১৯৯৩ সাল। গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে শিক্ষার্থীরা তখন হগওয়ার্টস এক্সপ্রেসে চড়ে হগওয়ার্টসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। হ্যারি, রন, হারমায়োনি একই কামড়ায় বসে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। সিরিয়াস ব্ল্যাক মৃত্যুপুরী আজকাবান ছেড়ে পালিয়েছে। তাদের পাশেই হগওয়ার্টসের কোনো এক স্টাফ চাদর মুড়িয়ে শুয়ে আছে। লোকটি কে, কোথা থেকে এসেছে- এ নিয়ে তিনজনের কেউই মাথা ঘামালো না।
আলোচনার এক মূহুর্তে হঠাৎই ঝিক ঝিক করে চলা ট্রেনের চাকা থেমে গেলো। মুহূর্তেই চারপাশ আঁধারে ঢেকে গেলো, প্রচণ্ড শীতলতা গ্রাস করল পুরো ট্রেনকে। জানালার কাঁচগুলো পরিণত হলো স্বচ্ছ বরফে। বাইরে থেকে জানালা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলো কয়েকটা উড়ন্ত পিশাচ, উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডে যারা ডিমেন্টর নামে পরিচিত। একটা ডিমেন্টর হ্যারিকে দেখেই তার ভেতর থেকে সব যেন শুষে নিতে লাগল। হঠাৎ পাশে শুয়ে থাকা সে লোকটা জেগে উঠে নিজের জাদু ছড়ি বের করে ধরল। উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় দূর হয়ে গেলো সে ডিমেন্টর, হ্যারি প্রাণে রক্ষা পেল। জ্ঞান ফিরে পাবার পর লোকটি হ্যারিকে চকলেট খেতে দিয়েছিল। লোকটি আর কেউ নন, আমাদের পরিচিত ডাকিনীবিদ্যা প্রতিরোধ বিষয়ক শিক্ষক রেমাস লুপিন।
বংশ পরিচয়
রেমাসের বাবা লায়াল লুপিন ১৯২৯ সালের কিছু সময় আগে এক ব্রিটিশ পিউর-ব্লাড বা হাফ-ব্লাড পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি Non-Human Spiritous Apparition বিশেষজ্ঞ হিসেবে জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন। জাদু জগতের প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বে তিনি ব্রিটিশ জাদু মন্ত্রণালয় থেকে ডাক পান। মন্ত্রণালয় তাকে ‘ডিপার্টমেন্ট ফর দ্য রেগুলেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অভ ম্যাজিক্যাল ক্রিয়েচার’ বিভাগে নিযুক্ত করে দেন। অপরদিকে রেমাসের মা হোপ ওয়েল ছিলেন একজন ওয়েলশ মাগল। সে হিসেবে রেমাস লুপিন একজন হাফ-ব্লাড।
১৯৫৮ সালে মন্ত্রণালয় লায়ালকে ওয়েলসের এক জঙ্গলে বোগার্ট খুঁজতে পাঠায়। তখন অদূরে তিনি এক নারীর চিৎকার শুনতে পান। দৌড়ে গিয়ে সেখানে দেখেন, ওই বোগার্ট এক নারীর সামনে হিংস্র রূপ ধারণ করে ভয় দেখাচ্ছে। সাথে সাথে নিজের জাদু ছড়ি ঘুরিয়ে সেটাকে মাশরুমে পরিণত করলেন লায়াল লুপিন। এই নারীর নাম হোপ ওয়েল, যিনি কার্ডিফের এক বীমা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। লায়াল হোপের ভয় ভাঙানোর জন্য অনেক বুঝিয়েছেন, এটা শুধু মাত্র একটা বোগার্ট। ভয়ের কিছু নেই। তবুও ভয় না কাটায়, হোপকে সহিহ্-সালামতে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসলেন লায়াল। একসময় তারা একে অপরের ভালোবাসার মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যান। ১৯৫৯ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। তাদের বিয়ের কেকটাও তৈরি করা হয়েছিল ওই বোগার্টের আদলেই। তাদের গভীর প্রণয়ের ফল হিসেবে ১৯৬০ সালের ১০ মার্চ পৃথিবীর আলো দেখে রেমাস জন লুপিন।
