১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিলের রাতের শেষভাগ। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ইউক্রেনের প্রিপিয়েত শহরের ইয়ানিভ রেলস্টেশন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বের রেলসড়ক ব্রিজটির উপরে মানুষের ভিড়। শহরের আবালবৃদ্ধবনিতার এক বড় অংশ সেখানে জমা হয়েছে অভূতপূর্ব এক ঘটনার সাক্ষী হতে। প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের চেরনোবিল শহরে অবস্থিত এক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন লেগেছে। কিন্তু সেই অগ্নিশিখার নীলাভ আলো চারপাশে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, দেখে মনে হচ্ছে নরওয়ের অত্যাশ্চর্য নর্দান লাইটের একটি খণ্ড যেন ইউক্রেনের আকাশে নেমে এসেছে।
পরবর্তী দুইদিনের মধ্যে সেই ব্রিজটিতে জড়ো হওয়া প্রতিটি মানুষ অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে জানতে পারলো, সেই অদ্ভুত সুন্দর নীলাভ আলোটি ছিলো আদতে তেজস্ক্রিয়তার বিষাক্ত ছোবল। প্রায় ৪১ বছর আগে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে আছড়ে পড়া পারমানবিক বোমা এক লহমায় কেড়ে নিয়েছিলো প্রায় আড়াই লাখ প্রাণ। সেই দুই পারমানবিক বোমার ৫০০ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে চেরনোবিল পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪ নম্বর রিয়্যাক্টর।
প্রিপিয়েত শহরের সেই রেলব্রিজটিতে জড়ো হওয়া মানুষদের কেউই শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি। বাঁচেনি চেরনোবিলের আগুন নেভাতে ছুটে যাওয়া দমকলবাহিনীর বেশিরভাগই। বিস্ফোরণের কবলে পড়ে সে রাতেই প্রাণ হারান বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেক কর্মী। আর সেই তেজস্ক্রিয়তার ভয়ানক ছোবলে অস্তিত্ব বিলীনের হুমকিতে কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, বরং গোটা ইউরোপ!
অথচ’ আজ অব্দি পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম পারমাণবিক বিপর্যয়ে নিহতের আনুষ্ঠানিক সংখ্যাটি মাত্র ‘৩১’! চেরনোবিলের ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তার হাত থেকে রক্ষা পেতে বেলারুশ এবং ইউক্রেইনের ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ছেড়ে পালাতে হয়েছিলো ৩ লাখেরও বেশি মানুষকে। অথচ’ এই তেজস্ক্রিয়তাকে প্রথমে ‘এক্সরে পরীক্ষার চেয়ে খানিকটা বেশি’ বলে দাবি করার চেষ্টা করছিলো সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্র!
এর পর কেটে গিয়েছিলো পাঁচটি বছরেরও বেশি সময়। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পতন ঘটেছিলো ৬৯ বছর ধরে পৃথিবীর বুকে বিপ্লবের মশাল হাতে নিয়ে টিকে থাকা সমাজতন্ত্রের পুণ্যভূমির। বিশ্ব রাজনীতির পালাবদল, প্রতিক্রিয়াশীলদের ষড়যন্ত্র কিংবা পুঁজিবাদের বিজয়- যেটিকেই পরাক্রমশালী রুশদের পতনের কারণ হিসেবে তুলে ধরা হোক না কেন, এর শুরুটা চেরনোবিলের সেই অভিশপ্ত রাতেই হয়েছিল বলে বিশ্বাস করতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ রাষ্ট্রনায়ক মিখাইল গর্বাচেভ।
চেরনোবিলের সেই দুঃস্বপ্ন ভুলতে রুশ গণমাধ্যম চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। ইতিহাসের গহীনতম খাদে অনেক আগেই তারা কবর দিতে চেয়েছিলো ভয়াবহ সেই উপাখ্যানকে। কিন্তু ১১ বছরের মাথাতেই চেরনোবিলের অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়টি উঠে এসেছিলো বইয়ের পাতায়।
আর ২২ বছর পর গোটা বিশ্বের সামনে আবারও মূর্ত হয়ে উঠলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিপর্যয়। এবার তা এইচবিও’র মিনি সিরিজ ‘চেরনোবিল’ হিসেবে।
চেরনোবিল: বইয়ের পাতা থেকে এইচবিওর পর্দায়
