এলিরিন: কিংবদন্তীর আড়ালে সহস্র বছরের গল্প

 ১ 

সোনালি অতীত

১১৮৭

ধুলোর মেঘ উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে ঘোড়া দুটো জেরুজালেমের দিকে। তাদের পিঠের ওপর চড়ে থাকা ঘোড়সওয়ারদের দেখে মনে হচ্ছে হয় তাদের প্রচণ্ড তাড়া, নয়তো কারও থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ঢাল-তলোয়ার দুজনের সাথেই আছে, তবে ব্যবহার করবে কি না সেটা নিয়ে বেশ সন্দিহান দেখাচ্ছে তাদের। আপাতত ছুটে চলাটাই মুখ্য।

         “আমাদের কিছুক্ষণ বিরতি নিতে হবে, অন্তত ঘোড়াগুলোর বিশ্রাম তো দরকারই,” দুজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়স্কজন বাতাসের শব্দ ছাপিয়ে বলল।

          ধু ধু এ মরুভূমির মাঝে এই মরুদ্যান যেন একটুকরো জীবনের ছায়া। বিশাল এক পাথরের আড়ালে ছোট্ট এক ডোবা, কোনো মরীচিকা নয়, সত্যি সত্যিই জলাশয়। বড় পাথরের ছায়ার কারণে এ ডোবায় সরাসরি সূর্যের আলো এসে পড়ে না। একে কেন্দ্র করে আশেপাশে কিছু সবুজ গাছ জন্মেছে। কিছু মরুচারী পাখি মাঝে মধ্যে এসে বসে।

          তেমনই একটি পাখি বসে পানি পান করছে। ঘোড়ার ক্ষুরের দূর থেকে আসা হালকা শব্দে পাখিটি উড়ে গেল।

          ঘোড়সওয়াররা ডোবার কাছে এসে ঘোড়া থেকে নামলো; নাক-মুখে পেঁচানো কাপড় খুলতে থাকল। সারা রাত ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে তারা। পরনে মুসলিম অর্থাৎ সারাসিনদের মতো পোশাক। কিন্তু চেহারা ইউরোপীয়। তবে বয়স্কজন পুরোই ইউরোপীয়, চেহারা আর পোশাক দুটোতেই। তরুণ ছেলেটিকে দেখে মনে হয় শরীরে মধ্যপ্রাচ্যীয় রক্ত থাকতে পারে। দুজনেই অবশ্য মনে-প্রাণে খ্রিস্টের সৈনিক।

          বয়স্কজন অল্পবয়সী যুবককে বললেন, “রবার্ট, আজকের মতো এখানেই ক্যাম্প করো। আমি আশেপাশে একটু দেখে আসি।”

          “ঠিক আছে মাস্টার, গুছিয়ে নিচ্ছি আমি।”

          রবার্ট নামের যুবকটি ঘোড়ার ওপর থেকে কাপড়ে পেঁচানো বাক্স আর অন্যান্য সরঞ্জাম নামিয়ে ডোবার গা ঘেঁষে পাথরের ছায়ার মধ্যে ক্যাম্প গোছাতে শুরু করলো।

          বয়স্ক লোকটি পাথর বেয়ে উপরে উঠে গেল। সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহ কাটিয়ে দুজন যে পথ দিয়ে এসেছে সেই পথে দূরে দিগন্তের দিকে তাকালো। যত দূরে চোখ যাচ্ছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে রাতের আঁধারে ঘোড়া ছুটিয়ে তাদের চোখে ধুলো দিতে পারা গেছে- এ কথা তার আদৌ বিশ্বাস হয় না। তারা আসছে এটা নিশ্চিত।

          তারা আসার আগে কি গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে?

          এবার উল্টো দিকে ঘুরে পশ্চিমে তাকালো। দিগন্তে দৃষ্টি তার, যেন দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে সবকিছু। গন্তব্য স্বপ্নের সেই নগরী জেরুজালেম! এত রক্ত, এত যুদ্ধ! সবকিছুর কেন্দ্র এই জেরুজালেম নগরী। শেষবারের মতো সেই কিংবদন্তির নগরীতে ঢোকাটা খুব দরকার।

          সেই চিন্তা করেই বুক ভরে এক দীর্ঘশ্বাস নিলো টেম্পলার নাইট থমাস।

          পাথর থেকে নেমে এসে দেখা গেল রবার্টের ক্যাম্প করা শেষ। সে ব্যাগ থেকে শুকনো রুটি বের করছে।

          রবার্টের কাছে এসে বসলো থমাস। কিছু একটা বলবার জন্য মুখ খুলেও থেমে গেলেন।

          “কিছু বলবেন, মাস্টার?” বলল রবার্ট।

          “না, তেমন কিছু না, পরে বলবো,” ইতস্তত করে কথা ঘুরিয়ে নিল থমাস। “খাবার হয়ে গিয়েছে?”

          “বেশি কিছু নেই, রুটিই বাকি আছে কেবল।”          

          “এক কাজ করো, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো, রাত তো অনেক হলো,” থমাস বলল রবার্টকে। “আমি পরে খেয়ে নেব, খিদে পেলে।”

          “কী বলছেন এগুলো, মাস্টার,” থমাস বলে উঠলো, “আপনাকে ছাড়া আমি কীভাবে খাই আগে!”

