ইবনে বতুতা ও মার্কো পোলো, ভূ-পর্যটনের ইতিহাসে বিখ্যাত দুই নাম। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রায় সবাই এ দুই ভূপর্যটকের কথা শুনেছে। বাঙালিদের মাঝে মার্কো পোলো তেমন পরিচিত নাম না হলেও প্রায় সবাই-ই ইবনে বতুতার বাংলা (বাঙ্গালা) ভ্রমণের কাহিনী ছোটবেলা থেকে শুনে বড় হয়। তার বর্ণনা থেকেই প্রথম বাংলার অধিবাসীদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানা যায়। বাঙালিদের মাঝেও বেশ কয়েকজন ভূপর্যটক রয়েছেন। বাঙালিদের মাঝে সর্বপ্রথম বিশ্বভ্রমণে বের হন বিমল মুখার্জি। অবিভক্ত ভারতের বাঙালি এ পর্যটক বাই সাইকেলে করে প্রায় বার বছর সময় ধরে সারা বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন। বিমল মুখার্জি নামের এই বাঙালি ভূপর্যটক বাঙালিদের নামের সাথে যোগ করেছেন নতুন ইতিহাস।
বিমল মুখার্জি জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৩ সালে। তার শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। ছোটবেলা থেকেই তিনি শুনে এসেছেন যে, বাঙালি ভীতু, ঘরকুনো ও ঘরমুখো। ছেলেবেলা থেকে গায়ে লেগে থাকা বাঙালির এ দুর্নাম ঘোচাবার জন্য ছেলেবেলায় যখন ভূগোল পড়তেন, তখন সারা পৃথিবী ঘোরার স্বপ্ন তাকে নেশার মতো করে আটকে ধরত। সে উদ্দেশ্যে ১৯২৬ সালে মাত্র তেইশ বছর বয়সে তিন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন বিশ্বভ্রমণ করতে। তারও আগে ১৯২১ সালে তিনি নিজ জন্মভূমিকে ভালো করে দেখার উদ্দেশ্যে ভারতভ্রমণ শুরু করেন। পাঁচ বছর পর, ১৯২৬ সালে তিনি ভারতভ্রমণ শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসেন। সঙ্গে নামমাত্র অর্থ নিয়ে অশোক মুখার্জি, আনন্দ মুখার্জি, মণীন্দ্র ঘোষ ও বিমল মুখার্জি- এই চার বন্ধু কলকাতার টাউন হল থেকে ১৯২৬ সালের এক রৌদ্রময় দুপুরে পরিবার পরিজনের মায়া কাটিয়ে তাদের ভ্রমণযাত্রা শুরু করেন।
তাদের যাত্রা শুরুর আগেই এই প্রথম কোনো ভারতীয় ভূপর্যটক দল বিশ্বভ্রমণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে পথে নামবে, খবরটি ছড়িয়ে গিয়েছিলো। ভূপর্যটক এ দলের মাধ্যমে বাঙালি ভীতু, ঘরকুনো দুর্নাম ঘোচানোর আশা সেদিন বাঙালির মনে বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিলো। চিরকাল বিদেশিদের এরকম সাহসের পরিচয় দিতে দেখেছে সবাই। কিন্তু এই প্রথম বাঙালি বা তৎকালীন ভারতীয় কোনো দল এরকম সাহসের পরিচয় দিচ্ছে, এ চিন্তা থেকে সবাই একান্তভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে এ দলটিকে দেখার উদ্দেশ্যে ও পারলে করমর্দন করে তাদেরকে করমর্দন করে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে রাস্তায় বেরিয়ে এসে টাউন হলকে পরিণত করেছিল জনসমুদ্রে।
ভারতবর্ষের ভেতরে তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা দারুণ ছিলো। পথের বেশিরভাগ জায়গায়ই তৎকালীন রাজা রাজরা ও অনেক গুণী ব্যক্তির দাওয়াত পেয়েছেন। গোয়ালিয়রে পৌঁছে সেখানকার রাজার আতিথ্য গ্রহণ করলে নাবালক রাজা তাদের সঙ্গে বিশ্বভ্রমণে বেরোবার জেদ ধরে বসেছিলেন। ভারতবর্ষের নানা জায়গা ভ্রমণের পর ‘অতিরিক্ত আরামে’ অতিষ্ঠ হয়ে তারা মরুভূমির ভেতর দিয়ে করাচির বন্দরে যান জাহাজে করে ভারতবর্ষ পার হয়ে ইরান বা ইরাকে পৌঁছাবার জন্য।
বি আই কোম্পানির এক জাহাজে তারা খাবার নেওয়া ও গন্তব্যে পৌঁছানোর পরিবর্তে জাহাজ সাফ ও খাবার বণ্টন দেখাশোনা করার শর্তে চেপে বসে বসরা বন্দরে পৌঁছান। দেশ থেকে তাদের ভ্রমণে উৎসাহ দিতে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছিলো। সে কমিটি থেকে তাদেরকে টাকা পাঠানোর কথা ছিলো। কিন্তু বারবার চিঠি পাঠিয়েও তারা টাকা পাচ্ছিলেন না। তবে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেননি। বসরা থেকে তারা বাগদাদের দিকে রওনা করেন। সাইকেল সাথে নিয়ে মরুভূমির দীর্ঘ কষ্টকর পথ ও বারবার ডাকাত দলের হাতে পড়ার আশংকা থেকে পার হতে গিয়ে ততদিনে তাদের মানসিক দৃঢ়তা অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। পথে নানারকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে তারা বেশ অভিজ্ঞও হয়ে গিয়েছিলেন।
