“এক পার্টি শেষ করে হালকা মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফেরে মা। তিনি একা ছিলেন, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার সন্ধ্যা কেমন কাটল? উত্তরে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, গত ৭ বছরে কোনো পুরুষের সাথে আমার সহবাস হয়নি তার কারণ একমাত্র তুমি; আমার খুনি সন্তান। ঠিক তখনি আমি একটি পেরেক তোলার হাতুড়ি নিলাম আর তিনি মারা না যাওয়া পর্যন্ত তাকে আঘাত করতে থাকলাম। এরপরে আমি তার মাথা কেটে সেই কাটা মাথা নিয়ে যৌনকর্ম শেষে বললাম, এই নাও হয়ে গেলো তোমার পুরুষের সাথে সহবাস। একটি ব্যাপার যেটা আমি বিশ্বাস করি তা হলো কোনো মায়েরই উচিৎ না তার সন্তানকে তিরস্কার করা। কোনো মা যদি তার ছেলেকে অপমান করে তবে সেই ছেলে হিংস্র এবং প্রতিকুল অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। এটাই সত্য।”
উপরের কথাগুলোর বক্তা এড কেম্পার। একজন সিরিয়াল কিলার। দশজন কলেজ পড়ুয়া মেয়ে, তার পৈত্রিক দাদা-দাদী ও নিজের মা’কে খুনের দায়ে আমেরিকান এই সিরিয়াল কিলার ১৯৭৩ সাল থেকে এখন অব্দি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া মেডিক্যাল ফেসিলিটি নামক জেলে বন্দি আছে। ১৫ বছর বয়সে নিজের দাদা-দাদীকে খুন করে প্রথম নিজেকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় এই খুনি। মানসিকভাবে তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন এই খুনি ২১ বছর বয়সে ছাড়া পাওয়ার পরে আবারো খুনের দায়ে ১৯৭৩ সালে ধরা পড়ে পুলিশের কাছে।
এই তালিকায় শুধু এড কেম্পার না, আরো আছে চার্লস ম্যানসন, ওয়েইন উইলিয়ামস, ড্যাভিড বার্কোউইটজ (সন অফ স্যাম), মন্টে রিসেল, ড্যারেল জিন, জেরোমে ব্রুডস (লাস্ট কিলার), ডেনিস র্যাডার। এই সকল খুনিদের, খুনি হয়ে উঠার গল্প এবং খুনের বিশদ বিবরণ ডেভিড ফিঞ্চারের সিরিজ মাইন্ডহান্টারের প্রেক্ষাপটের একটি বিশাল অংশজুড়ে আছে।
সময়কাল ১৯৭৭-১৯৮০। এজেন্ট ফোর্ড, ২৯ বছর বয়সী একজন অফিসার। এফবিআইতে তার মূল কাজ ছিল যেকোনো খুন এবং তার তদন্ত বিশ্লেষণ করে তা নবীন পুলিশ অফিসারদের বুঝিয়ে দেওয়া। যাতে পরবর্তীতে এমন খুনির সম্মুখীন হলে যেন তারা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারে। খুনির মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে, তার সাথে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানোই এজেন্ট ফোর্ডের এই কোর্সের মূল লক্ষ্য।