          “আরে আমি বুড়ো মানুষ, খাওয়াটা তোমারই দরকার আগে,” হেসে বলল থমাস, এরপর সরে এলো রবার্টের কাছ থেকে। নীরবে বসে রইলো একটা উঁচু পাথরের ওপর। এক ফালি চাঁদের মলিন আলোতেই এদিকটা উজ্জ্বল হয়ে আছে।

          অনেকক্ষণ বাদে যখন থমাস ফিরে এলো রবার্টের কাছে, তখন সে গভীর ঘুমে। তার পাশে বসে বাকি থাকা রুটি খেয়ে নিল।

          “আপনি এখনও জেগে?” শব্দ পেয়ে উঠে বসেছে রবার্ট।

          “ঘুম আসছিলো না,” বলল থমাস। তখনই সিদ্ধান্ত নিল, এখনই বলতে হবে বিষয়টা। পোশাকের ভেতর থেকে গোল করে পেঁচানো একটা কাপড়ের টুকরো বের করে সামনে রাখল।

          “রবার্ট, এ স্ক্রলটা এখন তোমার কাছে রাখো।”

          তরুণ নাইট কিছুটা থমকে গেল। হাত থেকে রুটির টুকরোটা নামিয়ে রাখল। থমাসের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল, বোঝার চেষ্টা করছে মাস্টার আসলে কী চাইছে।

          “তুমি জানো এটা কোথায় পৌঁছাতে হবে?”

          “জানি, মাস্টার। কিন্তু…”

          “কোনো কিন্তু নয়। এ স্ক্রল পৌঁছে দেবার দায়ভার এখন তোমার।”

          “আপনি কোথাও যাচ্ছেন, মাস্টার? এই স্ক্রল আমাকে কেন দিতে চাচ্ছেন?”

          “কোথাও না। তোমার সাথেই আছি। কিন্তু যদি সময় আসে, এই মরুভূমিতে তুমি যুবক মানুষ একলা ছুটে যেতে পারবে। আমার মতো বুড়ো না-ও পারতে পারি।”

          “কোন সময়ের কথা বলছেন মাস্টার?”

          চুপ করে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো থমাস। “জানি না কখন সময় হবে। কিন্তু যখন সময় হবে তখন হয়তো বুঝতে পারব আমরা দুজনেই-” মাঝপথে থেমে গেল থমাস। হাঁটু গেড়ে হাত দিয়ে নীরবে মাটি স্পর্শ করে কিছু একটা টের পেতে চেষ্টা করলো।

         তড়িৎবেগে উঠে দাঁড়াল থমাস, চিৎকার করে বলল, “তারা এসে গেছে!”  

          স্ক্রলটা আবারও পোশাকের ভেতর ঢুকিয়ে নিজের ঘোড়ায় চড়ে বসলো থমাস। ওদিকে রবার্ট নিজেও তার ঘোড়াকে জাগিয়ে উঠে পড়লো পিঠে, ক্যাম্পিংয়ের জিনিসপত্র এখানেই ফেলে যেতে হবে।

          পেছনে তাকিয়েই দেখা গেল চার পাঁচটি ঘোড়া তাদের দিকে ধেয়ে আসছে, দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে হাতে তলোয়ার নেই লোকগুলোর, আপাতত তাদের নাগাল পেতেই ব্যস্ত তারা।

         ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিলো দুজনেই। কিন্তু থমাসের ঘোড়া মনে হলো দুর্বল হয়ে গিয়েছে, যথেষ্ট খাবারও পায়নি। ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে যেতে যেতে অনেকগুলো চিন্তা করে ফেলল সে।

         “রবার্ট!” দুজনের একজন থমাস জোরে চিৎকার করে ডাকলো তার পাশেরজনকে, ডাকবার আগে একটু পর পর বুকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করছে স্ক্রলটা আছে কি না ঠিকমতো। শেষমেশ আর না পেরে বরং বেরই করে আনলো জিনিসটিকে পোশাকের ভেতর থেকে, পেঁচানো কাপড়ও খুলে নিলো। দেখা গেল, একটি গোটানো কাগজ। এখনও খোলা হয়নি, একদম সিলগালা করা।

          ডাক শুনে সঙ্গী তার দিকে ফিরেছে। চলন্ত ঘোড়ার ওপর থেকে কিছুক্ষণ অপলক তার দিকে চেয়ে থাকলো থমাস। ভাবতে খারাপ লাগছে, এই তরুণ সঙ্গীর জীবনের প্রথম মিশনটাই শেষ মিশন হতে চলেছে, আর কোনো অভিযানে বেরোতে পারবে না সে।

          না। এটা হতে দেয়া যাবে না। অনেকটা জীবন বাকি রবার্টের। যেকোনো মূল্যেই হোক, তাকে বাঁচাতে হবে।

          এক ঝলক সামনে তাকালো থমাস। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে ভোরের আলোতে চকচক করছে সোনালি গম্বুজ।

          জেরুজালেম!

