অ্যাভাটার সিনেমার অজানা যত দিক

ভবিষ্যতের পৃথিবী, ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২১৫৪ সাল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষ এগিয়ে গেছে বহু যোজন ক্রোশ। চিরসবুজ পৃথিবীও তখন এখনকার থেকে বসবাসের জন্য অধিক অনুপযুক্ত। পৃথিবীতে খনিজ সম্পদের টান পড়ার উপক্রম হলে ‘রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (আরডিএ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান পৃথিবী থেকে বহু দূরের এক উপগ্রহ প্যান্ডোরায় নিজেদের অভিযান চালায়। মূল লক্ষ্য, প্যান্ডোরায় মজুদ থাকা মহামূল্যবান খনিজ ‘আনঅবটেনিয়াম’ সংগ্রহ করা।

ওই গ্রহের আদিবাসী না’ভি নামক এক বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গে তা নিয়ে তুমুল সংঘর্ষ বাধে মানুষের। সমস্যা সমাধানে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা হুবহু না’ভির মতো দেখতে একপ্রকার অ্যাভাটার তৈরি করেন, যেটা অর্ধ এলিয়েন-অর্ধ মানব ডিএনএ-র সংমিশ্রণে গড়া। শৈশবে পঠিত বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন এবং অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এভাবেই জেমস ক্যামেরন দাঁড় করিয়েছিলেন ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সায়েন্স ফিকশন সিনেমা ‘অ্যাভাটার’। বহুল আলোচিত সিনেমাটির অজানা কিছু দিক নিয়েই আজকের এই আয়োজন।

অ্যাভাটার; Image Source: 20th Century Studios.

স্যামের ভাগ্যবদল

অ্যাভাটার সিনেমার মূল নায়ক জ্যাক সালির চরিত্রে সর্বপ্রথম ভাবা হয়েছিল হলিউড তারকা জ্যাক জিলেনহালকে। তবে জ্যাইক তখন প্রিন্স অভ পার্সিয়া মুভির শিডিউলে ব্যস্ত থাকায় এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেননি। ডিসি কমিকসের ‘ওয়ান্ডার ওম্যান (২০১৭)’ মুভিতে স্টিভ ট্রেভরের চরিত্রে অভিনয় করা ক্রিস পাইনকে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সেটাও ব্যাটে-বলে মেলেনি। জেমস ক্যামেরন জ্যাক সালির জন্য মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন তারকা ম্যাট ড্যামনকে। কিন্তু ‘বর্ন’ সিরিজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনিও ক্যামেরনের মুভিতে কাজ করতে পারেননি। তবে, এই মুভি প্রত্যাখ্যান করে বিশাল পরিমাণ এক অর্থ কামানোর সুযোগ হারিয়েছেন ড্যামন। শুরুর দিকে ড্যামনকে বলা হয়েছিল, এই সিনেমা বক্স অফিসে যত আয় করবে, পারিশ্রমিক হিসেবে এর ১০% লভ্যাংশ দেওয়া হবে তাকে। সংখ্যার হিসেবে তা ছিল প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার!

মূল চরিত্রটি এত এত অভিনেতার দ্বারে ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত ভাগ্যচক্রে এসে হাজির হয় অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা স্যাম ওয়ার্থিংটনের কাছে। অভাবের তাড়নায় সবকিছু বিক্রি করে তিনি তখন প্রায় নিঃস্ব। থাকতেন নিজ গাড়িতে। ওইখান থেকেই অডিশন টেইপ পাঠিয়েছিলেন ক্যামেরনের কাছে। ক্যামেরনও চাচ্ছিলেন চরিত্রে নতুন মুখ আনা দরকার। তাই অখ্যাত এই অভিনেতাকে বেছে নিয়ে তাকে রাতারাতি বানিয়ে দিলেন বিখ্যাত। বলা যায়, একেবারে সঠিক সময়ে জীবনের তপ্ত প্রখরতা কাটিয়ে ক্যামেরন স্যামের জীবনে শীতল বৃষ্টির মতো আশীর্বাদ হয়ে বর্ষিত হয়েছিলেন।

জ্যাক জিলেনহাল, ক্রিস পাইন, ম্যাট ড্যামন; Image Source: IMDb.

