৯০-এর দশকে জন্ম নেয়া ছেলে-মেয়েদের কাছে জাপানি অ্যানিমেশন বা অ্যানিমের রয়েছে এক অন্যরকম টান। অবশ্য এ টান কেবল একটা দশকে আটকে আছে, তা নয়। এর আগেও অ্যানিমেশনের আবেদন যেমন ছিল, আধুনিক সময়েও তা বেড়েছে বৈ কমেনি।
এখানে আগে একটা জিনিস পরিষ্কার করে দেয়া উচিত। সেটি হচ্ছে অ্যানিমেশন এবং অ্যানিমের মধ্যে পার্থক্য। পারতপক্ষে দুটোর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে ‘অ্যানিমে’ শব্দটা ব্যবহার করা হয় জাপানি অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রে। জাপানের নিজস্ব অ্যানিমেশন স্টাইল রয়েছে। এই স্টাইলকেই বলা হয় অ্যানিমে। আর ‘অ্যানিমে’ শব্দটি এনিমেশনের সংক্ষিপ্ত রূপ ছাড়া আর কিছু নয়।
তো এই জাপানি অ্যানিমেশন বা অ্যানিমে-প্রেমী মানুষের সংখ্যা কম নয়। এই ভক্তদের এক বিশাল অংশই হচ্ছে শিশু-কিশোর। তবে যুবক কিংবা মধ্যবয়সীদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। কোনো একটা কারণে এই জাপানি অ্যানিমে এসব কিশোর-যুবকের অন্তরে আলাদা জায়গা করে নেয়। হতে পারে এটি অসাধারণ গল্পের কারণে, কিংবা হতে পারে সেটি গ্রাফিক্সের কারণে।
অ্যানিমে সিরিজের অধিকাংশ গল্পই আসলে কাল্পনিক। সাধারণত মাঙ্গা (জাপানি কমিক) থেকে পরবর্তীকালে অ্যানিমে সিরিজ তৈরি করা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তেমনই কিছু অ্যানিমে সিরিজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডেথ নোট, নারুটো, পোকেমন, ড্রাগন বল ইত্যাদি।
তবে আজকের লেখায় একটি বিশেষ সিরিজ নিয়ে আলোচনা করা হবে, যে অ্যানিমের কাহিনীর সাথে জাপানের আততায়ী হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসের আভাস পাওয়া যায় খানিকটা। বলছি ‘স্যামুরাই এক্স’-এর কথা; তবে আসল টিভি সিরিজটি ‘রুরোনি কেনশিন’ (Ruroni Kenshin) নামে পরিচিত। যদিও আসল সিরিজ এবং স্যামুরাই এক্স নামক এনিমে সিরিজের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।
স্যামুরাই এক্স এনিমে সিরিজের কাহিনী নিয়ে আলোচনা করার আগে এর খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
প্রথমত, স্যামুরাই এক্স অ্যানিমেশনটি মূলত একটু মাঙ্গাভিত্তিক অ্যানিমেশন সিরিজ। মাঙ্গা আর্টিস্ট নবুহিরো ওয়াতসুকি রুরোনি কেনশিন মাঙ্গা সিরিজের সূচনা করেন। ১৯৯৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯৯ সামের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত এই মাঙ্গা সিরিজটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। ‘শুএইশা’ (Shueisha) নামক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের সাপ্তাহিক ‘শোনেন জাম্প’ (Shonen Jump) নামক ম্যাগাজিনে মাঙ্গাটি প্রকাশ করে।
পুরো মাঙ্গা সিরিজটি ছিলো ২৮টি খণ্ডে বিভক্ত। ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৮ সালে তিনটি অ্যানিমেশন স্টুডিও এই মাঙ্গা সিরিজের উপর ভিত্তি করে অ্যানিমেশন তৈরি করে। পরে লেখক কাওরু শিজুকা এই কমিকের উপর ভিত্তি করে উপন্যাস লেখেন।