          কত সাধের জেরুজালেম! জীবনে কতবার গিয়েছে সেখানে! দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়েছে এই কিংবদন্তির শহরে। হয়তো আর দেখা হবে না; আর ঢোকাও হবে না জেরুজালেমে।       

          কারণ আর কিছুই না, সত্যি সত্যিই তারা প্রাণের ভয়ে ছুটে চলেছে। যমদূত যেন তাদের পিছু নিয়েছে। তাদের পেছনে দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে পাঁচটি ঘোড়া। লোকগুলোর সবারই মুখ কালো কাপড়ে বাঁধা। প্রায় ধরে ফেলেছে তাদের দুজনকে।

          কিন্তু এই সিলগালা কাগজটা অবশ্যই পাঠাতে হবে জেরুজালেমে, ভাবতে লাগলো থমাস। ক্বোদাসিমের প্রধানকে এটা পৌঁছে দিতে না পারলে যে কী হবে চিন্তাও করতে পারছে না সে।

          জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট এলাকায় তাদের ভোরের মাঝে পৌঁছে যাওয়া উচিৎ ছিল, অন্তত পরিকল্পনা তা-ই ছিল। যার কাছেই গলগথা নামের জায়গাটি। প্রায় সাড়ে এগারশো বছর আগে এই গলগথাতেই রোমানরা ক্রশবিদ্ধ করে যীশু খ্রিস্টকে।

          পেছনে তাকাল থমাস। দূরে বালিতে ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে তৈরি ধুলি উড়ছে। ধাওয়াকারীরা খুব কাছে চলে এসেছে। দূর থেকে পাঁচটা ঘোড়াকে আলাদা করা যাচ্ছে। তাদের ঘোড়াগুলো খুব জোরে ছুটে আসছে। ভাবতে ভাবতে ঘোড়াটাকে রবার্টের কাছে ঘেঁষে আনলো। বের করে আনা স্ক্রলটা বাড়িয়ে দিল তার দিকে।

          রবার্ট তাকালো থমাসের দিকে। শুনতে পেলো তাকে বলছে, “সময় হয়েছে, রবার্ট।”

          “মানে? কী বলছেন মাস্টার!”

          “বাকি পথটুকু তোমাকে একাই যেতে হবে। আমি এখানেই অবস্থান নেব। তাদের গতি কিছুটাও যদি কমাতে পারি তোমার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।”

          “আপনি পাঁচজনের সাথে পারবেন না। তারা আপনাকে মেরে ফেলবে।”

          “আমি জানি পারব না। কিন্তু তোমার-আমার মধ্যে তোমারই শেষ পর্যন্ত পৌঁছানোর সম্ভাবনা বেশি। আমার ঘোড়াও আর পারছে না। এ মিশনে আমাদের ব্যর্থ হবার কোনো সুযোগ নেই। পুরো খ্রিস্টান দুনিয়ার ভবিষ্যৎ আমাদের ওপর নির্ভর করছে।”

          “কিন্তু…”

          “রবার্ট। আমরা যীশুর নাইট। যীশুর জন্য জীবন দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকার শপথ নিয়েই এ পথে এসেছি। এ মিশনে এই মৃত্যু আমার জন্য গর্বের। আমাদের প্রত্যেকেরই একেকটা দায়িত্ব আছে এ লড়াইয়ে। আমার দায়িত্ব আজকে জীবন দেবার। তোমার দায়িত্ব লড়াই চালিয়ে যাওয়ার।”

          রবার্ট আর বিতর্কে গেল না। নিচু গলায় বলল, “ক্বোদাসিমের প্রধানকে স্ক্রলটা পৌঁছে দেওয়ার পর আমি আপনার জন্য প্রার্থনা করব। আপনার এই আত্মত্যাগ খ্রিস্টান বিশ্বকে রক্ষা করুক।“

          “আমেন।”

          বাতাস আর ক্ষুরের শব্দ ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল, “একই ভুলটা তুমি করো না, যে ভুল আমি করেছিলাম! মনে আছে তো সব?”

          নিঃশব্দে মাথা নাড়ল তার সঙ্গী।

          “আর, জীবনটা ভাল করে কাটিও, রবার্ট!”

          থমাস ঘোড়ার গতি ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে। রবার্ট পূর্ণ বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর রবার্ট পেছনে ফিরে তাকাল। মাস্টার থমাস ঘোড়া থামিয়ে পেছনের ধাওয়াকারীদের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে।

          কিছু একটা চিৎকার করে বলতে গিয়েও মুখ ফুটে বলে উঠতে পারলো না রবার্ট, এরকম অদ্ভুত কথাবার্তা কখনও বলতে শোনেনি সে মাস্টারকে। শেষবারের মতো মাস্টারের দিকে তাকিয়ে সে গতি বাড়িয়ে দিল, গন্তব্য জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট।

          প্রায় সাড়ে এগারোশ বছর বাদে আবারও সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা হতে চলেছে। আবারও ইতিহাসের কেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে এ জেরুজালেম।

          কিন্তু রবার্ট কি পারবে?

          রবার্টকে চলে যেতে দেখল থমাস। কিন্তু তাকে সময় দিতে হবে জেরুজালেম পৌঁছানোর, নতুবা দুজনই মারা পড়বে। ঘোড়ার গতি কমিয়ে দিল সে, হাতে তুলে নিলো তলোয়ার।

          পেছনের পাঁচজন মনে হয় আশা করেনি যে, আসলেই থমাস ঘোড়ার গতি কমিয়ে দেবে। অনেকটা রাস্তা আগেই তারা পিছু নিয়েছিলো। বার বার চিৎকার করে বলছিলো থামতে।

          থমাস জানে ঠিক কেন তারা ধরতে চায় তাদের দুজনকে। সেটা হতে দেয়া যাবে না কোনোভাবেই।

          পেছনের ঘোড়াগুলোও গতি কমিয়ে দিল। তার একদম কাছে এসে স্থির হল।

          দুজন নেমে এলো ঘোড়া থেকে। তাদের হাতেও খোলা তলোয়ার।  

          “স্ক্রলটা কোথায়?”

          “পাবে না তোমরা ওটা আর, কোনোভাবেই না!”

