মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন সবকিছু ব্যর্থ হতে থাকে, সত্যের চেয়ে মিথ্যাই যেন বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। জীবনের অঙ্কের হিসাব গুলিয়ে যাওয়ার সে সময়ে আরো প্রকট হয়ে ওঠে একাকিত্ব। জীবনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার সামনে কেবল বিচারক হয়ে আসে সবাই, কিন্তু তার পাশে দাঁড়ায় না হৃদয়ের উষ্ণতা আর সহানুভূতি নিয়ে। পারিবারিক আর সামাজিক মাপকাঠিতে যখন মাপা হয় তার সফলতা আর ব্যর্থতার অনুপাত, তখন কিন্তু মাপা হয় না হৃদয়ের ক্ষতগুলো, মাপা হয় না জীবনের সাথে জীবনের করা তামাশাগুলো। এমনই এক একাকী, নিঃসঙ্গ জীবনের গল্প ফুটে উঠেছে কানাডাতে জন্মগ্রহণকারী ইংরেজ লেখক সল বেলোর ছোট উপন্যাস ‘Seize the Day’-তে।
তবে শুধু ব্যর্থতার আখ্যান নয় এটি, এটি বলে আধুনিক পৃথিবীর সমস্ত তথাকথিত ব্যর্থতা আর যান্ত্রিকতাকে জয় করে মানুষের গভীর জীবনবোধ, জাগতিক তুচ্ছতা থেকে মুক্তি দান করে জীবনের বৃহত্তম সত্যের অনুধাবনের কথাও।
উপন্যাসটি কেন্দ্রিত হয় নায়ক টমি উইলহেমের একদিনের জীবনকে ঘিরে, কিন্তু সেই একদিনের চিত্রের মধ্যেই যেন টমির পুরো জীবনটা চিত্রিত হয়েছে- তার সমস্যা, একাকিত্ব, আকাঙ্ক্ষা আর ব্যর্থতা। আর টমির জীবনের চিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক আধুনিক পৃথিবীর মিথ্যা সভ্যতারই ঘুনে ধরা দিকটাই যেন তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে সভ্যতার নামে প্রদর্শনপ্রবণতা ও প্রতিযোগিতা মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন- সকল ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষকে নিয়ত কেবল ঠকিয়ে যাচ্ছে। গল্পটি শুরু হয় যখন নিউ ইয়র্কের এক হোটেলের তেইশতম তলায় থাকা টমি লবিতে যাচ্ছিলো তার চিঠিপত্র সংগ্রহ করতে, তখন। ঠিক তখনই তার মনে হতে থাকে, লিফটটি যেন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে অনেক অনেক, এই দৃশ্যটি ঠিক যেন টমির জীবনের প্রতীক হয়ে ওঠে। শুধু টমি নয়, এটি যেন রূপক অর্থে দেখায় কীভাবে আমরা আমাদের জীবন নিয়ে অনেক কিছু ভাবি, কিন্তু শেষপর্যন্ত জীবন সেখানে সেভাবেই যায়, যেখানে যেভাবে এর যাওয়ার কথা।
যদি প্রশ্ন করা যায়, বইটিতে টমির জীবনের কোন দিকটা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে? নিশ্চিতভাবে এর উত্তর হবে তার একাকিত্ব অথবা টমির আড়ালে আধুনিক ব্যক্তিমানুষের একদম নিজস্ব অসহায় একাকিত্ব, যেখানে মানুষটি কেবল হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় একটু সত্যিকারের ভালোবাসা, স্নেহ, আন্তরিকতা, হৃদয়ের পরম উষ্ণতা। পৃথিবী যেন এখন মানুষকে বিচার করে কেবল তার অর্জন দিয়ে, কেবল তার সামর্থ্য দিয়ে। ব্যক্তিমানুষ, ব্যক্তিহৃদয় সেখানে যেন অবাঞ্ছিত, অবহেলিত। এভাবেই তৈরি হচ্ছে যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ের শূন্যতা, মানবের অব্যক্ত হাহাকার। শুধু টমি না, বইটির প্রতিটি চিত্রই যেন এই একই কথা বলে, প্রতিটি চরিত্রই তার নিজের দুনিয়ায় একদম একা, নিঃসঙ্গ বিচরণ করে।
টমির বাবা, ড. এডলার, যার সকল চিন্তা কেবল নিজেকে নিয়েই প্রবর্তিত হয়, নিজের স্ত্রী-সন্তানকে পর্যন্ত নিজের জীবনের অংশ ভাবতে পারেন না। অর্থ, বিত্ত, তথাকথিত সফলতার পেছনে ছুটে চলা তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে নিজের সন্তানের অসহায়ত্ব বোঝার বা সন্তানকে পিতার মতো ভালোবাসার ক্ষমতাটুকুও। সেদিক থেকে কি ব্যর্থ টমির চেয়েও তার সফল পিতা বেশি অসহায় না? অন্তত টমি তার সন্তানদের নিজের সমস্ত স্নেহ নিংড়ে হৃদয়ে ধারণ করে।
বিখ্যাত আমেরিকান মার্ক্সবাদী বিশ্লেষক ফ্রেডরিক জেমসন আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার যান্ত্রিক রূপ নিয়ে বলেছেন, পুঁজিবাদ আমাদের অজান্তেই তার মিথ্যা দিয়ে আমাদের মধ্য থেকে সত্যিকারের আবেগ মুছে দিচ্ছে। “Capitalism unknowingly results in the lack of authentic emotion”- এই কথাটিই যেন প্রমাণ করে বইটিতে দেখানো পরিবার ব্যবস্থা।