এই ছিলো স্যামুরাই এক্স সিরিজের শুরুর টুকিটাকি। এখন একটু সিরিজের মূল বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
গল্পের সময়কাল তৎকালীন জাপানের টকুগাওয়া যুগের শেষে মেইজি যুগের পুনরুত্থানেরও ১০ বছর পরে। এর আগে শোগান সরকার (বাকুফু – Bakufu নামেও পরিচিত) ক্ষমতায় ছিল প্রায় ২৫০ বছরের মতো। ফলে সরকারের মধ্যে দূর্নীতি চরম আকার ধারণ করে, অর্থনৈতিকভাবে জাপানের ক্ষতিও হয়। এরপর শোগান বা বাকুফু সরকারে বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় যা বাকুমাতসু আন্দোলন নামে পরিচিত। এরপর মেইজি সরকারের পুনরুত্থান ঘটে।
কেনশিন হিমুরা নামে এক তরুণ পরিব্রাজক জাপানের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে একসময় কিয়োটোতে আসে। ‘রুরোনি’ একটি জাপানি শব্দ, যার অর্থ পরিব্রাজক বা ভ্রমণকারী। কোমরে ঝোলানো তলোয়ার দেখে কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে, এই যুবক একজন স্যামুরাই।
কিন্তু সেই সাথে আরো কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায় এই যুবকের মধ্যে, যা দেখে অনেকেই আঁতকে ওঠে। যেমন, ছিমছাম শরীর, লাল রঙের লম্বা চুল পনিটেইল করে বাঁধা, এবং বাম গালে ক্রস চিহ্ন। এসব বৈশিষ্ট্য কেবল একজনেরই থাকতে পারে। মেইজি সরকারের পুনরুত্থানের সময়ে সরকার দলীয় এবং ঠান্ডা-মাথার একজন আততায়ী, যার নাম হিতোকিরি বাতোসাই।
কিন্তু ঠান্ডা মাথার একজন আততায়ীর বৈশিষ্ট্য নিয়েও কেন কেনশিন আততায়ীর জীবন ত্যাগ করে সহজ-সরল জীবনে প্রবেশ করেছে, সেটি সবার কাছেই এক রহস্য। প্রায় ১০ বছর সে জাপানের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে। অসংখ্য খুনের পরে তার হঠাৎ মনে হয়েছে, এসব তার জীবনের চরম ভুলের সমষ্টি। তাই সে তার ধারালো তলোয়ার ত্যাগ করে এমন তলোয়ার গ্রহণ করেছে, যার বিপরীত দিকে ধার দেয়া, যার নাম সাকাবাটো কাগুচি। আততায়ীর জীবন ত্যাগ করে গ্রহণ করেছে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করার ব্রত।
কিয়োটোতে আসার পর তার পরিচয় হয় মিস কাওরুর সাথে। কেনশিন তাকে এক খুনীর হাত থেকে বাঁচায়। কেনশিনের আসল পরিচয় বুঝতে পেরে মিস কাওরু তাকে তার তলোয়ার প্রশিক্ষণ স্কুলে (Dojo) থাকার প্রস্তাব দেয়। মূলত মিস কাওরু তাকে একপ্রকার ভালোবেসে ফেলে। আর এখান থেকেই সিরিজের শুরু।
কেনশিন মূলত আততায়ীর জীবন ত্যাগ করে সাধারণ জীবন-যাপন করার এবং সাধারণ মানুষকে সাহায্য করার জীবন বেছে নিয়েছিল। কিন্তু তার পিছু পিছু শত্রুরা তাকে ধাওয়া করে বেড়িয়েছে। আর বার বার কেনশিন তাদের পরাজিত করে হত্যা করা ছাড়াই। অস্ত্রবিদ্যায় তার নিজস্ব কিছু স্টাইল, তীব্রতা এবং দ্রুতগতির কারণে সে বাকি আততায়ীদের কাছে কিংবদন্তি হিসেবে পরিচিত।