বেশ ভালোই পড়াচ্ছিলেন তিনি। তবে অফিসারেরা তাদের মারণাস্ত্র ব্যবহারেই যেন বেশি আগ্রহী। এজেন্ট ফোর্ডের ক্রিমিনাল সাইকোলজির এই পাগলামোকে যে ইউনিট বাহবা দিতে পারে তা হলো বিহেভিয়ারাল সায়েন্স। তাই ফোর্ডের নতুন ঠিকানা হয়ে গেল এফবিআইয়ের বিহেভিয়ারাল সায়েন্স ইউনিট। সেখানে তার পরিচয় হয় এজেন্ট বিল টেঞ্চের সাথে। শুরু হয় নতুন যাত্রা। দুই এজেন্ট, এজেন্ট ফোর্ড এবং এজেন্ট বিলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সে সময়কার সবচেয়ে হিংস্র কিন্তু নম্র সিরিয়াল কিলারের সাক্ষাৎকারের। সিরিয়াল কিলার এড কেম্পারের খুনের উদ্দেশ্য ও প্রেরণা সম্পর্কে জানতে পারলে হয়তো এফবিআই আরো অনেক খুনের তদন্ত সহজেই করতে পারবে, এই ছিল তাদের বিশ্বাস।
অনেকে বলে এই বিষয়ে এজেন্ট ফোর্ডের আলাদা দক্ষতা আছে যা আশীর্বাদসরূপ পাওয়া। তবে এই দক্ষতা কি আসলেই আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? সিরিজ এগোতে থাকে আর প্রতি এপিসোডে ডেভিড ফিঞ্চার এবং কুশীলবদের কারিশমা দেখতে পাওয়া যায়। শুধুমাত্র খুনিদের গল্পই না, সে সময়কার বর্ণবাদ, হোমোফোবিয়া এবং কর্মক্ষেত্রের হাজারো সমস্যা নিয়ে মাইন্ডহান্টার। এইসব সাইকোপ্যাথদের সাথে সময় কাটাতে গিয়ে, তাদের গল্প শুনতে গিয়ে তার ছাপ পড়তে থাকে দুই এজেন্টের ব্যক্তিগত জীবনেও। ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মক্ষেত্রের এই টানাপড়েনের মধ্যে এজেন্ট ফোর্ডের অবস্থা বেগতিক হতে থাকে।
এজেন্ট হোল্ডেন ফোর্ডের চরিত্রে আছেন জনাথন গ্রফ। স্যুট-টাই পরে হোল্ডেন ফোর্ডের চরিত্রকে যেন জীবন্ত করে তুলেছেন এই আমেরিকান অভিনেতা। এফবিআই টিমের সবচেয়ে প্রতিভাশালীদের মধ্যে একজন এজেন্ট হোল্ড কিন্তু মানসিকভাবে এজেন্ট বিলের মতো শক্ত নন। এজেন্ট বিলের চরিত্রে আছেন হল্ট ম্যাকক্যালি। স্ত্রী কন্যাসহ একজন অফিসার যিনি একজন ফুল-টাইম ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্টের পাশাপাশি একজন স্বামী ও বাবা। মানসিকভাবে নিজেকে ধীর-স্থির রেখে কীভাবে কাজ ও নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা রেখে চলতে হয় তাই এই চরিত্রের কাছে শিক্ষণীয়।
আরেক অভিনেতার কথা না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন এড কেম্পার চরিত্রের অভিনেতা ক্যামেরন ব্রিটন। বাস্তব জীবনের এড কেম্পারের সাথে রূপালী পর্দার এই কেম্পারের পার্থক্য খুব একটা লক্ষণীয় নয়। তার অসাধারণ বাচনভঙ্গি ও অভিনয়শিল্প অবাক করার মতো। হল্ট ম্যাকক্যালি, জনাথন গ্রফ এবং ক্যামেরনসহ বাকি কুশীলবদের দুর্দান্ত অভিনয়ের পাশাপাশি মাইন্ডহান্টারের ক্যামেরার পেছনের আকর্ষণ হচ্ছেন নির্মাতা ড্যাভিড ফিঞ্চার। সিনেমা জগতের সাথে সম্পর্ক আছে কিন্তু ডেভিড ফিঞ্চার সাহেবের নাম শোনেনি এমন দর্শক পাওয়া কঠিন। ফাইট ক্লাব, সেভেন, গন গার্ল, দ্যা গেইমের মতো অনেক বিখ্যাত