‘আমাদের গোটা ইতিহাসের দিকে যদি একবার তাকান, হোক সেটা সোভিয়েত সময়কার অথবা তার পরের; এটা আসলে মানবতার এক বিশাল গণকবর। যেটি বারবার হয়েছে রক্তস্নাত।এটা এক কখনোই শেষ না হতে চাওয়া উপাখ্যান, যা গল্প বলে খুনি এবং নিহতের। যেখানে বারবার রুশদের সেই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়: কী করতে হবে এবং এর জন্য কে দায়ী? বিপ্লব, গুলাগ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ, বিরাট একটি সাম্রাজ্যের পতন, সমাজতান্ত্রিক বিশাল এক রাষ্ট্রের পতন এবং এখন এই ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ- চেরনোবিল। যেটি পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত প্রাণীর জন্যই এক চ্যালেঞ্জ। এটিই আমাদের ইতিহাস। এটি নিয়েই আমার বই। এটিই আমার পথচলা, নরকের মধ্য দিয়ে আমার আবর্তন।’
২০১৫ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী লেখিকা সভেৎলানা আলেক্সিয়েভিচ নিজের সাহিত্যিক অভিযাত্রাকে ঠিক এভাবেই তুলে ধরেছেন। এককালের সোভিয়েত রাষ্ট্র বেলারুশের নাগরিক সভেৎলানা পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। আর সেই সূত্রেই মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যে বিপ্লব, গণহত্যা, মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরাট পরিবর্তন দেখে ফেলা এক সুবিশাল রাষ্ট্রের শত শত মানুষের খুব কাছে গিয়ে তাদের নিগূঢ় গল্পের অংশ হতে পেরেছেন তিনি।
আর সেকারণেই সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে ইতিহাসকে যেভাবেই লিখুক না কেন, সভেৎলানা আলেক্সিয়েভিচ ১৯৯৭ সালে তার রচিত বই ‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল: দ্য ওরাল হিস্ট্রি অফ আ নিউক্লিয়ার ডিজাস্টার’ -এ তুলে ধরেন মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম তামসিক অধ্যায়ের আসল সত্যিটাকে।
সভেৎলানা আলেক্সয়েভিচ- এর লেখনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ইতিহাসের কঠিনতম অধ্যায়গুলোকে ধরতে তিনি সাহায্য নেন একেবারে সাধারণ সব মানুষের। চেরনোবিল দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিলো রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের আমলাতন্ত্রের উপরের দিকে বসে থাকা মানুষেরা। অপরদিকে এই বিপর্যয়কে সর্বগ্রাসী হওয়া থেকে রক্ষার করা মানুষগুলো ছিলো একেবারেই সাধারণ, খেটে খাওয়া রুশেরা। সোভিয়েত এবং পরবর্তীতে রুশ সরকার যখন এই রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে ঢেকেঢুকে রাখার চরম চেষ্টায় রত, ঠিক তখনই সভেৎলানা খুঁজে বের করেছেন সেইসব মানুষদের- যাদের অসাধারণ আত্মত্যাগের কারণে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলো গোটা ইউরোপ।
সভেৎলানা সেই সব সর্বস্ব ত্যাগ করা মানুষদের পেছনে পেছনে ঘুরেছেন। চেরনোবিলের জন্য যারা সবকিছু হারিয়েছেন, কিন্তু কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিলেন- সেরকম ৫০০ মানুষের সাক্ষাৎকার নেন তিনি। সেসব মানুষের সাক্ষ্যই জ্বলজ্বলে ইতিহাস হয়ে ফিরে আসে তার বইটিতে।
২০১৪ সালে সোভিয়েত ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে সভেৎলানার লেখা চেরনোবিলের এই আখ্যানটির খোঁজ পান ক্রেইগ মাজিন। এর আগপর্যন্ত তিনি পরিচিত ছিলেন ‘হ্যাংওভার’ এবং ‘স্ক্যারি মুভি’র মতো জনপ্রিয় কমেডি সিরিজের লেখক হিসেবে। কিন্তু সভেৎলানার এই বইটি যেন মাজিনকে রূপান্তরিত করে এক অন্য মানুষে; চেরনোবিল বিপর্যয়ের পেছনের গল্প খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলেন সোভিয়েত রাশিয়ার ইতিহাসের সেই বিশাল গণকবরটিকে!
নিজের এই আবিষ্কার নিয়ে স্রেফ বসে থাকতে চাইলেন না মাজিন। উঠে-পড়ে লাগলেন এমন এক দক্ষযজ্ঞের প্রস্তুতিতে, যা এর আগে কখনোই করেননি তিনি- একটি হিস্টোরিকাল ড্রামা সিরিজের প্রথম পর্বের চিত্রনাট্য লেখায়!
