আমি নিশ্চিত, এক্ষুণি আপনার মনের গ্রামোফোনে বাজতে শুরু করলো একটি চিরচেনা সুর। সেই সুরের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে, হয়তো খানিকটা আনমনে, আপনি গুনগুনিয়ে উঠলেন:
“এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?”
আর নিজেকে নিমেষেই হারিয়ে ফেললেন সপ্তপদীর সেই স্বপ্নমাখা রাজ্যে- আপনার প্রিয় মানুষটির সঙ্গে! এমনই মহিমা ‘সপ্তপদী’ নামের, এমনই ক্ষমতা এই ফিচার ফটোগ্রাফের!
‘সপ্তপদী’ নিঃসন্দেহে একটি রোমান্টিক ঘরানার ছবি। যেখানে আপনি একজোড়া স্ত্রী-পুরুষের কাছে আসার চিত্র দেখতে পাবেন, দেখতে পাবেন দূরে সরে যাবার দৃশ্য। আর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবেন তাদের মনোজগতের টানাপোড়েন। শুধু উত্তম-সুচিত্রা কেন? ছোট-বড় প্রায় সবগুলো চরিত্রই আপনার মস্তিষ্কের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দেবে চিন্তার বীজাণু, গড়ে তুলবে তাদের স্বতন্ত্র বলয়। তবে কি শুধুই প্রেম, নিছকই মিলন-বিরহের ঘনঘটা? না! কেবল প্রেম নয়, বরং প্রেমের খোলসে মানবতার বাণী, ঈশ্বর বিশ্বাসের স্বস্তি আর সত্যনিষ্ঠার অপূর্ব আখ্যান! এই সবকিছুই উপস্থাপিত হয়েছে এমন এক দুর্দান্ত, অথচ সরল সিনেমাটিক স্টাইলে, যা বাংলা অথবা ভারতীয় কেন, বৈশ্বিক চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত দুর্লভ।
ছবিটির শুরুতে আপনি পৌঁছে যাবেন ১৯৪৩ সালে, একেবারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায়। গোটা বাংলাদেশে তখন পড়েছে মহাযুদ্ধের করাল ছায়া। অনাহারে, অচিকিৎসায় জনজীবন হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ। ইঙ্গ-মার্কিন সেনাদের তাণ্ডবে নিরীহ-অনগ্রসর জনগোষ্ঠী তখন তটস্থ। সেই বিভীষিকার মাঝে আপনি দেখা পাবেন সৌম্যদর্শন রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামীর (উত্তম কুমার)। সাইকেলে চেপে সমস্ত দিন সে দুঃস্থ-অবহেলিত মানুষের সেবা করে। তার আশ্রমে বিনামূল্যে চিকিৎসা পায় হতভাগ্য কুষ্ঠরোগীরা। এই অসহায় মানুষগুলোই তার ঈশ্বর। এদের সেবার মাঝেই সে খুঁজে পায় জীবনের গূঢ়তম আনন্দ। এলাকার লোকেরাও তাকে যারপরনাই সম্মান করে, সম্বোধন করে ‘বাবাসাহেব’ বলে।
এক সন্ধ্যায় কৃষ্ণস্বামীর আশ্রমে আনা হয় একজন নারী মিলিটারি অফিসারকে। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে সে অচেতন। তাকে চিকিৎসা করতে গিয়ে চমকে ওঠেন রেভারেন্ড। তার সমস্ত চেতনা পিছিয়ে যায় সুদূর অতীতে, যখন সে মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র, যখন তার নাম ছিল কৃষ্ণেন্দু। রিনা ব্রাউনের (সুচিত্রা সেন) সাথে সেই কলেজ জীবনেই তার প্রথম পরিচয়। স্পষ্ট মনে করতে পারছে কৃষ্ণস্বামী, সেদিনের সেই ফুটবল ম্যাচ। বাঙালি ছেলেরা খেলছে খালি পায়ে আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পায়ে দামি বুট। সেই বুটের লাথি আর কনুইয়ের গুঁতোয় নেটিভ খেলোয়াড়দের নাজেহাল অবস্থা। সবচেয়ে বেশি মারমুখী ছিল জন ক্লেটন, রিনার বন্ধু। ওকে সেদিন উচিত শিক্ষাই দিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। সেজন্যই তো তেড়ে এসেছিল রিনা, গাল পেড়েছিল ‘হিদেন’ বলে, বলেছিল, গড উইল পানিশ ইউ! ভগবান, ভগবান তোমায় শাস্তি দেবেন!”