সিনেমা দর্শকদের উপহার দিয়েছেন এই নির্মাতা। ধীর-স্থিরভাবে গল্প এগিয়ে, প্রত্যেক চরিত্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তবেই ক্ষান্ত হন এই নির্মাতা। তার বিখ্যাত সিনেমা জোডিয়াক; যা আরেক সিরিয়াল কিলারের অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ২০০৭ সালে, এই সিনেমারই ছায়াতলে মাইন্ডহান্টারের সৃষ্টি বলে মনে করেন অনেকে। তবে ফিঞ্চারের মূল অনুপ্রেরণা জন ই. ডগলাসের বই মাইন্ডহান্টার: ইনসাইড এফবিআই’স এলিট সিরিয়াল ক্রাইম ইউনিট। সিরিজের এজেন্ট ফোর্ড চরিত্র মূলত এই জন ই. ডগলাস নিজেই, যিনি একজন স্পেশাল এজেন্ট ছিলেন এফবিআই এর বিহেভিয়ারাল সাইন্স ইউনিটে।
নেটফ্লিক্সের এই সিরিজ দুই সিজনেই অনেক দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছে। তবে তৃতীয় সিজন নিয়ে এখনো মুখ খুলেননি ফিঞ্চার। অভিনেতাদের তাদের চুক্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এরমধ্যেই। মাঙ্ক সিনেমা ও লাভ ডেথ এন্ড রোবটের দ্বিতীয় সিজন নিয়ে ব্যস্ততার পাশাপাশি ফিঞ্চার বলেছিলেন, এই সিরিজের দ্বিতীয় সিজন নির্মাণেই বেশ কাঠখড় পোড়ানো হয়ে গেছে। শুধু তাই না, এটি বেশ ব্যয়বহুল বলেও, এই মুহূর্তে তিনি এই ব্যাপারে ভাবতে পারছেন না। শোনা গেছে নেটফ্লিক্সের সাথে আবারো চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন মাইন্ডহান্টারের তৃতীয় সিজন নিয়ে।
সিরিয়াল কিলিং এবং ক্রিমিন্যাল সাইকোলজি নিয়ে যদি আগ্রহ থেকে থাকে তবে সেসব দর্শকের জন্য মাইন্ডহান্টার হয়ে উঠতে পারে প্রাতঃরাশ থেকে রাতের খাবার। মাইন্ডহান্টার মূলত কথোপকথন একজন আসামী ও পুলিশ অফিসারের। আসামীর দিককার গল্প যা কখনো শোনা হয়ে ওঠে না কারোরই। হয়তো স্ক্রিনের সামনে বসে প্রত্যেকটি ডায়লগ মনোযোগের সাথে শুনে তা নিয়ে ভাবতে হয় বলেই এই সিরিজ অন্যান্য কমার্শিয়াল সিরিজের মতো সাড়া জাগাতে পারেনি।
এই সিরিজে নেই কোনো মশলা, নেই কোনো বিশাল টুইস্ট। সাদামাটা জামাকাপড়ে দুই অফিসার শুনছেন ক্রিমিনালদের গল্প, করছেন তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। তবে ধীরে ধীরে মাথায় গেঁথে যায় প্রত্যেক সিরিয়াল কিলারের নিজস্ব গল্পগুলো। আসলেই কী তারা এই ঘৃণার যোগ্য? নাকি শুধুমাত্র সুন্দর পারিবারিক পরিবেশের অভাবটাই আমাদের আর তাদের মধ্যকার একমাত্র পার্থক্য? এসকল ভাবনার উদ্রেক ঘটায় মাইন্ডহান্টার। আইএমডিবিতে এই থ্রিলার সিরিজের বর্তমান রেটিং ৮.৬। থ্রিলার এবং ফিঞ্চারের সিগনেচার সিনেমা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে মাইন্ডহান্টার নিরাশ করবে না বলেই আশা রাখছি। সিরিজটির দুই সিজনই নেটফ্লিক্সে দেখা যাচ্ছে।