দীর্ঘ প্রতীক্ষা

অ্যাভাটার সিনেমার স্ক্রিপ্টের কথা বহুদিন আগেই এসেছিল ক্যামেরনের মাথায়। ১৯৯০ সালের দিকে ক্যামেরন কম্পিউটার জেনারেটেড অভিনেতাদের দিয়ে অ্যাভাটার সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন। ওই সিনেমায় ছয়টা মুখ্য চরিত্র থাকার কথা ছিল, যে চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতাদের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। ১৯৯৪ সালে ক্যামেরন অ্যাভাটারের ৮০% কাজ গুছিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে ভিজুয়াল ইফেক্টের মান অতটা উন্নত না হওয়ায় তিনি তেমন ভরসা পাচ্ছিলেন না। এডভান্সড সিজিআই এবং ভিএফএক্স না থাকার কারণে, সে ধারণাকে আপাতত স্থগিত রেখে টেকনোলজিক্যাল অ্যাডভান্সমেন্টের জন্য তিনি তীর্থের কাকের মতো বসেছিলেন। ২০০২ সালে ‘দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস: দ্য টু টাওয়ার্স’ সিনেমায় গলুমের সিজিআই আর মোশন ক্যাপচার দেখে অভিভূত হন ক্যামেরন। তিনি বুঝতে পারলেন, কাজে নামার উপযুক্ত সময় এসে গেছে। এরপরেই তিনি কোমরে গামছা বেধে তার ড্রিম প্রজেক্ট বাস্তবায়নে নেমে যান।

গলাম; Image Source: New Line Cinema.

ভিজুয়াল ইফেক্ট

জেমস ক্যামেরনের ভিজুয়াল মাস্টারপিস ‘অ্যাভাটার’ সিনেমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে এর চোখধাঁধানো ভিএফএক্স এবং সিজিআই। ভিজুয়াল ইফেক্টের দিকটা দেখভাল করেছিল ওয়েটা ডিজিটাল নামে এক কোম্পানি। এই কাজ সামলানোর জন্য ৪ হাজার সার্ভার সম্বলিত ১০ হাজার বর্গ ফুটের একটি সার্ভার ফার্ম ব্যবহার করা হয়েছিল, যেটার নেটওয়ার্ক স্টোরেজ ক্যাপাবিলিটি ছিল ৩ পেটাবাইট (১০ লক্ষ গিগাবাইট = ১ পেটাবাইট)! প্রসেসর কোরের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার আর র‍্যামের পরিমাণ ছিল ১০৪ টেরাবাইট। বিশাল পরিমাণ এই স্টোরেজ দিয়ে উবুন্টু লিনাক্স, গ্রিড ইঞ্জিন ক্লাস্টার ম্যানাজার, এবং অ্যানিমেশন সফটওয়্যার ‘পিক্সার্স রেন্ডারম্যান’ এবং ‘পিক্সার্স আলফ্রেড’ কিউই ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সামলানো হতো। বিশ্বের সেরা ৫০০ সুপারকম্পিউটারের মধ্যে এই দুই রেন্ডার ফার্মের অবস্থান যথাক্রমে ১৯৩ এবং ১৯৭।

নেইতিরি; Image Source: 20th Century Studios.

প্রত্যেকটা সিজিআই শট ১৭ জিবি করে জায়গা দখল করত। এর মধ্যে হাই কোয়ালিটির একেকটা সিন রেন্ডার করতে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগত। কাজের চাপ কমিয়ে আনার জন্য মাইক্রোসফট শুধুমাত্র অ্যাভাটার মুভির জন্য ‘গায়া’ নামে নতুন একটি ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ডিজিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট উদ্ভাবন করে। সিজিআইয়ের পাশাপাশি অনেক প্র‍্যাক্টিক্যাল প্রপ্স্ এবং এলিমেন্ট এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। যেমন- জ্যাক সালির খোঁড়া পা দেখানোতে কোনোপ্রকার ভিজুয়াল ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়নি। এটা মূলত প্র‍্যাক্টিক্যাল এলিমেন্ট আর ক্যামেরার ভেল্কিবাজি।

অ্যাভাটার সিনেমার ভিএফএক্স; Image Source: 20th Century Studios.