          সাথে সাথে মুখ কাল হয়ে গেল দুজনের। দূরের পথের দিকে তাকালো। আর সম্ভব হবে না রবার্টকে ধরা, সে অনেক দূর চলে গেছে।

          “তুমি জানো না তুমি কী করেছ!” দুজনের একজন হতাশ গলায় চিৎকার করে উঠলো।

যেমনটা ভেবেছিল তেমন ব্যবহার না পেয়ে একটু অবাকই হয়ে গেল থমাস। ওকে মারার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

          “তুমি কি জান তুমি কাকে পাঠাচ্ছ স্ক্রলটা?”

          “অবশ্যই…”

          “কী লেখা আছে সেটাও জানো নিশ্চয়ই?”

          “হ্যাঁ, আজই সরিয়ে ফেলা হবে, তোমরা নাগাল পাবে না ওটার।”

          “তুমি নিশ্চিত? সরিয়ে ফেলবেন উনি? নাকি… ভেবে দেখো… ভাল করে ভাবো তো…”

          কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল থমাস। কাল কাপড় সরিয়ে ফেলেছে দুজনেই মুখ থেকে। হঠাৎ তার কাছে পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেলো। বিস্ফোরিত চোখে সে তাকাল জেরুজালেমের দিকে। তার একবার খুব ইচ্ছে হলো রবার্টকে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ডাকে, কিন্তু ডেকেও লাভ হবে না। বহু দূরে রবার্টের ঘোড়ার অবয়ব বিলীন হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে, তার আওয়াজ এতদূর পৌঁছাবে না।

          এতক্ষণ যাদের শত্রু ভাবছিল, সেই পাঁচজনের সাথে দাঁড়িয়ে রইলো সে এক বুক হাহাকার নিয়ে। হেরে গেছে সে, হেরে গেছে নাইট টেম্পলারদের গর্ব থমাস পেরিগর্ড।

          হঠাৎ মাথায় খেলে গেল, পেছনের পাঁচজন তাহলে কে? সে যাদের সন্দেহ করছিল, আসলেই যদি তারা সেই লোক হতো, তাহলে তো এতক্ষণে থমাসের খুন হয়ে যাবার কথা। তার মানে এরা অন্য কেউ। কীভাবে তারা এ খবরটা জানল?

          পেছনে ঘুরে তাকাল সে, “কে তোমরা?”

          একজনও উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। তাদের চোখে কোনো রাগ নেই, আছে কেবল একরাশ আফসোস। তারা যেন অপেক্ষা করছে কখন থমাস নিজেই বুঝতে পারবে তাদের পরিচয়।

          ভোর হচ্ছে। মরুর ভোর সব সময়ই কেমন অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এ হালকা আলোকিত প্রান্তর সূর্যের দহনে নরকে পরিণত হবে।

          থমাস কিংবা রবার্ট কেউ জানতো না, তারা যে দাবার বোর্ডের গুটি হতে চলেছে সেই খেলার ইতি প্রায় হাজার বছর বাদে, হাজার হাজার মাইল দূরের কোনো দেশে, অচেনা কারও হাতে হতে চলেছে।

 ২ 

শেকড়ের সন্ধানে

প্রচ্ছদ: আদনান আহমেদ রিজন

বাংলাদেশ

শীতের ঝরা পাতাগুলো অনেকদিন যাবতই পড়ে আছে এ জায়গাটাতে, কোনো এক অদ্ভুত কারণে আশাপাশের বসার জায়গাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হলেও এ জায়গাটা কেন যেন পরিষ্কার না করেই চলে যায়। রিকশার বেলের আওয়াজ শুনতে শুনতে হাসান বসে পড়লো সেখানে কোনো পরোয়া না করেই; এই রিকশা ব্যাপারটার সাথে সে এখনও পরিচিত হতে পারেনি।

          হাসানকে দোষও ঠিক দেয়া যাচ্ছে না, হাজার হলেও এই প্রথম সে বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়েছে। মার্কিন মুল্লুকে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে, আন্ডারগ্র্যাড আর পোস্টগ্র্যাড জীবনটাও সেখানে; রিকশা, সিএনজি আর এই নিয়মহীন ট্রাফিকে অভ্যস্ত হতে তো তার একটু সময় লাগবেই। তবে অভ্যস্ত হওয়াটা খুব একটা জরুরি নয়, তার ফিরে যাবার সময়ও ঘনিয়ে আসছে, সাড়ে আট হাজার মাইল পেরিয়ে তাকে অবশ্য এবার ভার্সিটির ক্লাস ধরতে হবে না, বিশেষ কোনো এক কাজে তার পুরনো সুপারভাইজর প্রফেসর তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তার নতুন ইউনিভার্সিটিতে। 

          বসন্ত আসি আসি করছে, নতুন পাতাও গজানো শুরু হয়ে গিয়েছে। যে আধ-পরিষ্কার বেঞ্চটা তার আজকের অবসরের ঠিকানা, সেটা একটু পরিষ্কার করে নিলো হাসান পাশেই পড়ে থাকা পত্রিকার বান্ডলটা দিয়ে। পত্রিকার গায়ে এক বছর আগের তারিখ তার মনে একটু ভাবান্তর ঘটালেও কাজে একটুও ঘটালো না- ২০১৮ সালের পত্রিকা এখানে অক্ষত অবস্থায় করছেটা কী? অবশ্য সেই বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে হাসান আয়েশ করে বেঞ্চে বসে পড়লো। আপাতত আজকের পরিকল্পনা, এই চমৎকার আবহাওয়া উপভোগ করতে করতে হাতের বইটা শেষ করা, অনেকদিন ধরে শেষ করব করব করেও আর করা হয়ে উঠছে না।