২০১৭ তে এইচবিও ঘোষণা দেয় ‘চেরনোবিল’ নামের ৫ পর্বের মিনিসিরিজটি তৈরির। ২০১৮ তে জোহান রেনেক শুরু করেন এটি তৈরির প্রক্রিয়া। অবশেষে ২০১৯-এর ৬ মে মুক্তি পায় এটি। আর তারপর থেকেই গণমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজনীতি- প্রতিটি ক্ষেত্রেই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে সিরিজটি।
মিথ্যার বিপরীতে সত্যের সাহস
সাহিত্যনির্ভর ভিজুয়াল ফিকশনে নির্মাতারা অনেক সময়ই বইয়ের মূল ন্যারেটিভ থেকে সরে আসার প্রবণতা দেখান। এইচবিওর সদ্য সমাপ্ত সিরিজ ‘গেইম অফ থ্রোনস’ যার চাক্ষুষ প্রমাণ। কিন্তু ঐতিহাসিক ড্রামা বলেই হয়তো ন্যারেটিভের দিক থেকে বইয়ের পথরেখাকেই অনুসরণ করেছে এবারে এইচবিও।
সিরিজের প্রধান তিন চরিত্র উপরতলার আমলারা হলেও, শুরু থেকেই সমান গুরুত্ব পেয়েছে চেরনোবিল বিস্ফোরণের সময় কাজ করা দমকল বাহিনীর এক সাধারণ সদস্য ভাসিলি ইগনেতেঙ্কোর গল্প। প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয়তায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করা ভাসিলির সঙ্গে শেষপর্যন্ত থাকায় গর্ভের সন্তান হারানো তার স্ত্রী লুদমিলার গল্প। উঠে এসেছে সেই আত্মত্যাগী শ্রমিকদের গল্প, যারা তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো দিনরাত খেটে চেরনোবিলের বিস্ফোরিত পাওয়ার প্ল্যান্টের ছাদ থেকে গ্রাফাইটের খণ্ড পরিষ্কার করতে।
উঠে এসেছে সেই তিন অকুতোভয় কর্মীর কথা, যারা প্রাণনাশের হুমকির কথা জেনে বুঝেই তেজস্ক্রিয়তায় বিষাক্ত পানিতে নেমে পড়েছিলেন আরও বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে চেরনোবিলকে বাঁচানোর জন্য। উঠে এসেছে সেইসব হাসপাতালকর্মী, বিজ্ঞানী, সেনাসদস্য এবং নিতান্ত সাধারণ সেইসব মানুষের কথা, চেরনোবিলের বিস্ফোরণ যাদের জীবনকে পাল্টে দিয়েছিলো পুরোপুরি।
তবে এদের সবার মধ্যেও একজন বিজ্ঞানী ছিলেন, যিনি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সোভিয়েত প্রশাসনের লুকোচুরির অপপ্রয়াসকে চ্যালেঞ্জ করে চেরনোবিলের সত্যিটা তুলে ধরেছিলেন গোটা বিশ্বের সামনে। এর বিনিময়ে দিয়ে দিয়েছিলেন নিজের প্রাণটাই।
ভ্যালারি লেগাসভ নামের সেই অকুতোভয় বিজ্ঞানীকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘ম্যাড ম্যান’ এবং ‘দ্য ক্রাউনের জন্য বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেতা জ্যারেড হ্যারিস। লেগাসভের জবানীতেই উঠে এসেছে চেরনোবিল বিপর্যয়ের মূল কারণ, ‘যখন সত্যটা শুনে কষ্ট হয়, আমরা তখন একের পর এক মিথ্যা বলেই যাই। শেষ পর্যন্ত আমরা আমরা ভুলেই যাই সত্যের অস্তিত্ব। কিন্তু সেই অস্তিত্বকে কখনও মোছা যায় না। প্রতিটি মিথ্যাই সত্যকে ঢেকে রাখার জন্য চড়া ঋণে কেনা একেকটি পর্দা। আগে হোক বা পরে, সেই ঋণ আমাদের চুকাতেই হতো। আর মিথ্যার এই ঋণ শোধ করতে গিয়েই বিস্ফোরিত হয়েছে চেরনোবিলের আরবিএমকে রিয়্যাক্টর।
এভাবেই ছোট চরিত্র থেকে শুরু করে বড় চরিত্র- সবার মাধ্যমেই পারমাণবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার অসম লড়াইয়ের দুঃসাহসিক আখ্যান ‘চেরনোবিল’। রুশ গণমাধ্যম যতই তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার এমন বিস্তারিত ব্যবচ্ছেদ মেনে নিতে খাবি খাক, সাধারণ দর্শক কিন্তু দেখেছে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন বিষয় : মার্কিন নির্মাতাদের কণ্ঠে সোভিয়েত দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের জয়গান!