তারপর কত স্মৃতি, কত ঘটনা! ক্লেটন সেজে রিনাকে বোকা বানানো, মিক্সড্ টেনিসে নিজে হেরে ওকে জেতানো আর কলেজ ফাংশনে রিনার সাথে অভিনয় করা- ওথেলো কৃষ্ণেন্দু, আর রিনা ডেসডিমোনা। তারপর মায়ের মৃত্যু, রিনার সাথে ঘনিষ্ঠতা, ওর বাবার শর্তে রাজি হয়ে ধর্ম পরিবর্তন করা। অবশেষে, বজ্রপাতের মতো আকস্মিক ও নিদারুণ আঘাত, রিনারই তরফ থেকে! হ্যাঁ, রিনা তাকে প্রত্যাখ্যান করে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। তারপর পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। সেদিনের সেই ধর্মনিষ্ঠ খ্রিস্টান রিনা ব্রাউন আজ উচ্ছৃঙ্খল, মদ্যপ আর চরম নাস্তিক মিলিটারি অফিসার।
রিনার এই পরিবর্তনের কথা কৃষ্ণস্বামীর কাছেও ছিল অজ্ঞাত। কিন্তু কেন? কেন রিনা কৃষ্ণেন্দুকে ফিরিয়ে দিলো? কোন বাস্তবতাই বা তাকে ঠেলে দিল মাদক, অবিশ্বাস আর উদ্দামতার অন্ধকারে? আর ভবিষ্যতেই বা কোন চমক অপেক্ষা করছে রিনা ব্রাউনের জন্যে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর মিলবে ১৯৬১-তে মুক্তি পাওয়া ‘সপ্তপদী’ সিনেমাটি দেখলে।
পরিচালক অজয় কর সিনেমাটি নির্মাণ করেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে। কিন্তু যারা বইটি পড়েছেন, তাদেরও সেলুলয়েডের ‘সপ্তপদী’ সমানে শিহরিত করার ক্ষমতা রাখে- এমনই মুন্সিয়ানায় ঘটনাক্রম সাজিয়ছেন চিত্রনাট্যকার বিনয় চ্যাটার্জি। হ্যাঁ! সিনেমাটিক লিবার্টি যাকে বলে, তা নেওয়া হয়েছে। প্রধান কিছু ঘটনা থেকে শুরু করে করে খুঁটিনাটি অনেক ব্যাপারেই আনা হয়েছে পরিবর্তন। কিন্তু মূল গল্পের মাধুর্য তাতে কিছুমাত্র ম্লান হয়নি। আর শুধুই কি স্ক্রিপ্ট এবং পরিচালনা? রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামী ও রিনা ব্রাউন আপনাকে স্তম্ভিত করবে। এমনই নৈপুণ্যের সাথে কাজ করেছেন মেকাপ আর্টিস্ট অনন্ত দাস। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর সুজি মিলারের কণ্ঠে প্রত্যেকটি গান হয়ে উঠেছে অতুলনীয়, উপভোগ্য। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জাদুকরী কলম সেসব গানকে করেছে কালজয়ী। তাছাড়া সুদক্ষ সিনেমাটোগ্রাফার কানাই দে’র কল্যাণে গোটা সিনেমা জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় আলো-ছায়ার অসাধারণ সমন্বয় আর অপূর্ব সব ফ্রেম।
প্লটের অভিনবত্ব তো আছেই, তার পাশাপাশি আছে একঝাঁক মেধাবী অভিনয় শিল্পীর অসাধারণ পেশাদারি দক্ষতা। একদিকে সুচিত্রা সেনের দৃঢ় আর দৃপ্ত পদক্ষেপ, আবেদনময়ী অভিব্যক্তি; অন্যদিকে উত্তম কুমারের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস আর মানানসই গাম্ভীর্য। শুধু এ দুজনই নয়, কৃষ্ণেন্দুর বাবার চরিত্রে ছবি বিশ্বাসের অভিনয় মুভিতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। তাছাড়া ছায়াদেবী, পদ্মাদেবী, তরুণ কুমার প্রত্যেকেই নিজ নিজ চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছেন স্বীয় মহিমায়। আর ওথেলো নাট্যাংশে উত্তম সুচিত্রার নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন উৎপল দত্ত ও জেনিফার কেন্ডাল। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও আপনি বুঝতে পারবেন না যে ওগুলো ওদের নিজেদের গলা নয়। এছাড়া মি. ব্রাউন ও জন ক্লেটন বাদেও ‘মেরি-গো-রাউন্ড’ গানে বেশ কিছু ইংরেজ অভিনেতার দেখা মেলে।
শুরুতেই বলেছি, ‘সপ্তপদী’-তে মানবতাবোধ ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার পরিচয় কৃষ্ণস্বামীর এই সংলাপটির মধ্যে খুব ভালোভাবেই পাওয়া যায়:
“মানুষের মধ্যে যে জীবন, সে যেখান থেকেই সৃষ্টি হোক- সেখানে ব্রাহ্মণ নেই, চণ্ডাল নেই, হিদেন নেই। সবার মধ্যে, সমান মহিমায় ভগবান আত্মপ্রকাশের জন্য ব্যাকুল।”
আরো একটি লক্ষণীয় দিক, যেটি দর্শকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে, সেটি হলো রিনা ও কৃষ্ণেন্দুর চারিত্রিক পরিবর্তন, তাদের রূপান্তরিত জীবনদর্শন। একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান থেকে হয়ে ওঠে কট্টর নাস্তিক। অন্যজন সংশয়বাদী থেকে ধর্মনিষ্ঠ ঋষি। তাদের এই পরিবর্তিত ব্যক্তিত্বের সংঘাত আপনাকে আরো একবার নিজের বিশ্বাসের দৃঢ়তা যাচাই করতে বাধ্য করবে- তা আপনি যে ধর্ম বা মতের অনুসারীই হোন না কেন। এখানেই ‘সপ্তপদী’র সার্বজনীনতা ও সবথেকে বড় স্বার্থকতা।
এই সিনেমায় প্রেমকে দেখতে পাবেন অত্যন্ত বাস্তবসম্মত রূপে। আর বাস্তবসম্মত বলেই হয়তো এতটা আকর্ষণীয়, এতটা মোহনীয়। প্রথম দেখাতেই প্রেম নয়, বরং ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা সখ্যতা, তার থেকে মুগ্ধতা- অবশেষে প্রেম। নিখাদ, খাঁটি প্রেম! যে প্রেমের মাধুর্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাঙালিকে সমানে সম্মোহিত করে চলেছে। শিখিয়ে চলেছে, “সত্যিকারের ভালোবাসা সর্বনাশকে ভয় করে না।”
‘সপ্তপদী’-তে অসামান্য অভিনয়ের জন্য উত্তম কুমার ১৯৬২ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে বি. এফ. জে. এওয়ার্ডে ভূষিত হন। ঠিক তার পরের বছর মস্কো আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারটি পান সুচিত্রা সেন, রিনা ব্রাউনের চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি ভারতীয় অভিনেত্রীদের মধ্যে প্রথম এই সম্মানে ভূষিতা হন।
লেখাটি শেষ করার আগে আপনাকে একটা ঠিকানা দিতে চাই। একটা রেস্তোরাঁর ঠিকানা। যেখানকার উপাদেয় পানাহার যেমন আপনার রসনাকে তৃপ্ত করবে, তেমনই কর্ণযুগলের তৃপ্তির ভার নেবে উত্তম কুমার অভিনীত ছবিগুলোর রোমান্টিক সব গান। দক্ষিণ কলকাতার পূর্ণদাস রোডের এই রেস্তোরাঁটির নাম- ‘সপ্তপদী’, শেফ রঞ্জন বিশ্বাসের শ্রদ্ধার্ঘ্য, সিনেমাটির প্রতি।