ফেনরির গ্রেব্যাকের প্রতিশোধ
মানুষের ছদ্মবেশে রেমাস লুপিন যে একজন ওয়্যারওল্ফ, তা উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডের ভক্তদের জানা। সিরিজের তৃতীয় কিস্তি ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অভ আজকাবান’-এ সেটা খোলাসা করা হয়েছে। ভর পূর্ণিমার রাতে তিনি হ্যারি, রন, এবং হারমায়োনিকে একপ্রকার মেরেই ফেলেছিলেন। কিন্তু কপালজোরে এই ত্রয়ী সেভেরাস স্নেইপ ও সিরিয়াস ব্ল্যাকের কল্যাণে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে যায়।
কিন্তু রেমাস লুপিনের এই ওয়্যারওল্ফে পরিণত হবার কাহিনীটা অনেকেরই অজানা। লুপিনের বয়স তখনো পাঁচ এর ঘর ছোঁয়নি। প্রতি রাতের মতোই সে শান্তিতে বিছানায় ঘুমে বিভোর ছিল। লায়াল লুপিনের উপর প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে হঠাৎই ফেনরির গ্রেব্যাক নামে এক ওয়্যারওল্ফ ঘরের জানালা খুলে পিচ্চি লুপিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লুপিনের শরীরের কয়েক জায়গায় গ্রেব্যাক তার কামড়ও বসায়। লুপিনের বাবা জাদুকর লায়াল লুপিন তড়িঘড়ি করে ছেলের শয়নকক্ষে ঢুকে, গ্রেব্যাককে তাড়াতে অনেকগুলো শক্তিশালী কার্স ব্যবহার করে। গ্রেব্যাক তখন পালাতে বাধ্য হয় ঠিকই, কিন্তু রেমাসকে সে ক্ষতচিহ্ন আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়েছিল। যেহেতু গ্রেব্যাক নিজেই ওয়্যারওল্ফ, তাই এই বিষাক্ত দংশনে রেমাসও রূপান্তরিত হয় এক ওয়্যারওল্ফে। এই কাহিনীটা নিয়ে রেমাস মুখ খুলেছিল ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য হাফ ব্লাড প্রিন্স’ বইয়ে। মুভিতে যার ছিঁটেফোঁটাও দেখানো হয়নি।
যেভাবে হগওয়ার্টসে পদার্পণ
সাধারণত ব্রিটিশ কোনো জাদুকরের এগারো বছর পূর্ণ হলেই পেঁচা তার জন্য হগওয়ার্টস ভর্তির চিঠি বহন করে নিয়ে যায়। কিন্তু রেমাস লুপিনের বেলায় ঘটনাটা একটু ব্যতিক্রম। তার এই ওয়্যারওল্ফ অবস্থার জন্য ডাম্বলডোর নিজে গিয়ে তাকে হগওয়ার্টস ভর্তির নিমন্ত্রণ দিয়ে আসে। ডাম্বলডোর কখনোই চাইতেন না রেমাস এই সমস্যা নিয়ে বেকায়দায় পড়ুক, হগওয়ার্টসে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি হোক। সেজন্য তিনি রেমাসকে দু’হাত দিয়ে আগলে রাখতেন। এমনকি তিনি শ্রেকিং শ্যাক নামে হগসমিডের পরিত্যক্ত এক বাড়ি দিয়েছিলেন লুপিনকে। যাতে কারও ক্ষতি না করে পূর্ণিমায় সে সেখানে ওয়্যারওল্ফ রূপ ধারণ করতে পারে।
মুনি দ্য মারাউডার
হ্যারি পটার সিরিজের তৃতীয় ফিল্ম প্রিজনার অভ আজকাবানে জর্জ আর ফ্রেড, হ্যারিকে মারাউডার’স ম্যাপ নামে একটা জাদুকরী নকশা উপহার দিয়েছিল। হগওয়ার্টসের ভিতর কে কোথায় অবস্থান করছে, তা সেই ম্যাপের সাহায্যে দেখা যেত। এই ম্যাপ যারা তৈরি করেছিল তাদের ছদ্মনাম হলো যথাক্রমে মুনি, ওর্মটেইল, প্যাডফুট, এবং প্রংস। মুনি ছিল মূলত রেমাস লুপিনের ছদ্মনাম। তবে এই ম্যাপটা কীভাবে তাদের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, সে ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
বিপদে বন্ধুর পরিচয়
