‘পয়ার ও লাচাড়ি’ ঘুরে ‘নুসরাত’ আর ‘বিবিপরী’

‘পয়ার ও লাচাড়ি’

সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক প্রশান্ত মৃধার নতুন উপন্যাস ‘পয়ার ও লাচাড়ি’। প্রশান্ত মৃধাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। খ্যাতনামা এই সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকের গল্পের বর্ণনা, প্রান্তিক জীবনকে দেখার অন্তর্দৃষ্টি বরাবরই তার ভাষাকে করেছে বর্ণাঢ্য। দিয়েছে বহুমুখী মাত্রা। তার এবারের গল্প দ্বিমুখী, ত্রিমুখী প্রেম এবং এই অনুভূতির নানা দিক নিয়ে মানুষের ভেতরে প্রোথিত থাকা দ্বন্দ্ব নিয়ে। 

‘পয়ার ও লাচাড়ি’র গল্প মূলত শাহিনার। আরম্ভের পরে মনে হয় নীলার। কিন্তু গল্পটা শাহিনার। আবার সেই বাঁক ঘুরে, শেষটা নীলাতে এসেই হয়। শাহিনা, স্বামীর নিপীড়ন আর দমনমূলক আচরণের কারণেই সেদিন হিল্লোলের দিকে ঝুঁকেছিল। তাদের কারোরই কোনো দোষ ছিল না। শাহিনা তা নিয়ে অনুশোচনাও অনুভব করে না। তবে সে জানতো, চাইলেই বাধা দেওয়া যেত। কিন্তু তা সে চায়নি। কারণ… সেই কারণেই যে লুকিয়ে আছে সম্পর্কের নানা দিক, ভালোবাসার নানা পিঠ, আর মনের নানা জটিলতা। ওদিকে, নীলা অমনই আরেক নিপীড়িত নারী। স্বামী থেকে আলাদা হয়ে মেয়ে নিয়ে সংগ্রাম করছে একা। নীলা শাহিনার সম্পর্ককে দেখে অনৈতিক হিসেবে। কিন্তু ধীরে ধীরে নীলা বুঝতে পারে শাহিনার অবস্থান, এবং নীলাও খুঁজে পায় সম্পর্কের নতুন আরেক বাঁক। 

উপন্যাসের গল্প খুবই সাধারণ। সম্পর্কের এমন গতিপথ আর তার অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে লেখা গল্পের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তবে, আলোচ্য উপন্যাসে ‘নীলা’ চরিত্রকে প্রথমে যে অ্যাবসল্যুট অবস্থানে রাখা হয়েছে এবং পরবর্তীতে যে দোলাচল আর নতুন আহ্বানে নীলা এগিয়ে যায়, সেটায় একটা মডার্ন অ্যাপ্রোচ আছে। এবং এই গোটা গ্যামাটই উপস্থাপন করে, ভালোবাসা সীমা/পরিসীমা মেনে তৈরি হয় না, আর সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের গতিপথ বদলায়।

Image Source: Scrapbooks

এই পরিণত মানস ও মনস্তত্ত্বের দিকটাই উপন্যাসে এক অন্যরকম কমনীয়তা যোগ করে। আর প্রশান্ত মৃধার ভাষা এবং বয়ানভঙ্গীই এমন যে, সবচেয়ে সাধারণ গল্পেই একটা ভিন্ন মাত্রা অবস্থান করে। একটা অন্তর্জাত ভাব আছে তার গদ্যে। তার গল্পের গতি সহজ-সাবলীল। তার গদ্যভাষায় নানা রকম কারিকুরিই আছে, কিন্তু সেসব এতটা নুন্যোক্ত যে, সহসা চোখে পড়ে না। এবং এতেই প্রশান্ত মৃধার মুনশিয়ানা। সুডৌল, অভিনব ডিটেলের গদ্য লিখবার দক্ষতা আছে তার। এবং সেটাই তার ভাষা আর বয়ানকে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন করেছে, বহুমুখী করেছে। ঠিক যেমনটার পরিচায়ক এই উপন্যাস।

‘নুসরাত’ 

নামটি দেখে, কৌতূহলী হয়েই বইটা হাতে নেওয়া। এবং যেমনটা ভেবেছিলাম, মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের ঘটনা নিয়েই উপন্যাস। শিক্ষক দ্বারা যৌন হেনস্তার শিকার হওয়া, মামলা, তাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা এবং চেষ্টাতে সফলতা; এই নিয়েই উপন্যাস। নুসরাতকে অন্যায়ের প্রতিবাদী স্বর বানানো হয়েছে, এই সময়ের মুভমেন্ট ধরা হয়েছে। সেই সবই ঠিক আছে। কিন্তু আদতে, উপন্যাস যে লেখা হলো, সেটা ভালো হয়েছে কি? না। কোনো প্রয়োজন বা কোনো নতুন বক্তব্য কিংবা হোক পুরাতন, কিন্তু শক্তিশালী বক্তব্য কি তৈরি করতে পেরেছে? না! আসলেই না। 

