ভোজনরসিকেরা বলে, খাবার খেতে হয় সময় নিয়ে, অল্প অল্প করে, রসিয়ে রসিয়ে। অন্যথায় খাবারের পূর্ণ স্বাদটা আস্বাদন করা যায় না। ভোজনরসিকদের এই তত্ত্বের সাথে যদি একমত হই, তাহলে ২০০৪-২০১০ সাল পর্যন্ত প্রচারিত হওয়া আমেরিকান টিভি সিরিজ লস্টের নির্মাতারা গল্প রসিক। কেননা, তারা গল্প বলায় তাড়াহুড়ো করেননি মোটেও। বরং একটু একটু করে গল্পের জটিলতা দর্শকের সামনে উন্মোচন করে দর্শকের মনোযোগটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন একেবারে শেষ অবধি। তারা নিশ্চিত করেছেন, বিজ্ঞান আর কল্পকাহিনীর মিশেলে তাদের নির্মিত সিরিজটি যেন শেষপর্ব পর্যন্ত দর্শক দেখতে থাকেন। শেষ পর্ব পর্যন্ত যেন দর্শক ভাবতে থাকেন কী হবে, কী হবে না!
লস্টের শুরুটা হয় ‘Getting Lost in an Island’, অর্থাৎ একটি দ্বীপে হারিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। কারা হারিয়ে যায়? ওশিয়ানিক ফ্লাইট- ৮১৫ সিডনি থেকে আকাশে উড়াল দেয় যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভাগ্য তাদের টেনে নিয়ে আসে সাগরের বুকে নির্জন এক দ্বীপে। দ্বীপে এসে তাদের বিমানটি ক্রাশ করলেও বেঁচে যান অধিকাংশ যাত্রী, এমনকি গর্ভবতী ক্লেয়ারও! ভাবছেন বেঁচে যেতেই পারে। কিন্তু, সিরিজটি যত সামনে এগোবে, ভাবনাগুলো তত এলোমেলো মনে হতে থাকবে, আর বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের মনে হতে থাকবে ইঁদুরের ফাঁদে পা দেয়া একদল দিশেহারা মানুষ।
আছরে পড়া বিমান থেকে একেক জায়গায় ছিটকে পড়ে একেকজন যাত্রী। জ্ঞান ফিরে পাবার পর সকলে মিলে রেডিও বার্তার মাধ্যমে সাহায্যের আবেদন পাঠানোর চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু বার্তা পাঠাতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে, এই দ্বীপ থেকে ১৬ বছর যাবত কোনো এক ফরাসি নারীর ডিস্ট্রেস কল বেজে চলেছে, কিন্তু তা আজও দ্বীপের বাইরে পৌঁছেনি! ১০ দিন, ১৫ দিন, ১ মাস কেটে যায়, কিন্তু কেউ তাদের খোঁজে আসে না, আদৌ কেউ আসবে কি না তা-ও জানা নেই।
কিন্তু, উদ্ধার না হলে কী! বেঁচে থাকা তো চাই। আর এই বেঁচে থাকার তাগিদে তারা দলবদ্ধ হন জ্যাক শেপার্ড নামক এক ডাক্তারের নেতৃত্বে। এই নেতৃত্বে সঙ্গ দেয় জন লক নামক এক ভাগ্যের প্রতি অন্ধবিশ্বাসী ব্যক্তি। আবার জ্যাকের নেতৃত্বে যথেষ্ট আপত্তি হয় জেমস ফোর্ড নামক আরেক খুঁতখুঁতে স্বভাবের ব্যক্তির, যাকে সবাই সয়ার নামেই ডাকে। জ্যাক, সয়ার, কেট, ক্লেয়ার, চার্লি, লক, ফ্র্যাংকলিং, সান, জিন, রোজ, হার্লি এবং অন্য সকলের মধ্যে যখন নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক খেলা চলতে থাকে, একইসাথে চলতে থাকে দ্বীপের রহস্য উন্মোচন আর তাদের বিগত জীবনের ফ্ল্যাশব্যাক।
লস্ট নির্মাতাদের সাফল্য মূলত তাদের এই গল্প বলার ধরনেই। প্রতিটি দৃশ্যের শেষে তারা কোনো একজনের জীবনের পূর্বেকার কোনো ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক দেখিয়ে পরের দৃশ্যে গল্পের মোড় সেই ফ্ল্যাশব্যাকের সাথে মিল রেখে পাল্টে যায়, উদ্ভব হয় নতুন পরিস্থিতির, দর্শক একটু একটু করে উপলব্ধি করতে থাকেন ঐ ক্যারেক্টারের ব্যক্তিত্ব। তবে, যে ব্যাপারটি দর্শককে চিন্তার অসীম সমুদ্রে নিক্ষেপ করে, সেটি হলো ভাগ্য আর কাকতালীয়তার দ্বন্দ্ব। একটি দৃশ্যে যখন মনে হবে বিমানটি এই দ্বীপে কাকতালীয়ভাবে ভেঙে পড়েছিল, মানুষগুলোও এসেছিল কাকতালীয়ভাবে, পরের দৃশ্যেই মনে হবে না, মানুষগুলোর ভাগ্যই তাদেরকে এখানে এনেছে, “They were meant to be there at the Island!”