তবুও মাঝে মাঝে তাকে পরাজিত হতে হয়েছে। নতুন করে আবার শিখতে হয়েছে নতুন কোনো অস্ত্রবিদ্যা। সবাই তাকে কিংবদন্তি মনে করলেও কেনশিনের কাছে কিংবদন্তি হচ্ছে তার গুরু সেইজিরো হিকো। তাছাড়া যারা তাকে পরাজিত করতে পারে বা পেরেছে তাদের প্রশংসা করতে বা প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করতে কোনো দ্বিধা করেনি কেনশিন।
এরপর আস্তে আস্তে সেই স্কুলে যুক্ত হয়েছে ইয়াহিকো মিওজিন নামক এক স্যামুরাই পুত্র। মায়ের অসুখের সময়ে যে টাকা ধার করে আর শোধ দিতে পারেনি। পরে ধারদাতাদের জন্য পকেটমারি বা ছিনতাইয়ের কাজ করেছে। এরকমই পকেটমারি করতে গিয়ে একদিন কেনশিনের নজরে পড়ে সে। কেনশিন তাকে নিয়ে আসে মিস কাওরুর ডোজোতে।
তারপর আসে সানোসুকি সাগারার কথা। সানোসুকি যে ক্ল্যানের সদস্য, সেটি একপ্রকার মিলিশিয়া বাহিনী। এরা কাজ করতো সরকারের পক্ষে। কিন্তু কোনো এক কারণে মেইজি সরকার এদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে। সানোসুকি বেঁচে যায় কোনোভাবে। ফলে সে হয়ে ওঠে সরকারবিরোধী। জানবাতো নামক একধরনের কাল্পনিক অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে।
কেনশিনের পরিচয় পাওয়ার পর সে কেনশিনের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধের ইচ্ছাপ্রকাশ করে। প্রথম দ্বন্দ্বযুদ্ধ অর্ধসমাপ্ত থেকে যায় যদিও। পরবর্তীতে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় কেনশিন সানোসুকির জানবাতো কেটে দু’ভাগ করে ফেলে। কিন্তু তাকে হত্যা করে না, বরং তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করে। কেনশিনের মতো একজন কিংবদন্তি খুনীর এরূপ শীতল ব্যবহার দেখে সানোসুকি অবাক হয়। পরবর্তীতে সে-ও কেনশিনের সাথে যোগ দেয় সাধারণ মানুষের শান্তির জন্য।
মূল চরিত্রে কেনশিনকে রেখে এই চারজনকে নিয়ে এগিয়ে যায় কাহিনী। সিরিজে ভালো-খারাপ আরো নানা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে, আবির্ভাব ঘটে কেনশিনের বিরুদ্ধ এবং বিপক্ষদলের শত্রুদের। যাদের সাথে তার উল্টোধারী তলোয়ার দিয়ে দ্বন্ধযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। তবে কেনশিন যেহেতু আর কখনও রক্তপাত না করার প্রতিজ্ঞা করেছে, তাই সে কাউকে হত্যা করেনি।
পরবর্তীতে কেনশিন কাওরুকে বিয়ে করে সংসার করতে থাকে। তাদের একটি পুত্রসন্তানও হয়। তবে কেনশিন চায়নি যে তার ছেলে তাকে দেখে তার মতো হোক। তাই সে তা লম্বা চুলে কেটে ফেলে এবং কাউকে অস্ত্রশিক্ষা না দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে। মূলত অস্ত্রবিদ্যা এবং রোমান্টিকতা দুই-ই আছে এই অ্যানিমে সিরিজে।
লেখার এ পর্যায়ে এসে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, নবুহিরো ওয়াতসুকির এই রুরোনি কেনশিন কি আসলেই কল্পকাহিনী? নাকি এটি জাপানের তৎকালীন কোনো সত্যতাও প্রকাশ করে? এই বিষয়ের উপরই এখন আলোচনা এগিয়ে নেয়া যাক।