মারাউডার’স দলটি গড়ে উঠেছিল মূলত চারজন সদস্য নিয়ে। তারা হলেন হ্যারি পটারের বাবা জেমস পটার, পিটার পেটিগ্রিউ, রেমাস লুপিন, এবং সিরিয়াস ব্ল্যাক। পূর্ণ চন্দ্রিমায় রেমাসকে যখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওয়্যারওলফে পরিণত হতে হতো, তখন বাকি তিনজন বন্ধুও বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধারণ করত। উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডে মানুষ থেকে খানিক সময়ের জন্য পশুতে রূপান্তরিত হবার প্রক্রিয়াকে বলা হয় অ্যানিম্যাগাস।
অ্যানিম্যাগি হওয়াটা এতো সহজ নয়। কোনো জাদুকর অ্যানিম্যাগি হতে চাইলে তাকে প্রথমে ম্যানড্রেক পাতা টানা একমাস মুখের মধ্যে গুঁজে রাখতে হবে। এই পাতা পরবর্তীতে পোশন তৈরিতে বিশেষ কাজে লাগবে। অবশ্য ইচ্ছা করলেই কেউ সেই পোশন বানাতে পারবে না, এজন্য দরকার হবে পোশন সম্পর্কিত স্বচ্ছ জ্ঞান, এবং পোশন বানানোর পরিপূর্ণ দক্ষতা। প্রিয় বন্ধুর জন্য বাকি তিনজন এই কষ্টটুকু বরণ করে নিতে কোনো দ্বিধাবোধ করেনি।
মৃত্যুমুখে সেভেরাস স্নেইপ
স্নেইপ এবং রেমাস, দুজনেই হগওয়ার্টসের আঙিনায় পা রাখে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে। মজার ছলে একবার ভবিষ্যতের তুখোড় পোশন মাস্টার স্নেইপকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দিয়েছিলেন সিরিয়াস ব্ল্যাক। ৫ম বর্ষে থাকাকালীন, স্নেইপের অনুসন্ধানী চোখ হঠাৎ গিয়ে পড়ল রেমাস লুপিনের উপর। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, লুপিন প্রতি পূর্ণিমার রাতে কোথায় যান! সিরিয়াস তখন এমনভাবে এক ফাঁদ পাতলেন, যেটা স্নেইপকে সরাসরি হোম্পিং উইলোতে নিয়ে যায়। সেখানেই লুপিনের মানুষ থেকে ওয়্যারওলফে পরিণত হবার কথা। নেকড়েতে পরিণত হবার পর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায়, স্নেইপের উপর আক্রমণ করে বসতে পারতেন নেকড়ে-বেশী লুপিন। কিন্তু জেমস পটার তা বুঝতে পেরে বাধা দেন সেভেরাসকে। সে যাত্রায় জেমসের কারণে প্রাণে রক্ষা পান সেভেরাস স্নেইপ।
প্রিফেক্ট
রেমাস লুপিন যে হগওয়ার্টসে প্রিফেক্ট ছিল, তা অনেকেরেই হয়তো অজানা। প্রিফেক্ট হলো হগওয়ার্টসের এমন একটি পদ, যে পদে দায়িত্বরত শিক্ষার্থীরা হাউজের প্রধান ও প্রধান শিক্ষককে হাউজ সম্পর্কে সকল হালনাগাদ তথ্য জানাবে, এবং হাউজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেকোনো অনুশাসন প্রয়োগ করবে। পঞ্চম বর্ষে উঠার পর একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রীকে প্রিফেক্ট হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তেমনই রেমাসও পঞ্চম বর্ষে উঠার পর হাউজ গ্রিফিন্ডরের প্রিফেক্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য হ্যারি পটারের পিতা জেমস পটার গ্রিফিন্ডরের হেড বয় হিসেবে নির্বাচিত হন।
যে শর্তে শিক্ষকতায় যোগদান