          কাদের মিয়া নামের তার সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী মানুষটি তার পাশে বসবার কোনোই চেষ্টা করলো না, ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো একটু দূরে। হাসান প্রায় নিশ্চিত, একটু পর কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে যাবে কাদের মিয়া, ফেরত আসবার পর সিগারেটের গন্ধ নাকে আসবে। ক’দিনের রুটিনে এতটুকু মুখস্ত হয়ে গিয়েছে।

          হাসানের প্রাত্যহিক বঙ্গভ্রমণের আজকের পর্বে হাতিরঝিল নামের এ জায়গা ঠিক করে রাখা; কী কী ঘুরে দেখতে হবে সেই তালিকা অবশ্য সে নিজে ঠিক করেনি, বাসা থেকেই করে দেয়া হয়েছে। একা ভ্রমণে আসা হাসান ইন্দিরা রোডের যে বাড়িতে এসে উঠেছে, তারা যে তার আসলে ঠিক কী হন, সেটা সে ঠিকমতো বলতে পারবে না। আত্মীয় গোছের কিছু একটা হন নিশ্চয়ই, এর বেশি কিছু জানবার প্রয়োজন আসলে বোধ করেনি সে; কোনো এক সুদূর অতীতের কাজের জন্য তার বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতার বিনিময়ে জামাই আদরে এ বাড়িতে সময় কাটাচ্ছে সে।

          আমেরিকার যে ইউনিভার্সিটিতে তার প্রাক্তন প্রফেসর জয়েন করেছেন, সেটা অপেক্ষাকৃত একদমই নতুন, কিন্তু অল্প দিনেই অবাক করা রকমের সুনাম কুড়িয়ে নিয়েছে। হঠাৎ করে কোনো এক কারণে নিঃসন্দেহে প্রচুর ফান্ড পেয়ে গিয়েছে লেকমন্ট ইউনিভার্সিটি, যে কারণে প্রায় প্রতিটি ডিপার্টমেন্টেই চমৎকার সব গবেষণা কাজ চলছে, তবে সমসাময়িক খবরে আর্কিওলজি বিভাগের প্রাচীন দুর্দান্ত সব আবিষ্কারের কারণেই বরং বেশি করে লেকমন্টের নাম জনপ্রিয় হয়েছে।

          সৌভাগ্যবশতই বলা চলে, আর্কিওলজি (প্রত্নতত্ত্ব) বিভাগের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবার সুযোগ হয়ে গিয়েছে হাসানের, যেহেতু প্রফেসরের সাথে আগে থেকে বেশ খাতির; তবে সৌভাগ্যই একমাত্র কারণ নয়, ত্রিশের কোঠা ছোঁয়ার আগেই দ্বিতীয় ডক্টরেট নিতে চলেছে হাসান, প্রাক্তন ছাত্রের এ কীর্তি প্রফেসর বেশ গর্বের সাথে শোনান। আর তাছাড়া যে পরিমাণ ফিল্ডওয়ার্ক হাসান করেছে কয়েক বছর ধরে, তাতে এই পাড়ায় তার নাম মোটামুটি মানুষ জেনেই গিয়েছে। প্রফেসর নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টের জন্যই তাকে ডেকেছেন।

          পুরাতনের প্রতি হাসানের আকর্ষণ একদম ছোটবেলা থেকেই, হরেক রকমের বই তার নিত্যসঙ্গী। সে অন্য কথা, তবে এখনও তার সাথে কারা কারা যোগ দিচ্ছে অ্যাসাইনমেন্টের সঙ্গী হিসেবে সেটা হাসান খোঁজ নেয়নি, কেবল একজনের সাথেই অনলাইনে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়ে যাবার পর থেকে। নাম তার জেমস রাইট।

          জেমস এ মুহূর্তে ছুটি উপভোগ করছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কোনো এক দেশে, তার বাকেট লিস্টের অপরূপ অরোরা-দর্শন পূরণ করার লক্ষ্যে ওদিকে ঘুরতে গিয়েছে। আর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হাসান ইকবাল তার প্রবাসে থিতু বাবা-মায়ের বহুদিনের তাড়নায় রাজি হয়েছে সেমিস্টারের ক্লাস শুরুর আগে একটিবারের জন্য হলেও কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশটা ঘুরে আসবার। রিটার্ন ফ্লাইট আর দু’দিন বাদেই।

          বিকেলের আলো কমে আসতে আসতে চারপাশে আলো জ্বলে উঠলো, এতক্ষণে বুঝতে পারলো হাসান এ জায়গার বিশেষত্ব, কেন তাকে এ জায়গাটা ঘুরে যেতে বলেছিল; বিশাল জলাশয়ের পাড়ে বসে মৃদুমন্দ বাতাসের ছোঁয়ার পাশাপাশি সন্ধ্যারাতের এই অপরূপ সৌন্দর্য ডায়েরির পাতায় টুকে রাখার মতো। সেলফোনের ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলে নিয়ে এবারের মতো এ জায়গাকে বিদায় জানাতে দাঁড়িয়ে গেল হাসান।

          “কাদের ভাই!” ডাকলো হাসান। কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।