এককথায়, রুরোনি কেনশিন বা স্যামুরাই এক্স সিরিজের কাহিনী সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত নয়। বরং আর্টিস্ট নবুহিরোকে তার মাঙ্গার বেশ কয়েকটি চরিত্রের জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়েছে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে, এই সিরিজের চরিত্রগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও থাকতে পারে।
প্রথমত আসা যাক মূল চরিত্র অর্থাৎ কেনশিন হিমুরা চরিত্রে। জাপানের বাকুমাতসু আন্দোলনের সময়ে চারজন আততায়ীকে কিংবদন্তি হিসেবে ধরা হয়। তাদের বলা হত হিতোকিরি বা যারা অস্ত্রের মাধ্যমে মানুষকে খুন করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গেঞ্জাই কাওয়াকামি নামক এক স্যামুরাই। নবুহিরো ওয়াতসুকির কেনশিন চরিত্রটি চিত্রিত হয়েছে এই গেঞ্জাই কাওয়াকামির উপর ভিত্তি করে।
কাওয়াকামির শরীর ছিলো হালকা বেটে-খাটো, ছিমছাম, চিকন, মাথায় ছিলো লম্বা চুল। হঠাৎ দেখলে মনে হবে কোনো নারী দাঁড়িয়ে আছে। মূলত কেনশিনের ক্ষেত্রেও এই বৈশিষ্ট্যগুলো খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়।
বাকুমাতসু আন্দোলনের সময়ে কেনশিন বিখ্যাত হয় একজন চিন্তাবিদকে খুনের মাধ্যমে। আদর্শবাদী এবং বিখ্যাত চিন্তাবিদ শাকুমা শৌজানকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে কাওয়াকামি। শাকুমা চেয়েছিলেন, জাপান যেন বিদেশীদের বিশেষ করে পশ্চিমাদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজেদের উন্নতি করতে পারে।
এতে করে সে রয়্যালিস্টদের সহজ শিকারে পরিণত হয় এবং কাওয়াকামি তাকে খুন করে। পরে কাওয়াকামিকে বন্দী করা হয়, কিছুদিন পর ছেড়েও দেয়া হয়। মেইজি সরকার অবশ্য বুঝতে পারে যে শাকুমার চিন্তাধারা যুক্তিসংগত। তাই জাপান আস্তে আস্তে পশ্চিমা দেশের শিক্ষা-শিল্প-প্রযুক্তি দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে।
এতে করে কাওয়াকামি চলে যায় সরকারে বিরুদ্ধে। সে মেনে নিতে পারেনি যে, আদর্শাবাদীদের বিপক্ষে তাদের আন্দোলন এভাবে ব্যর্থ হবে। পরে মেইজি সরকার তাকে আবার গ্রেফতার করে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়।
যদিও অ্যানিমে সিরিজে কেনশিনকে আততায়ী জীবন ছেড়ে পরিব্রাজক জীবন বেছে নিতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে গেঞ্জাই কাওয়াকামি তেমনটা করেনি বা করার সুযোগ পায়নি।
এখানে আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কেনশিনের গোপন অস্ত্রবিদ্যা ‘হিটেন মিৎসুরুগি রিউ’। এটি বাস্তবিক অর্থে কাওয়াকামির নিজস্ব স্টাইল ‘গেঞ্জাই শিরানুই রিউ’ থেকে অনুপ্রাণিত। তার শরীর হালকা হওয়ায় গতির দিক থেকে সে ছিল খুবই দ্রুত। ডান পা সামনে এগিয়ে নিয়ে, হাঁটু সামান্য ভাজ করে এবং একইসাথে বাম পা ভাজ করে মাটি থেকে সামান্য উপরে থাকবে, এরপর ডান হাত দিয়ে অস্ত্র খাপ থেকে বের করে আক্রমণ- এটাই সেই গোপন অস্ত্রবিদ্যা।