এই উপন্যাস, ঘটনায়/গল্পে নতুন কিছুই যোগ করেনি। যা আছে, তা সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলোর আর্টিকেল থেকেই জানা যায়। ১৪০ পাতার একটা উপন্যাস, অথচ কী পলকা এর গল্পের বুনন! নুসরাতকে নিয়ে উপন্যাস। অথচ সেখানে নুসরাতই নেই! শুধুমাত্র মুখে মুখে নাম উচ্চারিত হওয়া আর ওকে ঘিরে ঘটনার পরবর্তী মুভমেন্ট ছাড়া। প্রথম কিছু পাতায় শিক্ষক সিরাজুল ইসলামের ভেতরকার লালসার বর্ণনা, তারপর নুসরাতকে ডেকে হয়রানির ঘটনা, এরপর সেখানে নুসরাতের অপমান বোধ করা এবং পরিবারের সহযোগিতায় প্রতিবাদী হয়ে মামলা করার ঘটনা। তারপর অনেকক্ষণ ধরে সিরাজুল ইসলাম ও ধর্মীয় লেবাসে ক্ষমতা অপব্যবহার করার চেষ্টা, এলাকার রাজনৈতিক প্রতিনিধির সহযোগীতা পাওয়ার গপ্পো চলতে থাকে বেশ অনেকক্ষণ।

তারপর একটু করে আবার নুসরাত আসে। কান্না আর অপমানের গ্লানি মেশানো, তার কিছু মনোজাগতিক কথাবার্তা (যাতে কোনো প্রগাঢ়তা নেই), এবং দুটো চিঠি লেখার ঘটনা। এরপর আবার ঘটনা সিরাজুল ইসলামকেন্দ্রিক হয়। ধর্মীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে বাকিদের প্রভাবিত করে নুসরাতের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর গড়পড়তা ঘটনা ও বর্ণনা। এর মধ্যে মিরাজ নামে এক যুবকের সংযুক্ততা, যে নুসরাতের প্রেম না পেয়ে গড়পড়তা বাঙালী ছেলের মতো প্রতিশোধপরায়ণ হয়, আর এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায়। মাঝে একটু করে এক যুবকের মিথ্যা (ইয়াবা বহন) মামলায় জেলে থাকা ও তার পরিবারের দৌড়ঝাঁপের বিচ্ছিন্ন চিত্র আসে। মূল গল্পের সাথে যেটা বিচ্ছিন্নই থেকেছে, এবং শেষ অব্দি, কোথাও পৌঁছায়নি।

Image Source: Scrapbooks

এবং… এই যদি গল্পের বৃত্ত আর ন্যারেটিভ, সেক্ষেত্রে ‘নুসরাত’ নাম দেওয়াটা যুক্তিসংগত হলো না। ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজে থাকা এই তরুণী, ধর্মীয় শিক্ষক দ্বারাই যখন হেনস্তার শিকার হয়, তখন তার মনস্তত্ত্বে সেটা কতখানি আন্দোলন তোলে, কতখানি বিষণ্নতা তাকে ঘিরে ধরে, কী কী দ্বন্দ্ব; জটিলতা আর ভাঙাগড়ার মুখোমুখি সে নিজের মধ্যেই হয়- সেসবের কোনো বর্ণনাই নেই! তাহলে ভারটা রইলো কোথায়? আর ধর্মকে অস্ত্র বানানোর যে ন্যারেটিভ সিরাজুল ইসলামের মধ্যে আছে এবং ‘নারী’কে শিকার বানিয়ে সমাজ আর মানুষদের সর্বদা তীর চালানোর যে বক্তব্য, তা-ও তো একদমই গড়পড়তা। নতুন কোনো ইনসাইট দেয় না। লেখা দেখে মনে হয়েছে, লেখক যেন খুব সতর্কতার সাথে লিখছেন। মানে সবদিকে যাতে ব্যাল্যান্স হয় আর কী! এ তো গল্পটার জন্যই খুব অপমানজনক। ভয় পেয়ে, সব কূল সমান রেখেই যদি লিখতে হবে, তবে এই গল্প কেন? এ তো খুব সুবিধাবাদী লেখা। শিল্পী-সাহিত্যিকের বক্তব্য হবে দৃঢ়চেতা। তিনি যা বিশ্বাস করেন, তাতে অটল থেকেই তার বক্তব্য আসে। তিনি নির্মোহ, নিরপেক্ষ থাকবেন অবশ্যই। এবং সেটার উপর ভর করেই তার অবস্থান হবে আরো সুদৃঢ়। ছিটেফোঁটাও যার এই উপন্যাসে মেলেনি। 