তরুক: দ্য ফার্স্ট ফ্লাইট

সিনেমা হিসেবে সকলের মন জয় করে নেওয়ার পাশাপাশি, ভিডিয়ো গেমস, কমিক্সসহ অন্যান্য মাধ্যমেও সফলতার মুখ দেখেছে অ্যাভাটার। কিন্তু সবচেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক ছিল কানাডিয়ান এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি ‘Cirque du Soleil’ এর অ্যাভাটার স্টেজ পারফরম্যান্স। ‘Toruk: The First Flight‘ নামক এই শো দর্শকদের কাছ থেকে দারুণ প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছিল। অনুষ্ঠানটিকে আরও জীবন্ত করার জন্য এর পরামর্শদাতা হিসেবে নিযুক্ত করা হয় জেমস ক্যামেরনকে। যারা এই শো সরাসরি দেখতে পারেননি, তাদের জন্য প্রোডাকশন টিম অফিসিয়াল ডিভিডির ব্যবস্থা করে রেখেছে।

তরুক: দ্য ফার্স্ট ফ্লাইট; Image Source: IMDb.

না’ভির অনুপ্রেরণা

ক্যামেরুন না’ভির অনুপ্রেরণা পেয়েছিল তার মায়ের কাছ থেকে। জেমসের মায়ের স্বপ্নে একদিন নীল রঙয়ের লম্বাটে মহিলার আবির্ভাব ঘটে, যেটার কথা তিনি তার ছেলেকে জানান। এরপর থেকেই জেমস নাভির কনসেপ্ট আর্টকে ক্রমশ ডেভেলপ করতে লাগলেন। এখানে ‘অ্যাভাটার‘ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও, শব্দটির আসল উচ্চারণ হলো মূলত ‘অবতার’, যা নেওয়া হয়েছে সংস্কৃত শব্দ থেকে। সনাতন ধর্মমতে, পৃথিবীতে পাপের সংখ্যা বেড়ে গেলে, দেবতারা পশু বা মানুষের রূপ ধারণ করে, মানুষকে সুপথে পরিচালনা ও পাপ দমনের জন্য মর্ত্যে আগমন করলে তাকে ‘অবতার’ বলা হয়। হিন্দুধর্মের দেবতা বিষ্ণুর নীল গায়ের নীল রং থেকেই না’ভিদের নীল বর্ণের ধারণা নিয়েছেন ক্যামেরন।

দেবতা বিষ্ণু; Image Source: Bhakti Times.

আবার নাভি একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ হলো ‘ভবিষ্যদ্বক্তা’ বা ‘ধর্মপ্রবক্তা’। এছাড়াও বরাবরের মতো ক্যামেরন তার মুভির চরিত্রের নামকরণে খ্রিষ্টান সাধুপুরুষদের নামের ছাপ রেখেছেন। ডক্টর অগাস্টিনের নাম তিনি সেন্ট অগাস্টিনের নাম থেকে নিয়েছেন, যিনি ইংল্যান্ডে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার করতেন।

না’ভি; Image Source: 20th Century Studios.

না’ভি আর অ্যাভাটারদের মধ্যকার পার্থক্য

সিনেমার ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টের পেছনে অনেক সময় ব্যয় করা হয়েছে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, না’ভি আর অ্যাভাটারদের মাঝে অনেক সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। না’ভিরা হলো প্যান্ডোরা গ্রহের স্থায়ী বাসিন্দা, অপরদিকে অ্যাভাটাররা হলো বিজ্ঞান এবং মানুষের ডিএনএ থেকে তৈরিকৃত সংকর জীব। অ্যাভাটারদের চোখের উপরে ভ্রু ছিল। তাদের হাত-পায়ে আঙুলের সংখ্যা পাঁচটি। তারা ছিল সুঠাম দেহের অধিকারী। অপরদিকে না’ভিদের কোনো ভ্রু ছিল না, হাতে-পায়ে তিনটা করে আঙুল, এবং তাদের শরীর ছিল পাতলা গড়নের। এই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো সিনেমার ডিটেলিংকে আরও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

না’ভিদের হাতে ছিল তিনটি আঙুল; Image Source: 20th Century Studios.