তবে কেনশিনের উল্টোধারী তলোয়ার অর্থাৎ সাকাবাটো কাগুচির অস্তিত্ব পুরোটাই কাল্পনিক। কারণ এ ধরনের কোনো তলোয়ার তখন ছিল না। কেনশিন চরিত্রের বাস্তবায়নে এই উল্টোধারী তলোয়ারের সাহায্য নেয়া হয়েছে। এর দ্বারা মনে হবে যেন কেনশিন আগের জীবন নিয়ে অনুতপ্ত এবং সে তার খুনী তলোয়ার ত্যাগ করে এমন তলোয়ার গ্রহণ করেছে যা রক্তপাত করবে না কখনও। যদিও এই অ্যানিমের পরে এই তলোয়ারের মতো তলোয়ার প্রস্তুত করা হয়েছে।
এখন আলোচনা করা যাক সিরিজে কেনশিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু সানোসুকি সাগারাকে নিয়ে। নবুহিরো ছিলেন শিনসেনগুমি নামক ক্ল্যানের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত। তাই তার সিরিজে অধিকাংশ সময়েই শিনসেনগুমির নাম এসেছে। সানোসুকি সাগারা চরিত্রটি এই শিনসেনগুমিরই একজন সদস্যকে ভিত্তি করে সৃষ্টি করা হয়েছে। তার প্রকৃত নাম সানোসুকি হারাদা।
যদিও কেবল চরিত্রের কারণে ইতিহাসকে বারবার ধার করা হচ্ছে, কিন্তু এরপরও সিরিজের কারণে সেখানে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। যেমন- সানোসুকির অস্ত্র অর্থাৎ জানবাটো। এ ধরনের কোনো অস্ত্র তৈরি হয়নি কখনও। এটি কাল্পনিক অস্ত্র এবং সিরিজে কেনশিনের সাথে দ্বন্দ্বের সময়ে এটা দু’টুকরো হয়ে যায়। আবার সিরিজে দেখানো হয়, সানোসুকি টাকার বিনিময়ে লড়াই করতো প্রথম জীবনে। কিন্তু আসল সানোসুকি কখনও এমনটা করেনি।
এরপর আসে আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আওশি শিনোমোরি। সিরিজে আওশি ওনিওয়াবান ক্ল্যানের ডেপুটি কমান্ডার, যাকে বস বলে ডাকা হয়। আওশি কেনশিনকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করে। যদিও শেষ পর্যন্ত সে সেটি পারেনি। কেনশিনের কোমলতায় সে আর কোনোদিন লড়াই করবে না বলে অস্ত্র ত্যাগ করে।
আওশি শিনোমোরি চরিত্রটি নেয়া হয়েছে তোশিজো হিজিকাতা নামক চরিত্র থেকে। হিজিকাতা ছিল শিনসেনগুমি ক্ল্যানের ডেপুটি লিডার। কোদাচি নামক দুটি তলোয়ারের সাহায্যে আওশি লড়াই করতো। কোদাচি হচ্ছে একজোড়া তলোয়ার, সাধারণত এগুলোকে বলা হয় যমজ তলোয়ার।
যদিও বাস্তবে হিজিকাতা কখনো হিটোকিরি অর্থাৎ কেনশিনকে হত্যা করার কোনো প্রতিজ্ঞা করেনি। হাকোডেট-এর যুদ্ধে হিজিকাতা মারা যায়। কিন্তু তাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে তা আজও জানা যায়নি।
এবার সিরিজের আরেক গুরত্বপূর্ণ চরিত্র সেইতো হাজিমিকে নিয়ে আলোচনা করা যাক। সিরিজে সেইতোকে পুরোপুরি ভিলেন রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। সে ছিল ৩ শিনসেনগুমি ক্ল্যানের ডেপুটি কমান্ডার। এই ক্ল্যানের মূল কাজ ছিল কেনজুৎসুর প্রশিক্ষণ দেয়া এবং কখনও কখনও গুপ্তচরবৃত্তি করা। এ কারণে এই ক্ল্যানের সদস্যরা একটু রহস্যময় এবং সাধারণ মানুষের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতো।