বরিস শেরবিনা এবং উলানা খোমিউক
চেরনোবিলের কাহিনী পরম্পরা ভাসিলি লেগাসভকে ঘিরে আবর্তিত সূচনা, বিকাশ এবং রূপান্তরের দিক থেকে সব আলো কেড়ে নিয়েছে বরিস শেরবিনার চরিত্রটি। ১৯৮৬ তে বোরিস শেরবিনা ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের উপ-প্রধানমন্ত্রী। আর তার হাতেই চেরনোবিল বিপর্যয়ের সাফাইয়ের কাজটি তুলে দেন গর্বাচেভ। সিরিজের শুরুতে ঘাগু রাজনীতিবিদ হিসেবে চেরনোবিলের দুর্ঘটনার ব্যাপকতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা গিয়েছিলো শেরবিনার মধ্যে। কিন্তু প্রতিটি পর্বের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবর্তন ছিলো লক্ষণীয়। বিপর্যয় ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়ে নিজেকেও উজাড় করে দেয়া শেরবিনা শেষ পর্বে রাজনীতির বদলে প্রাধান্য দেন মানবিকতাকে। আর এর মাধ্যমে যে অসাধারণ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে শেরবিনার চরিত্রটিকে যেতে দেখা যায়- তা এক কথায় ছিলো চমকপ্রদ। সুইডেনের প্রভাবশালী অভিনেতা স্টেলান স্কার্সগার্ডের দারুণসব অভিব্যক্তি তাতে যোগ করেছে অনন্য এক মাত্রা।
লেগাসভ এবং শেরবিনার পাশাপাশি আরেকটি যে চরিত্র অভিনয়শৈলীর দিক থেকে মন জয় করে নিয়েছে, সেটি হলো বিজ্ঞানী উলানা খোমিউকের। ঐতিহাসিক এক ড্রামা সিরিজে ঐতিহাসিক সব চরিত্রের পাশে এই একটি চরিত্রকে নির্মাতারা তৈরি করেছিলেন তাদের কল্পনা দিয়ে। তবে সেই কল্পনার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে নির্মাতাদের জন্য কাজ করেছে লেগাসভের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া এক ঝাঁক সাহসী বিজ্ঞানীর অবদান।
তবে ‘খোমিউক’ চরিত্রটিকে নারীচরিত্র হিসেবে দর্শকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রেরণা নির্মাতারা সম্ভবত পেয়েছেন সভেৎলানার কাছ থেকেই। খোমিউকের মতোই জোঁকের মতো লেগে থেকেই যে চেরনোবিলের ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে খুঁজে বের করেছিলেন সভেৎলানা! পর্দায় তার চরিত্রের সেই সত্যান্বেষী দৃঢ়তাকে ফুটিয়ে তুলতে কোনো কার্পণ্যই করেননি প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেত্রী এমিলি ওয়াটসন। খোমিউকের চরিত্রটিই শেষ পর্যন্ত গোটা সিরিজের মোরাল কম্পাস হিসেবে কাজ করেছে।
ঐতিহাসিক বিপর্যয় এবং চেরনোবিলের শিক্ষা
মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় বিপর্যয়গুলোর জন্য যে দায়ী মানুষ নিজেই, – ইতিহাসের কঠিনতম শিক্ষা সম্ভবত এটাই। আর সেকারণেই হয়তো, দুর্ঘটনাকালীন ভয়াবহতা প্রথম পর্বেই দেখিয়ে দিয়ে ‘চেরনোবিল’ ধীরে ধীরে বলে গেছে এর পরবর্তী প্রভাবের কথা। প্রতিটি পর্বের ঘটনাপ্রবাহ, কলাকুশলীরা বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে মিথ্যার বেসাতি এবং রাষ্ট্রীয় অনাচার প্রযুক্তির সর্বাধুনিক আশীর্বাদকেও পরিণত করতে পারে ভয়ঙ্করতম অভিশাপে।
সাম্যবাদ আর সততার মহান স্বপ্নকে সত্যে রূপান্তরিত করতে রাশিয়ায় একদিন বিপ্লব এসেছিলো। মহান সেই বিপ্লবীদের উত্তরসূরিরা যখন প্রগতির মুখোশের আড়ালে প্রতিক্রিয়ার চর্চায় মেতে উঠেছিলো, তখনই তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়েছিলো তাদের পুণ্যভূমি।
প্রশ্ন হলো, ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষাটা নেব কিনা? উন্নতি আর জাতীয়তাবাদের সানগ্লাসে রাষ্ট্রের চোখ একটু আড়াল হলেই আরেকটা চেরনোবিলের অভিশাপ এসে লাগতে পারে রূপপুরেও। আর সেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের জন্য আমরা আদৌও প্রস্তুত তো?