্যালিবাই পেশ করল তা একেবারে নিখুঁত, তারপরও সন্তষ্ট হতে পারলেন না কুসানাগী। কোথায় যেন একটা ছিদ্র আছে তার গল্পে। তিনি সাহায্য চেয়ে বসলেন তার বন্ধু ‘ডিটেক্টিভ গ্যালিলিও’ নামে পরিচিত পদার্থবিজ্ঞানের এক অধ্যাপকের কাছে, যিনি পুলিশকে আগেও অনেক কেস সমাধানে সাহায্য করেছেন। তিনি কেসটি নিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝতে পারলেন, অতি বুদ্ধিমান এক খুনীর মুখোমুখি হয়েছেন তারা।
একদিকে ইশিগামি চেষ্টা করছে ইয়েসুকোকে বাঁচাতে, আর ইউকাওয়া চাচ্ছে কেসটি সমাধান করতে। সব মিলিয়ে গল্পটি উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে রুপ নেয়। কে জেতে এই যুদ্ধে? ইউকাওয়া নাকি ইশিগামি? একদিকে ‘বুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত ইশিগামী, অন্যদিকে ‘ডিটেক্টিভ গ্যালিলিও’- বইটিতে লেখক মুখোমুখি করেছেন ইম্পেরিয়েল ইউনিভার্সিটির সেরা দুই প্রতিভাকে।
ইশিগামী ও ইউকাওয়ার একে অপরকে পর্যবেক্ষণের ঘটনাকে বলা যায় একটি জটিল সমীকরণ, যার ফলাফল হচ্ছে গল্পের নাটকীয় এবং ট্র্যাজিক পরিসমাপ্তি।
গল্পের ইশিগামি চরিত্রটি বিরল একজন গণিত প্রতিভা। তার মতো কারো পক্ষে সামান্য একটি প্রাইভেট হাই স্কুলে গণিত শেখানো অস্বাভাবিক বৈকি। গণিতে অমনোযোগী শিক্ষার্থীদের পড়াতে তেমন ভালো না লাগলেও, জীবনের কাছে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই তার। সে তার ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে মজা পায় এবং এটি করেই জীবন শেষ করতে চায়। সেটা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেওয়ার ধরনের কোনো উদ্দেশ্য থেকে নয়, বরং নিজের বেঁচে থাকার স্বার্থকতা, ভালো থাকা- এই কারণগুলোর জন্যই সে এটি করে।
গণিত অপছন্দ করা শিক্ষার্থীদের সে নানাভাবে গণিতের প্রয়োজনীয়তা বোঝায়, যা পড়ে আপনিও বুঝতে পারবেন গণিত কী এবং কেন দরকার। বেশকিছু উচ্চ পর্যায়ের জটিল গাণিতিক সমস্যা নিয়েও আলোচনা রয়েছে বইটিতে। গল্পটি পড়ে ইশিগামি চরিত্রটিকে আপনি ভালবাসবেন। তার প্রতি ভালবাসা থেকে যদি গণিতের প্রতিও একটুখানি ভালবাসা জন্ম নেয়, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারো কারো গণিত ভীতি, গণিত প্রীতিতে রুপান্তরিত হওলেও বিচিত্র কিছু হবে না।
ইয়েসুকো চরিত্রটি ইশিগামির তুলনায় একেবারেই সাধারণ। মেয়ের কথা ভেবে নাইটক্লাবের কাজ ছেড়ে দিয়ে সে একটু সম্মানিত জীবনের আশায় একটি ফুডশপে কাজ শুরু করে। নাইটক্লাবে তো কেউ আর সাধে কাজ করতে যায় না। এই শ্রেণীর নারীদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই নেতিবাচক হয়। লেখক সেই তুলনায় নাইটক্লাবের একজন হিসেবে ইয়েসুকোকে যথেষ্ট সম্মানের সাথে উপস্থাপন করেছেন। ডিটেক্টিভ গ্যালিলিও অসাধারণ বুদ্ধিমান আর যুক্তিবাদী একজন মানুষ, ঠিক তার বন্ধু ইশিগামির মতোই।
লেখক বইটিতে জীবনদর্শনেরও স্বার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। ইশিগামী বিশ্বাস করে, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে যেকোনো সমস্যা থেকে উৎরে যাওয়া সম্ভব। ইউকাওয়া বলে, এটা শুধু গণিতের ক্ষেত্রে সত্য, জীবনের ক্ষেত্রে নয়। বন্ধুর প্রতি তার মেসেজ থাকে, যুক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করলেও জীবনে আবেগ আর ভাগ্য নামের আরও কিছু ব্যাপার আছে, যেগুলোকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাই হয়তো ইশিগামির মতো অপরিমেয় বুদ্ধিমত্তার অধিকারী কেউও দিনশেষে সফল হতে পারে না। বই শেষ করে বইটির নামকরণের স্বার্থকতাও বুঝতে পারবেন আপনি। ‘দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স’ কিয়েগো হিগাশিনোর ডিটেক্টিভ গ্যালিলিও সিরিজের তৃতীয় বই। আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার এই বইটি প্রকাশের পর সে বছরই শুধু হিগাশিনোর নিজের দেশ জাপানেই বইটির বিক্রি মিলিয়ন কপি ছাড়িয়ে যায়।