সেইতো একপ্রকার মারাত্মক এবং প্রায় অপ্রতিরোধ্য অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। বিশেষ করে বামহাতি হওয়ায় প্রতিপক্ষকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হত। কারণ বামহাতি অস্ত্রধারী ছিল খুব কম। আর অস্ত্রবিদ্যাও ছিল ডানহাতের সাপেক্ষে রচনা করা। সেক্ষেত্রে তার বামহাতি কেনজুৎসু ছিল মারাত্মক। সেইতো শিনসেনগুমির অনেক দূর্নীতিগ্রস্ত সদস্যকে হত্যা করে। মেইজি সরকারের পুনরুত্থানের পর সে নাম পাল্টে ফেলে এবং পুলিশের গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্ব পালন করে।
যদিও সিরিজে দেখানো হয়েছে যে, মাকোতো শিশিও নামক একজন চরমপন্থীকে হত্যার জন্য সেইতো কেনশিনের কাছে যায় তার সাহায্যের জন্য। বাস্তবে তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। আবার অনেকে সেইতোকে নির্দয় হত্যাকারী হিসেবে ধারণা করলেও বাস্তবে সে ততটাও ভয়ংকর ছিল না।
সবশেষে আসে স্যামুরাই এক্স এনিমে সিরিজের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং চরিত্র সৌজি ওকিতা। মাকোতো শিশিও নামক একজন চরমপন্থী জাপানকে নিজের করায়ত্ব করার জন্য কাজ শুরু করে। এই উদ্দেশ্যে সে বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে। এমনকি সে কেনশিনের গ্রাম ইডো পুড়িয়েও দিতে চায়।
এ কারণেই সেইতো হাজিমি কেনশিনকে বলে শিশিওর সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে তাকে থামাতে। কিন্তু শিশিওর ডানহাত ছিলো ১৪ বছর বয়সী সৌজি ওকিতা। এই অল্প বয়সেই তার হাতে নিহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এমনকি কেনশিনও প্রথম এক-দুবার তার দ্রুতগতি ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতা দেখে মুগ্ধ। তার মতে, এই অল্প বয়সে যে মানুষ হত্যা করতে এত আনন্দ পেয়ে গেছে তাকে এত সহজে পরাজিত করা সম্ভব না। ওকিতার সাথে লড়াইয়ের সময়েই তার প্রথম উল্টোধারী তলোয়ার ‘শাকাবাটো কাগুচি’ ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যায়। পরে কেনশিন ‘শাকাবাটো শিনুচি’ নামক আরেকটি উল্টোধারী তলোয়ার গ্রহণ করে।
সৌজি ওকিতা চরিত্রটি বাস্তবে নেয়া হয়েছে শিনসেনগুমি ক্ল্যানের আরেক সদস্য সেতা সোজিরোর থেকে। এবং বাস্তবেই সেতা সোজিরো ছিল খুবই দ্রুতগতিসম্পন্ন। সুকুচি নামক এক বিশেষ কৌশলের মাধ্যমে সে তার গতি বৃদ্ধি করতে পারে। এই কৌশল জাপানের অস্ত্রবিদ্যায় ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘সংকুচিত পৃথিবী পদ্ধতি’। এটি আসলে কয়েকটি কৌশলের সমন্বয় যাতে করে নিজের এবং শত্রুর দূরত্ব কমিয়ে আনা যায় চোখের পলকে।
তবে দুঃখজনকভাবে বাস্তবের ওকিতা, অর্থাৎ সেতা সোজিরো ২৪-২৬ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে মারা যান।
মোটামুটি জাপানের স্যামুরাইদের ইতিহাস ঘেঁটে এই কয়েকটি চরিত্রের খোঁজ পাওয়া যায়, যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিংবা কলাকৌশলের সাথে স্যামুরাই এক্স সিরিজের চরিত্রগুলো মিল পাওয়া যায়। অ্যানিমে বিষয়ে আগ্রহ থাকলে আপনিও সময় করে দেখে নিতে পারেন সিরিজটি।