প্যান্ডোরার নতুন ভাষা

মুভিতে প্যান্ডোরা গ্রহের আদিবাসী না’ভিদেরকে স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ এক ভাষা বলতে শোনা গিয়েছে। শুধু তাদের জন্য নতুন এই ভাষার সৃষ্টি করেছিলেন ইউনিভার্সিটি অভ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া ভাষাতত্ত্ববিদ প্রফেসর ডক্টর পল আর প্রোমার। এজন্য তাকে এক হাজারের মতো শব্দ তৈরি করতে হয়েছে। ক্যামেরন অবশ্য প্রোমারকে বলেছিলেন, ভাষাতে সহজ শব্দ ব্যবহার করতে, যাতে অভিনেতাদের তা উচ্চারণে তেমন সমস্যা না হয়।

ভাষাবিৎ পল ফ্রমার; Image Source: Alamy.

আনঅবটেনিয়াম

যে কারণে পৃথিবীর মানুষ আর না’ভিরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, তা হলো প্যান্ডোরা অতি-মূল্যবান এক খনিজ ‘আনঅবটেনিয়াম‘। বাস্তবে এমন কোনো খনিজ অস্তিত্ব না থাকলে বিজ্ঞানমহলে এই শব্দটি বেশ পরিচিত। যে বস্তু কাজের জন্য যুতসই, কিন্তু বাস্তবে ওই বস্তুর অস্তিত্ব না থাকলে বিজ্ঞানীরা একে আনঅবটেনিয়াম বলে অভিহিত করে থাকেন। পাশাপাশি এই আনঅবটেনিয়ামের দাম অতি চড়া এবং এটা পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ নীতিসমূহ মেনে চলে না। অ্যাভাটার ছাড়াও, ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য কোর’ সিনেমায় আনঅবটেনিয়ামের কথা বলা আছে।

আনঅবটেনিয়াম; Image Source: 20th Century Studios.

বক্স অফিস

পুরো সিনেমা নির্মাণে খরচ করা হয়েছিল ২৩৭ মিলিয়ন ডলার। মুক্তির মাত্র ১৯ দিনের মাথায় বিশ্বব্যাপী ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজের থলেতে পুরে নেয় অ্যাভাটার। অ্যাভাটার আসার আগে বক্স অফিসে বহু রেকর্ড ছিল ক্যামেরনেরই সিনেমা টাইটানিকের দখলে। ডমেস্টিকে অ্যাভাটারের আয় ছিল ৭৬০ মিলিয়ন ডলার, যা ‘Star Wars: The Force Awakens’ মুক্তির আগপর্যন্ত সর্বোচ্চ। ‘অ্যাভেঞ্জারস: এন্ডগেম’ মুক্তির আগ পর্যন্ত প্রায় এক দশক বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ আয়কৃত মুভির রেকর্ড ছিল অ্যাভাটারের দখলে।

জ্যাক সালির চরিত্রে স্যাম ওয়ার্থিংটন; Image Source: 20th Century Studios.

এন্ডগেম অ্যাভাটারের রেকর্ড ভেঙে ফেললে, দশ বছর পর চীনে অ্যাভাটারকে পুনরায় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হলে, সেটি ২.৯২৩ বিলিয়ন ডলার আয়ের মাধ্যমে বক্স অফিসে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য ঘোষণা করে দেয়। ২০১০ সালের ৮২তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে এই সিনেমা মোট নয়টি বিভাগে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সিনেমা, শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ পাঁচটি বিভাগে পুরস্কার বাগিয়ে নেয় অ্যাভাটার।

This is a Bengali article about unknown facts of Avatar (2009) movie.
References: Hyperlinked inside the article
Feature Image: 20th Century Studios

Related Articles

Exit mobile version