আর দশটা থ্রিলারের তুলনায় ‘দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স’ একেবারেই আলাদা। গতানুগতিক হাই-টেনশন কোনো থ্রিলারের মতো গোলাগুলি, বন্দুকযুদ্ধ এতে নেই। সাত মহাদেশ বিস্তৃত পটভূমিও নেই। বইটির পটভূমি আবর্তিত জাপানের ছোট্ট একটি শহরকে কেন্দ্র করে। বইটি পড়ার পর বোঝা যায়, এটি শুধু একটি থ্রিলার গল্পই নয়, একটি প্রেমের গল্পও। যারা বলেন, থ্রিলার গল্পে গভীরতা থাকে না, তাদের জন্য একটি শক্ত জবাবও বইটি।
‘দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স’ সম্পর্কে গণমাধ্যমের রিভিউ একটু জানা যাক।
“চমৎকার একটি ব্রেইন-নট মিস্ট্রি। আমার পড়া সবচেয়ে অসাধারণ আর বুদ্ধিদীপ্ত পরিসমাপ্তি।”
– লস এঞ্জেলেস টাইমস“দুর্দান্ত একটি মার্ডার মিস্ট্রি ভাবলে ভুল করবেন পাঠক। নতুন করে ভাবতে শেখাবে অনেককিছু।”
– লাইব্রেরি জার্নাল”“এই উপন্যাসের প্লট একেবারেই অনন্য।”
– নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ“সূক্ষ্ম, কৌতুহলোদ্দীপক আর টেনশনে ভরপুর যার শেষটা আপনাকে চমকে দেবে।”
– বোস্টন গ্লোব
বইটির লেখক কিয়েগো হিগাশিনো জাপানের ওসাকাতে জন্মগ্রহণ করেন। ওসাকার প্রিফেকচার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি সমাপ্ত করার পর যোগ দেন জাপানের নিপ্পন ডেনসো কর্পোরেশনে।
১৯৮৫ সালে সেখানে কাজ করার সময়ই লিখে ফেলেন তার প্রথম উপন্যাস ‘আফটার স্কুল’, লাভ করেন থ্রিলার সাহিত্যের জন্য দেওয়া ‘এডগাওয়া র্যাম্পো ‘এওয়ার্ড। তারপর চাকরি ছেড়ে পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে তার উপন্যাস ‘নাওকো’র জন্য পেয়ে যান ‘মিস্ট্রি রাইটার্স অব জাপান’ এওয়ার্ড। এরপর ২০০৬ সালে ‘দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স’ বইটির জন্য পান নাওকি প্রাইজ, যা জাপানে ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড বা ম্যান বুকার প্রাইজের সমতুল্য। ২০০৬ সালে ‘বেস্ট জাপানিজ ক্রাইম ফিকশন অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার জেতেন। ‘দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স’ অবলম্বনে ‘সাসপেক্ট এক্স’ নামে জাপানে চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়েছে।
বইটির মতোই চলচিত্রটিও জাপান জুড়ে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে, যা এডগার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পায়। কিয়েগো হিগাশিনোর অন্যান্য থ্রিলার উপন্যাসের মধ্য রয়েছে ‘ম্যালিস’, ‘স্যালভেশন অব দ্য সেইন্ট’, ‘জার্নি আন্ডার দ্য মিডনাইট সান’ প্রভৃতি। তার বেশকিছু ছোটগল্প সংকলনও রয়েছে। ‘দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স’ এর বাংলা অনুবাদও রয়েছে। সালমান হকের অনুদিত বইটি নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে।
বইয়ের নাম: দ্য ডিভেশন অব সাসপেক্ট এক্স
লেখক: কিয়েগো হিগাশিনো
প্রথম প্রকাশ: ২০০৬
গুডরিডস রেটিং: ৪.১