একটি পরিবার যেখানে প্রায় প্রত্যেকে একে অপরকে মূল্যায়ন করে তার উপার্জন, পেশা আর অর্জন দিয়ে, যেখানে কম অর্থ আর কম প্রতিষ্ঠা একজনের আরেকজনের কাছে করে লজ্জার কারণ, একে অপরকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা হাসিলের জন্য, সেখানে সামান্যই স্থান বাকি থাকে স্নেহ ও সমঝোতার মতো আবেগজাত ব্যাপারগুলোর জন্য। বাবা প্রতিদিন ভয় পায়, কখন জানি ছেলে তার কাঁধে চেপে বসতে চায়, মা ও বোন ভাবে পেশাগত জীবনে ব্যর্থ ছেলে তাদের সামাজিক সম্মানের জন্য হুমকি না হয়ে দাঁড়ায়, আর অন্যদিকে স্ত্রীর কাছে স্বামী অর্থ উপার্জনের পরোক্ষ মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই না- এমন পরিবারের চিত্রই ফুট উঠছে রোজ এই উপন্যাসে আর উপন্যাসের বাইরের সত্যিকারের পৃথিবীতে।
টমির জীবনের উত্থান-পতন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার আরো একটি দিক আমাদের সামনে নিয়ে আসে। মুখোশের অন্তরালে শোষিতকে আরো শোষণ কীভাবে করে যাচ্ছে এই সমাজ ও শাসনব্যবস্থা, তারই স্পষ্টতা যেন দেখা দেয়। পাঠক দেখে যে কীভাবে পিতৃসম বন্ধুকে বিশ্বাস করতে গিয়ে সর্বস্ব হারায় টমি, পাঠক জানতে পারে কীভাবে পরস্পরের বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে পড়লেও টমিকে মুক্তি না দিয়ে কেবল শোষণ করে যায় তার স্ত্রী। কিন্তু এই ঘুনে ধরা সমাজের সবচেয়ে নিখুঁত চিত্রটি ফুটে ওঠে, যখন দেখা যায়, ঘটতে যাওয়া প্রতারণা টের পাওয়ার পরেও সন্তানের শেষ রক্ষা করতে পিতার ইচ্ছাকৃত অবহেলা আর ব্যর্থতা, এমনকি বিপর্যস্ত ছেলেকে আশ্রয় দিতেও পিতার অস্বীকৃতি। টমির নিজের কণ্ঠেই ফুটে ওঠে এই সমাজের চরম সত্য-
“They adore money! Holy money! Beautiful money! While if you didn’t have it you were a dummy, a dummy!”
হলিউডের ঝলমলে আলোয় হারিয়ে যাওয়া টমি উইলহামের জীবনের সমাপ্তি হতে পারতো হতাশা আর ব্যর্থতার অন্ধকার গহ্বরে। নিষ্ঠুর, অনুভূতিহীন, যান্ত্রিক শহর থেকে পালিয়ে যেতে চাওয়া টমি হয়তো শান্তি খুঁজতো মৃত্যুর নিস্তব্ধতায়। কিন্তু উপন্যাসের এক অন্যরকম সমাপ্তি টমির গল্পকে হেরে যাওয়ার কাহিনী নয়, বানিয়ে দেয় জীবন জয়ের আখ্যান, সেই সাথে পাঠক পরিচিত হন লেখকের অতুলনীয় লেখনী প্রতিভার সাথে।
বইটি পড়ার সময় শুরুতে পাঠক জীবনের ধ্বংসের সাথে ব্যর্থতার গল্প শুনতে শুনতে শেষে শুনে যাবেন কত ক্ষুদ্র ঘটনা, কত সামান্য একটি দিন মানুষের সারাটা জীবন মুহূর্তেই বদলে দিতে পারে। জীবনের সর্বত্র থেকে নিগৃহীত টমি যখন পাগলের মতো তার অভিশপ্ত জীবনের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে শহরের রাস্তায় রাস্তায়, তখন এক অচেনা মানুষের জীবনের পরিণতি তাকে বুঝিয়ে দেয়, সকল দৃশ্যমান সত্যের বিপরীতে রয়েছে মানব জীবনের বৃহত্তম অদৃশ্য সত্য, যে সত্য বাতাসের মতোই দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তবু তাই-ই জীবন, তাই-ই আড়াল থেকে বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে।
সেই সত্যের নাম আশা, অদৃশ্য সেই জীবনের ধারকের নাম বিশ্বাস। নিঃস্ব নায়কের হঠাৎ খুঁজে পাওয়া জীবনের আশা আর বিশ্বাসই মোড় ঘুরিয়ে দেয় উপন্যাসটির। নায়কের সাথে পৃথিবীর সব তিক্ত, রুক্ষ সত্যের সমাহারে হারিয়ে যেতে থাকা পাঠকও যেন নায়কের সাথেই হাজির হয় জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটির সামনে- সেটি আশার ফুল, বিশ্বাস ও বিশ্বাসের ওপরে টিকে থাকা ভালোবাসার ফুল। এই অনুধাবন থেকেই পৃথিবীর এক মানুষ আরেক অপরিচিত মানুষকেও হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে এসেছে যুগ যুগ ধরে, অচেনা অজানা প্রাণের জন্য ঝরিয়েছে চোখের পানি। অতি ক্ষুদ্র মানবজীবনে এর চেয়ে বড় সফলতা আর কী হতে পারে! আর কী হতে পারে জীবনে এর চেয়ে বেশি সুন্দর!