বড় কথা হলো, এটা ঠিকঠাক উপন্যাস হয়ে উঠতে পারেনি। কাঠামোর কথা বাদ দিলে, লেখক সর্বদা যদি চিন্তায় থাকেন কোনো দিকে তীর্যক কথা বলে ফেললাম না তো(!), কঠোর সত্যটা দেখালাম না তো(!)- এই নিয়ে, তবে উপন্যাস ভালো হবার পথ সেখানেই রুদ্ধ হয়ে যায়। তার লেখায় মনে হয়েছে- উপন্যাস কম, সংবাদপত্রের অতিদীর্ঘ নিবন্ধ পড়ছি। তার কারণ ওই যে; কন্ঠে দৃঢ়তা না থাকা, বক্তব্যে তেজ না থাকা, গদ্যভাষায় ডিটেল না থাকা, ইনসাইট না থাকা।  

এই উপন্যাসের একমাত্র সাহসী ব্যাপার হচ্ছে, লেখক যেভাবে ফ্ল্যাপে লিখেছেন, “বাংলা কথাসাহিত্যে এটি এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস! সময়ের সাথে এর গুরুত্ব অনুভূত হতে থাকবে!” এই দাবিতেই একটা অস্ফুট স্বর পাঠকের মুখ দিয়ে বের হতে পারে!

বিবিপরী

খুবই কনফিউজড ন্যারেটিভের একটি উপন্যাস। না হলো ইতিহাসের বয়ান, সেটা উদ্দেশ্যও না; তবে কোনো মজবুত গল্পের বয়ানও হলো না। একেবারেই উদ্দেশ্যহীন। সুবেদার শায়েস্তা খানের মেয়ে, বিবি পরী। তার গল্প এটি। সেটাও আবার বর্ণিত হয়েছে তার সখা সুফিয়ার জবানীতে। এখানেই তো বইয়ের নামানুযায়ী ন্যারেটিভের অনেক উপাদান হারিয়ে গেল। ন্যারেটিভ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লো। কারণ, সুফিয়া তো আর সর্বক্ষণ বিবি পরীর সাথে থাকেনি। আর উত্তম জবানীতে যে অন্তর্গত রূপটা পাওয়া যায়, তা তো পাওয়া এতে সম্ভব না। সেসব পাশে রেখেও বললে, কী আছে এতে? আলাদা করে কী পাওয়া যাচ্ছে এই ন্যারেটিভে?

নতুন কিছুই না। সুফিয়ার এই বয়ান দিয়ে নতুন কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নতুন কোনো মাত্রায় পৌঁছায়নি গল্প। তাহলে এই ন্যারেটিভের অর্থ কী? কোনো প্রয়োজনই তৈরি করতে পারেনি। শুধু একটা ভিন্ন কোণ থেকে গল্প বলতে চাইলেই তো ভালো কিছু হচ্ছে না, যদি না তাতে নতুন কিছু পাওয়া যায়, যদি না অমন রসদ পাওয়া যায়।

ওই একটু যুদ্ধের দামামা, একটু অন্দরমহলের টেনশন, গদ্যভাষার দুর্বলতায় যে টেনশনও তৈরি হয়নি, আর একটু টিনেজ উচ্ছ্বাস, প্রেম এসব (যাতে জেন অস্টেনের সুপরিচিত উপন্যাস ‘এমা’র ভাইব অনেক বেশি, যা অবশ্য জনরার অলংকার অনুযায়ীই হতে পারে)। খুবই অতি পরিচিত এবং গৎবাধা সব অলংকার। এমন ঘটনাবলী, পরিণতি পাঠক ইতোমধ্যেই ছিন্নবিচ্ছিন্নভাবে অনেক সিনেমায় দেখেছেন; এই জনরার অনেক উপন্যাসেও পড়ে থাকবেন। সরাসরি বললে, ক্লিশেতে খোঁড়াখুঁড়ি আর ঘোরাঘুরি ছাড়া এই উপন্যাস নতুন করে কিছুই তেমন করতে পারেনি। গদ্যভাষা আর অলংকারের ব্যবহারেও তেমন সৌকর্যতা নেই। বিবরণের চেয়ে কিছু অংশে আবার বাহুল্য নজরে এসেছে। গড়পড়তা গদ্যভাষা।

Image Source: Scrapbooks

ঔপন্যাসিক আসিব রায়হান সব মিলিয়ে ৭৩টি গ্রন্থের নাম দিয়েছেন শেষে। প্রেক্ষাপট আর বয়ান সাজাতে যেগুলো সহায়ক বা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এতসব পড়েও এই ফলাফল একটু আক্ষেপ আর হতাশারই। এই গল্পের চেয়ে বরং এটা লিখতে গিয়ে লেখকের এই বিস্তৃত লেখাপড়াই আকর্ষণীয় ঠেকে। ওটা উল্টো পরিহাসের। ব্যাকফ্ল্যাপে যেভাবে “নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধারায় এ এক অনন্য সংযোজন” দাবী করা হয়েছে, সেটাও একইভাবে পরিহাসমূলক!

This Bengali article is a compiled review of 3 novels, published in 2023's book fair. All of the 3 books contains some serious contents.

Feature Image: Scrapbooks

Related Articles

Exit mobile version