এভাবেই ভাগ্য আর কাকতালীয়তার দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যস্ত আপনি আরো অসংখ্য রহস্যের জটে হারিয়ে যাবেন প্রতিটি পর্ব শেষেই। দ্বীপের ভেতর থেকে ভেসে আসা ভয়ানক শব্দ, কালো ধোঁয়ার রূপে আগত এক অসংজ্ঞায়িত বস্তু, যাকে সারভাইবাররা নাম দিয়েছেন ‘স্মোক মনস্টার’, দ্বীপে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো ড্যানিয়েল, রাতের আঁধারে কেবল শিশুদের তুলে নিয়ে যাওয়া, দ্বীপে বসবাসকারী ‘দ্য আদার্স’ যারা দ্বীপটিকে নিজেদের বলে দাবি করেন, ‘ধার্মা ইনিশিয়েটিভ’ নামক এক রহস্যময় বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্পের রেখে যাওয়া গোলকধাঁধার মতো হ্যাচগুলো, দ্বীপের কেন্দ্রে জ্বলতে থাকা অজানা সেই আলো, কিংবা দ্বীপের রক্ষাকর্তা এবং সব ঘটনার ছক সাজানো চির রহস্যমানব জ্যাকব- এরকম অসংখ্য রহস্যের এক মেইজের মাঝে হারিয়ে যাবেন আপনি, আর সারাক্ষণ ভাবতে থাকবেন, সিরিজ শেষ হলে বুঝি এই রহস্যের জট খুলবে।
এই সিরিজের পুরোটা জুড়ে দর্শকের প্রেডিক্টেবল কিছুই ঘটে না। শেষটায় এসে হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন, এবার তাহলে প্রেডিক্টেবল কিছু ঘটছে। শাহরুখ খানের “এন্ড মে সাবকুচ ঠিক হো যাতা হ্যায়” তত্ত্ব মেনে যখন মন ভালো করে দেয়া কিছু নাটকীয় দৃশ্য এবং রহস্যের জট খুলে দেয়ার শেষ প্রস্তুতি সমানতালে চলতে থাকবে, তখন হয়তো নির্মাতাদের জন্য একরাশ প্রশংসাও মনে জমিয়ে ফেলবেন। কিন্তু হায়, শেষটায় গিয়ে দুটো আশাই যে অপূর্ণ রয়ে যাবে। মন ভালো করা নাটকীয়তা গিয়ে অপার্থিব জগতে ঠেকবে, আর রহস্যের জট খোলার প্রস্তুতি, প্রস্তুতির মাঝেই শেষ হবে!
দেখতে দেখতে লস্টের ছয়টি সিজন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। সেগুলো লস্টের সারভাইবারদের মতোই হারিয়ে যাবে চিরতরে। প্রথমদিকে বিজ্ঞান আর যৌক্তিকতার সাথে অন্ধবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, এবং সে দ্বন্দ্বে যৌক্তিকতার জয় হবে এমন ধারণা করা গেলেও শেষতক কারোরই জয় হয় না! এমনভাবে সিরিজটির ইতি টানা হয়েছে, যা দেখে মনে হতেই পারে নির্মাতারা কী নির্মাণ করছেন সে সম্বন্ধে অজ্ঞাত। ভাগ্যের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সেটি তো ঠিকমতো হয়ইনি, উপরন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে শেষতক একটি ফিকশনে পরিণত করা হয়েছে সিরিজটিকে, যে ফিকশনেরও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ও ইতিহাস বলা হয়নি।
শেষ সিজনের কিংবা আরো নির্দিষ্ট করে বললে শেষ এপিসোডের হতাশা দর্শককে পোড়াবে তাতে সন্দেহ নেই। তথাপি, লস্ট একটি চমৎকার হাইএন্ড ড্রামা, সাসপেন্স আর থ্রিলে সমৃদ্ধ টেলিভিশন সিরিজ, যেটি যেকোনো রহস্যপ্রেমী দর্শকের জন্যই মাস্ট ওয়াচ। বিজ্ঞান আর ভাগ্যের দোলাচলকে একপাশে রেখে আপনি চাইলে ভালো আর মন্দের মাঝে দ্বন্দ্ব হিসেবেও দেখতে পারেন সিরিজটি, যেখানে মন্দ প্রতিনিয়ত শেকল ছিঁড়ে সকলের মাঝে মিশে যেতে চাইছে, কিন্তু ভালো তার পথ আগলে রাখছে। দ্বীপের রক্ষাকর্তা জ্যাকবই সেই ভালো। আর মন্দ হলো তার ভাই। জ্যাকবের ভাই? ও হ্যাঁ, জ্যাকবের ভাইয়ের নাম হলো আরো একটি প্রশ্ন, যে প্রশ্নের উত্তর লস্ট দেয়নি।