          কাদের মিয়ার চতুর্থ সিগারেট বিরতি চলছে মনে হয়, আশপাশে তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা সময়ক্ষেপণের জন্য ফোনে সময় দিতে লাগলো হাসান, বইটা তার আলো কমে আসার একটু আগেই শেষ হয়েছে। ফিকশন বইয়ের চেয়ে নন-ফিকশনের প্রতি ঝোঁক বেড়ে চলেছে, এবারের বইটাও তা-ই, ক্রুসেডের ইতিহাস নিয়ে লেখা একটি বই; ব্যাপারটা খুব হতাশাজনক, দু’পক্ষই লড়ে গিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, অথচ দু’দলই মনে করে এসেছে ঈশ্বর আসলে তাদেরই পক্ষে। মাঝখান দিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে যুদ্ধে জমায়েত মানুষগুলো। এমন না যে তারা সবাই নিজ থেকে এসেছিল যুদ্ধে, তাদেরকে বরং জোর করেই পাঠানো হয়েছিল। এমনও হয়েছিল, ক্রুসেডে পাঠানোর জন্য যথেষ্ট সৈন্য সামন্ত হচ্ছে না বিধায় প্রত্যেক পরিবার থেকে অন্তত একজন পুরুষকে পাঠাতেই হবে যুদ্ধে। অবশ্য, শুধু ক্রুসেডের বেলায় নয়, অতীত ইতিহাসের প্রায় সমস্ত যুদ্ধের ক্ষেত্রেই এই জোরপূর্বক যুদ্ধে প্রেরণের ঘটনা আছে। এমনকি যুদ্ধ লাগুক আর না লাগুক, আজকের দুনিয়াতেও বাধ্যতামূলক মিলিটারি সার্ভিসের নিয়ম আছে নানা দেশে। ইরান, ইসরায়েল, কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে নাগরিকদেরকে দেড় বছরের বেশি সময় দিতেই হয় সামরিক বাহিনীতে- ইসরায়েলে তো নারীদের ক্ষেত্রেও বাধ্যতামূলক।

          দূর থেকে হাসানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাদের মিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। দাড়োয়ান, ড্রাইভার আর এখন ব্যক্তিগত বডিগার্ড হিসেবে কাজ করতে থাকা কাদেরের চেহারায় বিব্রত ভাব। কম কথা বলা লোকটিকে অনুসরণ করে গাড়িতে উঠে পড়লো হাসান।

          বাংলাদেশে ঘুরতে যেতে জোর করবার পেছনে যে তার বাবা-মায়ের আরেকটা কারণও ছিল, সেটা হাসান এখানে এসে বুঝতে পেরেছে। ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে তাদের, এ বাসায় অভিভাবকরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সে দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। দু’একদিন বাদেই দেখা যায় কোনো না কোনো নতুন মেয়ের নাম-পরিচয় আর ছবি, কিংবা এই রেস্তোরাঁ সেই রেস্তোরাঁয় দেখা সাক্ষাৎ করা ইত্যাদি। প্রচণ্ড কাজের চাপে এ যাবত বিয়ের চিন্তা মাথায় আনেনি হাসান, তবে বেশি ঝামেলায় না গিয়ে তারা যা বলছেন তা-ই করছে সে, যদিও উত্তরগুলো তার পক্ষ থেকে বরাবরের মতো ‘না’-ই হচ্ছে। আর একদিন বাদে এমনিতেই তার রিটার্ন ফ্লাইট, কাজের কাজ তাদের কিছুই হবে না, এটা নিশ্চিত।

          বাসায় ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যামে বসে এক নজরে ঘোরার লিস্টে চোখ বোলালো। মোটামুটি সবগুলো জায়গাই কভার হয়েছে তার এই অর্ধমাসের বাংলাদেশ ট্যুরে, কাটায় কাটায় আসলে সতেরো দিন। কক্সবাজারের কোলাহলমুখর সৈকত, সেন্ট মার্টিনের তারাভরা আকাশের নিচে নিঃসীম নীরবতা, কিংবা এতগুলো ঐতিহাসিক জায়গা ঘোরা- এত কম সময়ে এত প্যাকড ট্যুর তার আগে দেয়া হয়নি। হঠাৎ অনুভব করলো হাসান, যে দেশটাতে সে বড় হয়েছে, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব ইতিহাস খুবই কম, সবে কয়েকশো বছরের। সেই তুলনায় এই ছোট দেশটিরই ঐতিহাসিক জায়গাগুলোর বয়স হাজার বছরও আছে!

          শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন পেরিয়ে হালকা লাগেজ নিয়ে নিউ ইয়র্কগামী ফ্লাইটের অপেক্ষায় বসে থাকা হাসানের জীবন যে ক’দিনের মাঝেই কোন দিকে নতুন মোড় নেবে, সেটা তাকে কেউ বললেও তার বিশ্বাস হতো না।

 ৩ 

পবিত্র কক্ষ

প্রচ্ছদ: আদনান আহমেদ রিজন

১১৮৭

বাইরের যুদ্ধ দামামাজনিত হট্টগোলের কারণে কক্ষের দরজা জানালা বন্ধ করে রাখা। তাই সাধু ইরাক্লিয়াসের ছোটখাট বিলাসবাড়ির আলিশান কক্ষ দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে আছে, ভৃত্য এসে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো একটু আগে।

         সামনে আরাম-কেদারায় বসে থাকা লোকটিকে উদ্দেশ্য করে ইরাক্লিয়াস কথা বলে চলেছেন, “তোমার কি মনে হয় সালাদিন দখল করে ফেলতে পারবে এ শহর?”

