শ্যাম সিংহ রায়: মধ্যরাতের জ্যোৎস্নায় রাঙা বিদ্রোহী কবিতা

কুসংস্কার এমন একটি বিষ, যা তিলে তিলে নিঃশেষ করে সমাজকে। কথিত উচ্চস্তরের মানুষের কাছে হেনস্তা হতে হয় নিচুস্তরের মানুষদের। জাত, শ্রেণিবৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হয় তারা। ক্ষুধা লাগলেও ছুঁতে পারবে না ফসল, পিপাসা পেলেও নেই পানি পানের অধিকার। যারা এই উঁচু-নিচু শ্রেণি বিভাজনের হর্তাকর্তা, সমাজে তাদের সম্মানের চোখে দেখা হয়। কেউ শুদ্ধ ব্রাহ্মণ, কেউ ঠাকুর-পুরোহিত হয়ে ধর্মের দীক্ষা দিয়ে বেড়ান। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জাত বিভাজন, শাসন-শোষণের ইতিহাস বহু পুরনো। ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত শ্যাম সিংহ রায় চলচ্চিত্রে পুরনো সেই কাসুন্দিই ঘাঁটা হয়েছে নতুন করে।  

শ্যাম সিংহ রায়; image source: book my show

সহকারি পরিচালকের ফোন কলে ঘুম ভাঙে নির্মাতা ভাসুদেব ঘণ্টার (ন্যানি)। নিজেকে নির্মাতা হিসেবে দাবি করলেও, কেউ যখন জানতে চায় পরিচালিত সিনেমা সম্পর্কে— ভাসু তখন নামের আগে লাগায় আপকামিং! সহকারির অভিযোগ, যে কফি শপে আজকের শুটিং শিডিউল, সেখানকার মালিক বাগড়া দিচ্ছেন। ভাসু আসেন। মালিককে রীতিমতো কর্মী বানিয়ে দেন। এরপর লেগে পড়েন কাজে। সিনেমার শুরুর দৃশ্যে কমিক সেন্স ছিল চমৎকার। বুফে খেতে গিয়ে মেইন ডিশ শুরুর আগে যেমন স্টার্টার দেওয়া হয়, এখানে শুরুর দৃশ্যকে সেভাবে দেখা যায় অনায়াসে।

ভাসু একটি শর্টফিল্ম বানাবে। যার জন্য হিরোইন খুঁজছে। দুই মাস ধরে অডিশনের পর অডিশন নিয়েও কাঙ্খিত রমণীর দেখা পাচ্ছে না। কফি শপে বসা তরুণী কীর্তির (কৃতি শেঠি) দিকে চোখ পড়ে হঠাৎ। অনুনয়-বিনয় করে সাইকোলজির ছাত্রী কীর্তিকে রাজি করায় অভিনয়ে। শর্টফিল্ম শেষ হয়। দর্শকের ভালো সাড়া মেলে। চলচ্চিত্র প্রযোজকের সাথে দেখা করে প্রথম সিনেমার প্রজেক্ট ফাইনাল করে। সেটি তৈরি হয়। সফলতা পায়। ক্লাইম্যাক্স চোখে জল আনায় দর্শকের। চারদিকে এত প্রশংসা, হৈচৈ-এ মুগ্ধ ভাসু ভাবতে পারে না তার জীবনের গল্পে তখনও ক্লাইম্যাক্স বাকি! নতুন একটি চলচ্চিত্রের ঘোষণা দিতে যাবেন, সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ, তিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দী পুরনো একাধিক বই থেকে গল্প টুকেছেন। মোদ্দাকথা, কপিরাইট আইনে মামলা ঠুকেছে সেসব বইয়ের প্রকাশনী সংস্থা এস. আর. পাবলিকেশন্স! আরও চমকপ্রদ ব্যাপার, বইগুলো তেলেগুর পাশাপাশি বাংলা ভাষায় রচিত। অথচ ভাসুদেব বাংলা জানে না!