একজন ওয়্যারওল্ফের শিক্ষকতায় যোগদানের বিষয়টা আদতে কোনো ইতিবাচক যুক্তি পাওয়া যায় না। এমনকি রেমাস নিজেও জানত, পূর্ণিমার রাতে সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু অ্যালবাস ডাম্বলডোর খুব করে চাইতেন, রেমাস যেন ছাত্রদের কালো যাদু প্রতিরোধের শিক্ষা দেয়। সেজন্য ডাম্বলডোর কথা দিয়েছিলেন, তিনি রেমাসকে অনবরত ‘ওলফসব্যান’ পোশন সরবরাহ করবেন। এই পোশনে হয়তো রেমাস পুরোপুরি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি, তবে তিনি এর সুফল পেয়েছিলেন অনেক। তাকে এই পোশনটা বানিয়ে দিতে পোশন মাস্টার সেভেরাস স্নেইপ। তবে, রেমাস স্নেইপকে পছন্দ না করলেও, তার মনের কোণে স্নেইপের জন্য কিছুটা মায়া-মহব্বত ছিল।
ডাকিনীবিদ্যার বহুমুখী শিক্ষাদান
‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অভ আজকাবান’ মুভিতে দেখানো হয়েছে, রেমাস মূলত ছাত্রদের দুইটা জিনিস শিক্ষা দেন। প্রথমটা হলো বোগার্ট, যা শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচিত করানো হয় ‘ডিফেন্স অ্যাগেইনস্ট ডার্ক আর্টস’ কোর্সে। যে জিনিসে মানুষের অধিক ভয়, বোগার্ট সে ভয়কে পুঁজি করেই তার সামনে সে জিনিসের রূপ ধারণ করবে। আর দ্বিতীয় জিনিসটি হলো প্যাট্রোনাস চার্ম, যে মন্ত্র পাজি ডিমেন্টরদের তাড়াতে ব্যবহার করা হয়।
তবে তার শিক্ষাদানের বিচরণ শুধু এই দুই ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছাত্রদের হিংকিপাং (এক পেয়ে জীব; যা সাদা, নীল বা ধূসর ধোঁয়া নিয়ে হাজির হয়), রেড ক্যাপ (গবলিন জাতীয় প্রাণী। তারা বিভিন্ন প্রাসাদের অন্ধকূপে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের গর্তে বসবাস করে। কোনো পথিক ভুলক্রমে তাদের মুখোমুখি হলে তারা মুগুর দিয়ে পিটিয়ে সেই মানুষকে মেরে ফেলে), কাপ্পা (জাপানিজ জলদানব, যারা মানুষের রক্ত চুষে বাঁচে), ভ্যাম্পায়ার, ওয়্যারওল্ফ, এবং নিশাচর প্রাণীদের সম্পর্কে বিবিধ জ্ঞান প্রদান করতেন। ডাকিনীবিদ্যায় অগাধ জ্ঞান থাকার দরুন তাকে হগওয়ার্টসের অন্যতম সেরা ‘ডিফেন্স অ্যাগেইন্সট ডার্ক আর্টস’ এর শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বেশভূষা নিয়ে হাসিঠাট্টা
হগওয়ার্টসে পড়ালেখার পাঠ চুকানোর বহু বছর পরেও রেমাসকে জাদুকর সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন কটূক্তি ও বঞ্চনা সহ্য করতে করতে হয়েছে। তার এই দুরবস্থার জন্য তাকে অনেক জাদুকর অনেকসময় এড়িয়েও চলেছে। সেজন্য হগওয়ার্টসে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পরেও শিক্ষার্থীরা তার জীর্ণ বেশভূষা নিয়ে প্রচুর হাসিঠাট্টা করেছে। উদ্ভট বহিঃসজ্জার জন্য রুবিয়াস হ্যাগ্রিডকে নিয়ে স্লিদারিনের শিক্ষার্থীরা কী বিশ্রী ও কটু কথা শুনিয়েছে, তা প্রিজনার অভ আজকাবান সিনেমাতেই বিদ্যমান। কিন্তু রেমাসকে এর চেয়েও কর্কশভাবে তিরস্কার করা হতো। কিন্তু এই রূঢ় আচরণকে তেমন একটা গায়ে মাখতেন না রেমাস। জীবনের একটা অংশ বলেই চালিয়ে দিতেন।
ডার্সলিদের মুখোমুখি
পঞ্চম বর্ষ শেষে বুকভরা দুঃখ নিয়ে হ্যারি প্রিভেট ড্রাইভে ফিরেছিল গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে। কারণ, চোখের সামনেই সে তার ধর্মপিতা সিরিয়াস ব্ল্যাকের মৃত্যু দেখেছে। প্রচণ্ড বিমর্ষ মন নিয়ে হ্যারি যখন ট্রেন থেকে নামল, তখন তাকে বিশাল এক চমক দিলো রেমাস লুপিন, অ্যালেস্টর মুডি, এবং উইজলি পরিবার। সবাই হ্যারিকে সাদর আমন্ত্রণ জানাল। তারপর সকলে মিলে দলবেঁধে উঠল ডার্সলিদের বাড়িতে। তারা ডার্সলি পরিবারকে শাসিয়ে দিয়ে আসলো, যদি হ্যারির সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করা হয়, তবে এর পরিণাম ভালো হবে না। কল্পনা মিলিয়েই বলা যায়, মুহূর্তটা ছিল অত্যন্ত চমৎকার। কিন্তু আফসোসের বিষয় সেলুলয়েডের ফিতায় সে দৃশ্যকে ধারণ করা হয়নি।