         বন্ধ জানালার ওপার থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ শব্দের দিকে ফিরে মানুষটি বললেন, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের সময় শেষ। জেরুজালেম হাতছাড়া হয়ে যাবে।”

         “এমনটা ভাবার কোনো কারণই নেই। এসব ছোটখাট যুদ্ধ কিছুই না, পৃথিবীতে আরও বড়সড় শক্তি আছে, যেগুলো হাতে পেতে হলে কিছু না কিছু কোরবানি দিতেই হয়। কখনও উৎসর্গ করতে হয় কিছু লোকের প্রাণ, কখনও আস্ত শহর।”

         “এখন কী হাত করতে চাইছেন আপনি?”

         “যা হাতে পেতে চাইছি, তা সত্যি সত্যি পেলে আমাদের কোনো যুদ্ধ নিয়েই আর চিন্তা করা লাগবে না। খ্রিস্টের শহর চিরকালই খ্রিস্টানদের হাতেই থাকবে। কিংডম অফ জেরুজালেম হবে চিরজীবী।”

         ওপাশ থেকে বিভ্রান্ত প্রতিক্রিয়া পেয়ে ইরাক্লিয়াস বললেন, “জোনাথানের নাম মনে আছে?”

         “কোন জোনাথান?”

         “হাজার বছর আগের ইহুদীদের হাই প্রিস্ট জোনাথানের কথা বলছি।”

         “ও আচ্ছা, মনে আছে। তাকে তো খুন করা হয়েছিলো সবার সামনে, না?”

         “হ্যাঁ, তার কথাই বলছি।”

         ইরাক্লিয়াস উঠে পড়লেন, এগিয়ে গেলেন জানালার দিকে। পর্দাটা একটু সরাতেই এক চিলতে আলো এসে সরাসরি গিয়ে পড়লো বসে থাকা মানুষটির চেহারায়, তিনি হাত তুলে আড়াল করলেন, অন্ধকারে অনেকক্ষণ বসে থেকে চোখ সয়ে এসেছে।

         ইরাক্লিয়াস জানালার বাইরে ইঙ্গিত করলেন সোনালি গম্বুজের ডোম অফ দ্য রকের দিকে। এরপর বললেন, “হাজার বছর আগে যখন ওখানে থাকা বাইতুল মুকাদ্দাস দ্বিতীয়বারের মতো ধ্বংস হয়ে গেল, তার আগে যে ক’জন ইহুদী হাই প্রিস্টের নাম ভালো করে জানি আমরা, তার মাঝে একজন ছিলেন আনানুসের ছেলে তরুণ জোনাথান। তিনি যখন প্রাণ হারান, তখন চলছে সবে ৫৬ সাল। কীভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন সেই ঘটনা জানো তুমি?”

         “মনে পড়ছে না।”

         “যখন ইহুদীদের ঈদুল ফিসাখের সময় হতো, মানে পাসওভার আর কি, তখন দূর দূরান্ত থেকে ইহুদীরা ছুটে আসত এই পবিত্র জায়গায়। শুধু পাসওভার না, অন্যান্য ঈদেও একই অবস্থা। এসময় এখানে ব্যবসা হতো দারুণ। জেরুজালেমের জনসংখ্যা তখন এক ধাক্কায় হয়ে যেত প্রায় দশ লাখ। ফটকের বাইরে ব্যবসায়ীরা বসে থাকতো, দূর থেকে আসা তীর্থযাত্রীরা এখানে এসে বাইতুল মুকাদ্দাসে কুরবানি করতো। কিন্তু যা-ই কুরবানি দিক না কেন, পশু কিনতে হবে ইসরাইলি মুদ্রা শেকেল দিয়ে; ধর্মীয় মাহাত্ম্যের কারণে অন্য কোনো বিজাতীয় মুদ্রা তারা গ্রহণই করবে না, ফটকে বসে থাকা খুচরা ব্যবসায়ীদের অধীনেই ছিল সেই কুরবানির পশু। বিদেশি মুদ্রা বদলে তারা শেকেল দিতো তীর্থযাত্রীদের হাতে, বিনিময়ে মোটা অংকের পারিশ্রমিকও রেখে দিত। কেউ তো আর না করবে না।

          “প্রিস্টদের বেধে দেয়া নিয়ম- বাইতুল মুকাদ্দাসের উঠোনের একটা সীমানা পর্যন্ত হলো জেন্টাইলদের কোর্ট, এটা পার হতে পারবে কেবল ইহুদীরা, বিধর্মী অর্থাৎ জেন্টাইলরা থাকবে এ সীমানার বাইরে। একটু দূরে গিয়ে আরেকটা সীমানা, মহিলাদের কোর্ট, এর চেয়ে ভেতরে মহিলাদের যাওয়া নিষেধ, গেলে মৃত্যুদণ্ড। এরপর শেষ সীমানাটা অর্ধবৃত্তাকার, এটার নাম ইসরাইলি কোর্ট, এ পর্যন্ত সাধারণ পুরুষ ইহুদীরা আসতে পারত, নাইকানোর গেট পেরিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে সেই সীমানা শেষ। ঈশ্বরের উপস্থিতির সবচেয়ে কাছে এ পর্যন্তই যেতে পারত সাধারণ মানুষেরা, এর বেশি না। কারণ, ঠিক ওপারে বাইতুল মুকাদ্দাসের পবিত্রতম স্থান হোলি অফ দ্য হোলি’জ, যেখানে ঈশ্বরের উপস্থিতি আছে বলে বিশ্বাস করত ইহুদীরা। এ কারণে, একে ঈশ্বরের ঘরও বলতো।  