কীর্তির হাত ধরে সাফল্যের পথে প্রথম পদার্পন ভাসু’র। ততদিনে গড়ে ওঠে সখ্যতা; image source: times of india

ভাসুর উকিল (ম্যাডোনা সেবাস্তিয়ান) তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অভিযোগ উড়িয়ে দেয়। তার ভাষ্য, সিনেমার চিত্রনাট্য, ক্লাইম্যাক্স সবই নিজের লেখা। সে জানেও না, এহেন অভিযোগের ভিত্তি কী!

‘আমরা অনেক সময় এমন অনেক কিছু জানি না, যা প্রকাশিত হলে জীবনের গল্প অন্যরকম হতে পারত। এমন অনেক কিছুকেই তাচ্ছিল্যের ঢংয়ে এড়িয়ে চলি, যা হয়তো ভীষণ অর্থপূর্ণ।’

ভাসুর বেলাতেই যেমন! কোনো কিছু নিয়ে চাপে থাকলে, উত্তেজনা বেড়ে গেলে তার কান বেয়ে রক্ত গড়ায়। একবার, দু’বার, বেশ ক’বার। অথচ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। যে সময়টায় কান গড়িয়ে রক্তের ফোঁটা নাগাল পায় কাঁধের, এর আগে-পরের ভাসু সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই ব্যক্তিতে পরিণত হয়। নির্মাতা ভাসু সাধারণ ছেলে, কিন্তু তখন তার মধ্যে অনন্য এক সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ততদিনে কীর্তির সাথে ভাসুর সম্পর্ক গভীর হয়। ভাসুর বন্ধু ও কীর্তি, উভয়ের মনে শঙ্কা জাগে কান বেয়ে রক্ত পড়াটা অমূলক নয়। দ্বারস্থ হন বিশেষজ্ঞের। ভাসুকে কাউন্সেলিংয়ে নেওয়া হলে বেরিয়ে আসে সত্য। যার বই থেকে গল্প চুরির অভিযোগ, সেই লেখক ও এস. আর. পাবলিকেশন্সের প্রতিষ্ঠাতা শ্যাম সিংহ রায় আর ভাসু একজনই!

ভাসুদেব হঠাৎ হঠাৎ বিপ্লবী অবতারে ধরা দেয়, যা সে নিজেও উপলব্ধি করতে পারে না; image source: Shyam Singha Roy

শ্যাম সিংহ রায় সিনেমায় দুই জন্মের কাহিনী বলা হবে, তা পরিচালক জানান দিয়েছেন ট্রেইলারে। কিন্তু জানাননি, কতটা চমৎকার প্রদর্শনী তোলা রেখেছেন দর্শকের জন্য। ভাসুদেব, যে কিনা আধুনিক যুগের ছেলে। আধুনিকতার সর্বোচ্চ ছোঁয়া লেগেছে যার গায়ে। দামি গাড়ি, বাড়ি, সিনেমা বানানোর স্বপ্ন, মেধার সংমিশ্রণে গড়া দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বিভোর সুদর্শন তরুণ। অন্যদিকে, সত্তরের দশকের শ্যাম। যুদ্ধে যাবার চেয়ে কলম ধরায় আগ্রহ অঢেল। কলম যার দ্রোহের হাতিয়ার।

একটি বুলেট কেবল একজনকেই মারতে পারে, কলম সেখানে সংঘবদ্ধ করতে পারে লক্ষ মানুষকে!’

শ্যাম ছিলেন জাত, ধর্ম, শ্রেণিবৈষম্যের ঊর্ধ্বে। তাই ভালোবেসে ফেলেন দেবদাসী রোজি (সাঁই পল্লবী)-কে। রোজিদের বাইরে বের হওয়া বারণ। তারা উৎসবে নাচবে, মনোরঞ্জন করবে, ফের অঘোষিত জেলে বন্দী থাকবে। শেকল ভাঙার নেশায় মত্ত শ্যাম রোজির জন্য উন্মুখ! 