নিমফ্যাডোরার প্রতি ভালোবাসা
রেমাস লুপিন এবং নিমফ্যাডোরা টঙ্কস ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য হাফ ব্লাড প্রিন্স মুভির’ দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যাদেরকে মোটামুটি বেশ ভালো স্ক্রিনিং টাইম দেওয়া হয়েছে। এই কপোত-কপোতীর মধ্যে বিদ্যমান ভালোবাসা ও মেলবন্ধন দেখে দর্শকেরা হয়ত বেজায় খুশি হয়েছে। কিন্তু তাদের জোড় বাঁধার কাহিনীটা একটু অন্যরকম।
রেমাস আর নিমফ্যাডোরার প্রথম সাক্ষাৎ হয় দ্বিতীয় ‘অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্স’ সংঘে। ১৯৯৬ সালে গ্রীষ্মের শুরুতে রেমাসের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা অনুভব করতে থাকে নিমফ্যাডোরা টঙ্কস। নিমফ্যাডোরা বারবার লুপিনকে প্রস্তাব দিতে থাকলেও, লুপিন তা প্রত্যাখ্যান করে দেয়। কারণ তার মনে শঙ্কা ছিল, রেমাসের এই ওয়্যারওল্ফ বৈশিষ্ট্য নিমফ্যাডোরার অর্জন করা খ্যাতিতে কলঙ্ক লেপে দেবে। তবে শেষমেশ রাজি হয়েছিল রেমাস। দুজনে বিয়ের পিঁড়িতে বসে ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে। বিবাহকার্য সম্পূর্ণ গোপনে সারতে হয়। কারণ, ব্রিটিশ জাদু মন্ত্রণালয়ে তখন অ্যান্টি-ওয়্যারওল্ফ আইন চালু ছিল। হ্যারিও তাদের বিয়েতে উপস্থিত হতে পারেনি। সেজন্য সেটা নিয়ে অবশ্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে।
রেমাসের সন্তান
বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গিয়েছিল নিমফ্যাডোরা টঙ্কস। তার গর্ভে তখন রেমাসের সন্তান। সেটা নিয়ে রেমাস প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল। কারণ, রেমাসের ভয় ছিল ছেলের মাঝেও যদি তার ওয়্যারওল্ফের ক্ষমতা যদি জিনগত ভাবে বাহিত হয়! সকল জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিমফ্যাডোরার কোল আলো করে জন্ম নেয় তাদের সন্তান এডওয়ার্ড টেডি লুপিন। টেডি নামটা নেয়া হয় তার নানাভাই টেড টঙ্কসের নামানুসারে। জাদু জগতের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্স থেকে ডাক পড়ে রেমাস ও নিমফ্যাডোরার। ছোট্ট শিশুকে নানু অ্যান্ড্রোমিডা টঙ্কসের হেফাজতে রেখে ঘর ছেড়ে আসে দুইজন। রেমাসের ‘লাইকানথ্রোপি রোগ’ টেডির মাধ্যমে জিনগত ভাবে বাহিত হয়নি। সে পেয়েছিল তার মায়ের আকৃতি বদলের ক্ষমতা। এমনকি তার মায়ের মতো সর্টিং হ্যাট তাকে হাউজ হাফলপাফে পাঠায়। সপ্তম বর্ষে এসে সে হেড বয় হিসেবে নির্বাচিত হয়।
ওয়্যারওল্ফ অধিকারের জন্য লড়া
উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডে ওয়্যারওল্ফকে নিকৃষ্ট ও অভিশপ্ত প্রাণী বলে গণ্য করা হয়। সেজন্যই রেমাস হগওয়ার্টসে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পূর্বে মানবসমাজ থেকে নিজেকে দূরে দূরে রাখতেন। তার ওয়্যারওল্ফ বৈশিষ্ট্যের কথা সকলে জেনে ফেলার পর তিনি হগওয়ার্টসের শিক্ষকতা পদ থেকে অবসর নেন। কারণ, তিনি ভেবেছিলেন কোনো অভিভাবক যদি শোনে তাদের সন্তানকে একজন ওয়্যারওল্ফ জাদু শেখাচ্ছে, তবে তারা সেটা ভালো নজরে দেখবেন না। এমনকি রেমাসের বাবা পর্যন্ত ওয়্যারওল্ফদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতেন। তিনি তাদেরকে শয়তান গোছের মহত্ত্ব-হীন নরকের কীট মনে করতেন, যাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু রেমাসের উপর মানুষের নির্দয় আচরণ দেখে তার সে দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়। ওয়্যারওল্ফদের জন্য আদালতে লড়েছিলেন রেমাস। এই মামলায় তিনি সফলতার মুখও দেখেন।
ওয়্যারওল্ফ অবয়ব
ওয়্যারওল্ফের চিত্র মানস পটে ভেসে উঠার সাথে সাথে এক প্রকার হিংস্র ও ভয়ংকর প্রাণী ছবি মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়। কারণ, ফেনরির গ্রেব্যাকের দুর্ধর্ষ ওয়্যারওল্ফ বেশ দেখেই দর্শকরা অভ্যস্ত। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ওয়্যারওল্ফে রূপ নিলে রেমাসকে এতো দুর্বল ও জরাজীর্ণ দেখায় কেন? এর মূল কারণ হলো, রেমাস ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়্যারওল্ফে রূপান্তরের এই ক্ষমতা বেছে নেয়নি। ফেনরির গ্রেব্যাক তার এই অবস্থার জন্য দায়ী। রেমাস তার এই ওয়্যারওল্ফ সত্ত্বাটা অপছন্দ করত। তাছাড়া সে মানুষরূপেও ফেনরিরের মতো এতো গাঁটাগোট্যা নয়। তাই তার ওয়্যারওল্ফ রূপটা রোগা ও লোম-শূন্য অবস্থায় দেখা যায়।
অর্ডার অভ মার্লিন
জাদু জগতে অর্ডার অভ মার্লিন একেবারে প্রথম সারির এক পুরস্কার, যা দেওয়া হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা জাদুকর মার্লিনের সম্মানার্থে। যে সকল জাদুকর খ্যাতির চূড়ায় আহরণ করে, মেধা, সাহসিকতা ও সৃজনশীলতা দ্বারা অভাবনীয় সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারে, তাদেরকে ‘দ্য অর্ডার অভ মার্লিন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। মার্লিন হয়তো কখনো পটারভার্সে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু তাকে সর্বকালের সেরা জাদুকরদের একজন ধরা হয়। তিনি ছিলেন সালাজার স্লিদারিনের একেবারে নিজ হাতে গড়া ছাত্র, অর্থাৎ স্লিদারিনের আমলেই তিনি হগওয়ার্টসে ভর্তি হয়েছিলেন। ফার্স্ট ক্লাস ক্যাটাগরিতে অর্ডার অভ মার্লিন জিতেছিল রেমাস লুপিন। তাকে এই সম্মাননা দেয়া হয়েছিল ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টস এবং অর্ডার অভ ফিনিক্সে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শনীর জন্য। মজার ব্যাপার হলো, জাদু জগতের ইতিহাসে সে একমাত্র ওয়্যারওল্ফ, যে এই সম্মানজনক পদকে ভূষিত হয়েছিল।
নামের উৎপত্তি
রেমাস নামটার সাথে রোমান উপকথা উৎপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ রোমান কিংবদন্তি অনুসারে রোম নগরীর গোড়াপত্তন-কারী যথাক্রমে রেমাস এবং রমুলাস দুইজনেই নেকড়ে পরিবারে বড় হয়েছে। ওল্ফ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে নেকড়ে, আর ওয়্যারওল্ফ শব্দের বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মায়া নেকড়ে’। লায়াল শব্দটা এসেছে প্রাচীন নর্স শব্দ ‘liulfr’ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে নেকড়ে। যদিও লায়াল নিজে নেকড়ে ছিল না, তবে তার সন্তান যে নেকড়ে হতে যাচ্ছে, এর পূর্বাভাস ওই নাম থেকেই পাওয়া যায়। এমনকি যে লুপাস শব্দ থেকে লুপিন নামটা নেওয়া হয়েছে, সেটাও ল্যাটিন ভাষায় নেকড়ে বুঝায়। জে. কে. রোলিং সাধারণ একটা নাম নির্বাচনে কত সূক্ষ্ম গবেষণা করেছেন, তা ভেবে অবাক হতে হয়।