          “বছরে মাত্র একদিন হাই প্রিস্ট সেই কক্ষে প্রবেশ করতে পারেন, সেটি হলো পাপমোচনের দিন, ইয়ম কিপুর। সেদিন ইসরাইল জাতির পাপ ঈশ্বর মোচন করেন। একটি দড়ি তার শরীরে শক্ত করে পেঁচিয়ে দেয়া হতো, সে অবস্থায় তিনি পবিত্র কক্ষে প্রবেশ করতেন। যদি তিনি জীবিত বেরিয়ে আসেন, তাহলে ঈশ্বর সবার পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন হাই প্রিস্টের প্রার্থনার বদৌলতে। আর যদি তিনি যোগ্য না হন, তাহলে ইহুদীদের বিশ্বাস ছিল, তাকে সেখানেই ঈশ্বর মৃত্যু দেবেন। তিনি যদি মারা যান, তার মৃতদেহ বয়ে আনবার জন্য যেন আর কাউকে সে কক্ষে প্রবেশ করতে না হয়, সেজন্য তার কোমরে সেই দড়ি, ওটা দিয়েই টেনে আনবে তাকে লোকে।”

          সন্দেহ নেই, ইরাক্লিয়াস খুব সুবক্তা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথাগুলো শুনতে লাগলেন বসে থাকা মানুষটি। ইরাক্লিয়াসকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি হারিয়ে গিয়েছেন হাজার বছর আগের কাহিনীতে।

         “তো সেবছর, মানে ৫৬ সালে, জোনাথানের দায়িত্ব পবিত্র কক্ষে প্রবেশ করার। উঠোনে তাকে দেখা মাত্রই লোকে তাকে একবার স্পর্শ করার জন্য পাগল হয়ে যেত। এই মানুষটি যে একটু বাদে ঈশ্বরের কক্ষে ঢুকতে পারবেন! সেই ভীড় ঠেকাতে প্রহরীরা ব্যূহ তৈরি করে তাকে ঘুরে রাখত। কিন্তু সেই অল্পক্ষণের ছুঁয়ে দেয়ার মুহূর্তটা, সেটি শেষ হয়ে যাওয়া মাত্রই হাজার হাজার মানুষ অবাক হয়ে দেখলো, মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন জোনাথান দ্য হাই প্রিস্ট। তার দেহ থেকে রক্তবন্যা গড়িয়ে যাচ্ছে। কোনো এক কারণে এই ভীড়ের সুযোগে এত মানুষের সামনে হত্যা করে গিয়েছে জোনাথানকে।”

         আসলেই তার জানা ছিল না এ কাহিনী। ইরাক্লিয়াস এবার তার দিকে ঘুরলেন।

         “বালিয়ান, তুমি কি জানো কারা তাকে সেদিন হত্যা করতে পাঠিয়েছিল? কেন পাঠিয়েছিল? সেই কক্ষে যেন ঢুকতে না পারে জোনাথান, এটা নিশ্চিত করা দরকার ছিল কার?”

         “জানি না।”

          ইরাক্লিয়াস কিছুক্ষণ বালিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর নীরবতা ভেঙে উত্তর দিলেন…

          [অসমাপ্ত]

-0-

পুরো বইটি পড়তে অর্ডার করুন রকমারি‘তে:

https://rb.gy/f8jig4

“এলিরিন”
লেখক: Abdullah Ibn Mahmud
প্রকাশনী: আদী প্রকাশন
কভার: আদনান আহমেদ রিজন
পৃষ্ঠা: 144
রকমারিতে অর্ডার মূল্য: 213/-

        ১১৮৭; মরুর বুক চিরে ঘোড়ায় চড়ে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে চলেছে দুই নাইট, গন্তব্য তাদের জেরুজালেম। অবরোধ সম্পন্ন হবার আগেই কাজ সারতে হবে তাদের, যার সফলতার উপর নির্ভর করছে তাদের অস্তিত্ব, জয়-পরাজয় সবকিছুই। তারা কি পারবে কাজটার সমাধা করতে? পারবে কি তারা হাজার বছরের পুরনো সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে?

        হাসান ইকবাল; বর্তমান প্রজন্মের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তুখোড় এক তরুণ আর্কিওলজিস্ট, অল্প বয়সেই যার কিছু দুর্দান্ত অভিযান তাকে কিংবদন্তিতুল্য করে তুলেছে। নতুন ফান্ড পাওয়া লেকমন্ট ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের প্রজেক্টে কাজ করবার নিমন্ত্রণের বদৌলতে হাসানের হাতেই হুট করে এলো গোপন এক মিশনে অংশ নেয়ার সুযোগ, যে মিশন তাকে নিয়ে যাবে স্বপ্ননগরী জেরুজালেমে। সেই রহস্যের সমাধানে, যার বীজ রোপিত হয়েছিল প্রায় সহস্র বছর আগে।

        অতীত আর বর্তমানের মিশেলে এগিয়ে যাওয়া গল্পে পাঠক হারিয়ে যাবেন হাজার বছরের রহস্যজালে। তার চাইতেও বড় কথা, কী এই ‘এলিরিন’?

        অকাল্ট আর আর্টিফ্যাক্ট হান্টিংয়ের ইতিহাস-আশ্রিত এক ইউনিভার্সে স্বাগতম পাঠককে।

প্রচ্ছদ: আদনান আহমেদ রিজন

বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন এই লিংকে- এলিরিন

This is a Bengali article on the Book 'Elirin' by Abdullah Ibn Mahmud.

Related Articles

Exit mobile version