তেজস্বী শ্যাম সিংহ রায়, অন্যায়কে যিনি প্রশ্রয় দেন না; image source: the indian express

শ্যাম সিংহ রায় চলচ্চিত্রটিকে পিরিয়ডিক ড্রামা জনরায় তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির এযাবৎকালের অন্যতম সেরা নির্মাণ বললে একরত্তি বেশি বলা হবে না। কী নিখুঁত নির্মাণ! কী অসাধারণ সেট ডিজাইন! কোথাও কোনো কমতি নেই। সিনেমা তখনই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, নিজেই একটি মাইলফলক স্থাপন করে যখন ছোট ছোট বিষয়গুলোও বৈষয়িক হতে পারে। ছবির চিত্রনাট্যের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যাবে, প্রতিটি চরিত্রকে খুব সুন্দরভাবে তৈরি করেছেন সত্যদেব জাঙা। শব্দের সুনিপুণ বুনটে রেশমি সুতো আর সুঁই তুলে দিয়েছেন পরিচালক রাহুল সংকীর্তনের হাতে, তাতে শীতের উষ্ণ চাদর বুনেছেন রাহুল। কিংবা নকশী কাঁথার সাথেও তুলনা চলে। সেখানে ন্যানি পুরো জমিন হলে; সেই জমিনে সাঁই পল্লবী, মুরালি শর্মা, কৃতি শেঠিরা নকশা করা ফুলরূপে সুবাস ছড়িয়েছেন। আলাদা করে বলতে হবে যিশু সেনগুপ্তের কথা। অল্প খানিকটা সময়ের উপস্থিতিতে গল্পটাই পাল্টে দেন তিনি।

স্বল্প সময়েই দাগ কেটেছেন যিশু সেনগুপ্ত; Image Source: koimoi

সিনেমায় সংলাপ যত দৃঢ়, দৃশ্য তত প্রগাঢ় হয়। তাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করে সিনেমাটোগ্রাফি। অবশ্য, সিনেমাটোগ্রাফিকে ক্যানভাসও বলা চলে। গোটা সিনেমার আপাদমস্তক দৃশ্যাবলিতে দর্শক আত্মোপলব্ধি করতে পারে সিনেমাটোগ্রাফারের দক্ষতায়! শ্যাম সিংহ রায়ে ‘শানু জন ভারুগেসে’ এতটা অনবদ্য কাজ করেছে, চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। অমিতাভ বচ্চন-ফারহানের ‘ওয়াজির’, কমল হাসানের ‘ভিশ্বরূপাম’, আয়ুষ্মান খুরানার ‘বাঁধাই হো’র কাজ করা শানু জানেন, কখন কোথায় কী করতে হবে! সংগীতের দিকে কানজোড়া তাক করলে বলতে হবে, সিনেমার সাথে খাপে খাপ। তেলেগু ফিল্মপাড়ার সুপরিচিত মিউজিক কম্পোজার মিকি মেয়ার হতাশ করবেন না, তা-ও এত দুর্দান্ত সেট আপে সেটি অনুমেয়। মিকির সুরের মূর্ছনার তালে সাঁই পল্লবীর নৃত্য, দর্শকদের ভিজিয়ে দেবে নদীর বুকে জেগে ওঠা মধ্যরাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায়।

ন্যানি আর সাঁই পল্লবীর রসায়ন ছিল আউট অব দ্য বক্স; image source: pinkvilla

চলচ্চিত্রটি একসঙ্গে দুটো আলাদা প্রজন্মকে তুলে ধরেছে পর্দায়। পূর্বজন্মের অংশে আঙুল দিয়ে সামাজিক অব্যবস্থাপনা, কুসংস্কার ফুটিয়ে তুলেছে। সেটিকেই নতুন প্রজন্মের আনাড়ি নির্মাতার হাত ধরে ফের ফুটিয়ে তুলেছেন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। রাহুল সংকীর্তন উপজীব্য করেছেন ভালোবাসাকে। কারণ, পৃথিবীতে ভালোবাসাই একমাত্র কবিতা যা হাজারবার পাঠেও ক্লিশে হয় না, বরং পরিণত হয় নিখাঁদ সোনায়। ভাবগাম্ভীর্য ও অঙ্গসাজের মায়াবী উপস্থাপনের ফলে শ্যাম সিংহ রায় চলচ্চিত্রকে নির্দ্বিধায় কবিতা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে।

Language: Bangla

Topic:  This article is a review on the movie Shyam Singha Roy. All the necessary links are hhyperlinked in the article. 

Featured Image: IMDb

Related Articles

Exit mobile version