রোলিংয়ের দুঃখ
ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসের সময় যত এগোতে থাকে, ভলডেমর্ট তার প্রত্যাবর্তনের পর যত অনুচর যোগাড় করতে থাকে, ততই মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিতে থাকে খ্যাতনামা সব জাদুকরেরা। ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টস শেষ হবার পর দেখা যায়, অনেক ভালো জাদুকর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। জে. কে. রোলিং যে কটা চরিত্রকে হ্যারি পটারে অত্যধিক ভালোবাসতেন, এর মধ্যে রেমাস লুপিন ছিল অন্যতম। তিনি হ্যারি, হারমায়োনি, ডাম্বলডোরের পাশাপাশিই সবসময় রেমাসকে স্থান দিয়েছেন।
রেমাসের মতো একটা চরিত্রের প্রয়াণ ঘটানোয়, বিশেষ দুঃখ প্রকাশ করেছেন রোলিং। প্রথমদিকে রেমাসকে মারার কোনো পরিকল্পনা ছিল না রোলিংয়ের। অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্স মুভিতে সে কাহিনী সাজাতে হয় তাকে। রেমাস না মারা গেলে আর্থার উইজলিকে মরতে হতো। রেমাস চরিত্রটাকে মারার মাধ্যমে একটা মেটাফোরের আভাস দিয়েছেন তিনি। কারণ, রেমাসের পুত্র এডওয়ার্ড টেডি লুপিন যুদ্ধে পিতা-মাতা উভয়কেই হারায়। তার ধর্মপিতা হয়েছিল হ্যারি পটার। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, হ্যারি পটারও টেডি লুপিনের মতো বয়সেই তার মা-বাবাকে হারিয়েছে। অর্থাৎ হ্যারি এবং টেডি- দুজন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
রেমাস চরিত্রের কুশীলব
রেমাস লুপিনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেতা, পরিচালক, ও চিত্রনাট্যকার ডেভিড থিওলিস। তিনি প্রথমে প্রফেসর কুইরেল চরিত্রের জন্য অডিশন দিয়েছিলেন। ওই চরিত্রের জন্য নিযুক্ত না হলে পরবর্তীতে তিনি রেমাস লুপিনের জন্য অডিশন দেন। মজার ব্যাপার হলো, তখনো তিনি হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজির দ্বিতীয় বা তৃতীয় বইটি পড়েননি। এবং এই চরিত্র সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। ডেভিড থিওলিসকে প্রস্থেটিক মেকাপের মাধ্যমে ওয়্যারওল্ফের অবয়ব দাঁড় করানোর জন্য স্পেশাল ইফেক্ট টিমকে পাক্কা ছয় ঘণ্টা খাটতে হয়েছিল।
প্যাট্রোনাস
বই অথবা মুভি- কোনো জায়গাতেই রেমাসের প্যাট্রোনাসের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বিষয়টা খানিক অদ্ভুত ঠেকে। কারণ, এই রেমাসই হ্যারিকে ডিমেন্টরের হাত থেকে বাঁচার প্যাট্রোনাস শিখিয়েছিল, যা পুরো প্রিজনার অভ আজকাবান মুভির প্রধান প্যাট্রোনাস। এই বিষয়ে পরবর্তীতে মুখ খুলেছেন জে. কে. রোলিং। তার ভাষ্যমতে, রেমাসের প্যাট্রোনাস ছিল মামুলি এক নেকড়ে। এই নেকড়ে প্যাট্রোনাস কাস্ট করতে রেমাস মূলত অস্বস্তি বোধ করত। এজন্য তাকে কোনোসময় ওই প্যাট্রোনাস কাস্ট করে দেখা যায়নি।