বসরা থেকে তুরস্ক, সেখান থেকে ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওনা করে বুলগেরিয়া হয়ে হাঙ্গেরিতে পৌঁছান তারা। পথে হেরম্যান নামে এক জার্মান যুবকের সাথে দেখা হয়। কনস্টান্টিনোপল, অর্থাৎ ইস্তাম্বুল পর্যন্ত তারা একসাথে পথ চলেন। পথিমধ্যে হেরম্যান বিমল মুখার্জিকে জার্মান ভাষা শিখতে সহায়তা করেন। সময় ও অর্থাভাবে প্রায়ই তারা খিদে মেটাতেন আঙুর, এক টুকরো রুটি ও গরম জলে মেশানো কোকো দিয়ে। হাঙ্গেরিতে সম্মুখীন হন নতুন এক অভিজ্ঞতার, ‘তুষারপাত’। প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে, সাথে পর্যাপ্ত গরম জামাকাপড় না থাকার পরও তারা পথচলা অব্যাহত রাখেন। হাঙ্গেরি থেকে ভিয়েনা হয়ে অস্ট্রিয়া ও সেখান থেকে জার্মানিতে পৌঁছান। জার্মানিতে এসে দেখা পান হিটলারের। হিটলার তখনও বড় নেতা হয়ে ওঠেননি।
দেশ থেকে যে টাকা পাঠানোর কথা ছিলো, তা তারা তখনও পাননি। দীর্ঘদিন বঞ্চিত হয়ে সে টাকার আশা তারা ছেড়ে দেন। জার্মানিতে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন তারা। বার্লিন থেকে মণীন্দ্র ঘোষ তাদের পর্যটক দল থেকে আলাদা হয়ে যান। জার্মানিতে বেশ কিছু রেডিও, সেমিনারে বিমল মুখার্জি তাদের দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। জার্মানিতে তাদের আনালিসে নামক এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয় এবং তারা বেশ কিছুদিন আনালিসের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন।
জার্মানি থেকে Zolle Meppel এর পথ ধরে তারা হল্যান্ডে প্রবেশ করেন। হল্যান্ড থেকে জাহাজে করে ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ড থেকে অশোক ও আনন্দ রিও ডি জেনেরিও তে স্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। তাদের এ চলে যাওয়া সম্পর্কে বিমল মুখার্জি বলেছেন,
“আমার জীবনের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো এভাবে। তিনটি বীর বঙ্গসন্তান অ্যাডভেঞ্চারের তাগিদে আমার সঙ্গে একসঙ্গে রওনা হয়েছিলো দু’বছর আগে। তারা এখন গেলেম কে কোথায়, এই অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি। প্রাণে অফুরন্ত আশা, দেহে অসীম শক্তিও ছিলো। সবই যেন নিমেষে আমাকে ছেড়ে চলে গেল।”
হাতে অর্থের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিমল মুখার্জি লন্ডনে মিডল্যান্ড ব্যাঙ্কে চাকরি নেন। তাছাড়া তার ইচ্ছা ছিলো রয়্যাল সোসাইটির হলে তার তোলা সব ছবি দিয়ে একটা প্রদর্শনী করার। লন্ডন ও কলকাতার তুলনায় তিনি তার বইয়ে বর্ণনা করেন,
“লন্ডন শহর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত অন্তত ৬০ মাইল, কোথাও কোথাও তার চেয়ে বেশি।
আগে লন্ডনবাসীদের ককনী বলা হতো, যারা সেইন্ট পল গির্জার ঘণ্টাধ্বনি এলাকার মধ্যে জন্ম নিতো। ক্রমে ক্রমে যত সাবার্বান বা শহরতলী আছে, তারা লন্ডনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে নিল। টেমস নদীর দুই পারের সমস্ত লোক এখন লন্ডনবাসী।
কলকাতার তেমন সৌভাগ্য হয়নি। গঙ্গার ওপারে অন্য শহর হাওড়া। লন্ডনে দশ মিলিয়ন লোকের বাস। কলকাতায় মাত্র চার মিলিয়ন, এখন প্রায় সাত আট মিলিয়ন। লন্ডন এক হিসাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। ভারতবর্ষ সহ পৃথিবী জুড়ে বহু দেশ এখান থেকে শাসিত হয়।”
লন্ডনে বিমল মুখার্জির প্রচুর বন্ধু হয়। এর মাঝে ভারতীয় যেমন ছিল, অন্যান্য দেশীরাও ছিল। এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন মিস চ্যানিং, স্যার উইলিয়াম রদেনস্টাইন, যিনি ইংল্যান্ডের বিদ্বান সমাজে রবীন্দ্রনাথের লেখা ও কবিতা পরিচিত করেন এবং পৃথিবী বিখ্যাত ভারতীয় নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর। উদয় শঙ্কর তখন ছিলেন উইলিয়াম রদেনস্টাইনের ছাত্র। পাভলোভা উদয়ের নাচ দেখে রদেনস্টাইনের কাছ থেকে উদয়কে চেয়ে নেন ও পরবর্তী দু’বছর একসঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্টেজে নাচ করেন।
এপ্রিলের শেষের দিকে তিনি তার এক বিশেষ বন্ধু চন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। উল্লেখ্য যে, চন্দ্রনাথ ভারতবর্ষ থেকেই বিমলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তারা একসঙ্গে সাইকেলে করে লম্বা লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছেন এবং ‘চনু’ বা চন্দ্রনাথ তার এই ভ্রমণের কথা জানতে পেরে চিঠি লিখে বিমল মুখার্জিকে এই বিশ্বভ্রমণে লন্ডন পৌঁছানো পর্যন্ত খুব উৎসাহ প্রদান করেছেন।
ফিচার ইমেজ: sarkarpinaki.blogspot.com
তথ্যসূত্র- বই: দুচাকায় দুনিয়া; লেখক: বিমল মুখার্জি